Thikana News
০৩ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

৩৬ শে জুলাই ২০২৪ : একটি সৃজনশীল গণঅভ্যুত্থান-৭

ডিজিটাল নজরদারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নামে-বেনামে অসংখ্য হিপহিপ আর্টিস্ট নিরস্ত্র মানুষের পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে, দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে, এ দেশের আপামর সমাজকে সাহস জোগাতে রাতদিন কাজ করে গেছেন।
৩৬ শে জুলাই ২০২৪ : একটি সৃজনশীল গণঅভ্যুত্থান-৭
রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় আন্দোলন কেবল দলবদ্ধভাবে রাস্তায় বা প্রতিষ্ঠানে বা অফিস-আদালতে মিছিল ও সমাবেশ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন নয়; একটি সফল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার অনেক সহগোপকরণ, যেমন স্লোগান, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, দেয়াললিখন, গ্রাফিতি বা পথচিত্র, কার্টুন, বক্তৃতা, গান, কবিতা, পথনাটক, মিম ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে স্লোগান, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড মিছিলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। গণমিছিলে গলায় হারমোনিয়াম ও ঢোলক ঝুলিয়ে গান করতে দেখা যায়। অভিনয়শিল্পীরা পথনাটকও পরিবেশন করে থাকেন। সমাবেশে এসবের অতিরিক্ত বক্তৃতা প্রদান করা হয় এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সুতরাং একটি বড় মাপের আন্দোলনের ক্রিয়াগত, রূপগত ও ভাবগত নানা মাত্রিকতা রয়েছে। জুলাই ’২৪ গণঅভ্যুত্থানে এর সব কটি বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছে। এমন সৃজনশীল গণআন্দোলন সচরাচর পরিলক্ষিত হয় না।

গত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বহু গান রচিত ও সমাবেশে সেসব গেয়ে পরিবেশিত হয়েছে। কথা সুর তাল লয় সংযোগে সংগীতের আবেদন অন্য অনেক প্রকাশমাধ্যমের চেয়ে অধিক মর্মস্পর্শী ও হৃদয়গ্রাহী হয়। বাংলার ইতিহাসে এর অনেক নজির আছে। মধ্যযুগে একমাত্র ‘বৈষ্ণব আন্দোলন’ হয়েছিল, যা ছিল ধর্মীয় আন্দোলন। নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) এতে নেতৃত্ব দেন। তার স্লোগান ছিল ‘হরিবোল’, গান ছিল ‘কীর্তন’। তিনি সভাপরিষদ ও অনুসারীদের নিয়ে দলবদ্ধভাবে মিছিল করতেন এবং ঊর্ধ্ববাহু নৃত্য করে ও কীর্তন গেয়ে ধর্মমত প্রচার করতেন। উনিশ শতকে রাজা রামমোহন রায়ের ‘সতীদাহ প্রথা নিরোধ’ (১৮২৯) এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বিধবা বিবাহ প্রচলন’ আন্দোলনে কোনো মিটিং-মিছিল হয়নি। তারা পত্র-পুস্তিকায় লেখালেখির মাধ্যমে একক চেষ্টায় আন্দোলন করেন এবং রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হন। রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচারিত ‘ব্রহ্মসমাজ আন্দোলনে’র (১৯২৮) সংগঠন ব্রহ্মসভা ছিল, একত্ববাদ মতাদর্শ ছিল এবং ব্রহ্মসংগীত ছিল। ব্রহ্মসভায় ব্রহ্মসংগীত গাওয়া হতো। মুসলমানদের ‘ফরায়েজি আন্দোলনে’র (১৮১৮) নেতৃত্বে ছিলেন হাজি শরীয়তুল্লাহ। এর দেশবাপী সমর্থক দল ছিল, কিন্তু মিছিল, স্লোগান, সংগীত ছিল না, সুযোগ ছিল না। ঢাকার ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’র (১৯২৬) নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক আবুল হুসেন। ‘শিখা গোষ্ঠী’ নামে জ্ঞানী-গুণীজনের সভা-সমাতি ছিল। ‘শিখা’ পত্রিকা ছিল, মটোও ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ একে স্লোগান হিসেবেও গণ্য করা যায়। তবে তারা কখনো রাস্তায় নেমে মিছিল করেননি। বায়ান্নর ‘ভাষা আন্দোলনে’ মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ, স্লোগান, গান সবই ছিল। ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ সাড়া জাগানো গানটি অদ্যাবধি আবেগে অনুভূতিতে অনুপ্রেরণায় সকল শ্রেণির মানুষকে অভিষিক্ত করে চলেছে। এসব আন্দোলনে জুলাই ’২৪ গণঅভ্যুত্থানের মতো সব ধরনের উপাদান এত ব্যাপকভাবে তৈরি হয়নি এবং চর্চাও হয়নি। নানামুখী সৃজনধর্মী ‘৩৬শে জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ বাংলার ইতিহাসে অনন্য এক নতুন যুগের, নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

আমাদের আলোচ্য বিষয় সংগীত। আন্দোলন চলাকালে যেসব গান রচিত ও সভা-সমাবেশে গীত হয়েছে, এমনকি ভিডিওতে ধারণ করে যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারও করা হয়েছে, সেসব গানের কথা বলব। এ সময়ের মধ্যে কত প্রকার ও কী পরিমাণ গান রচিত হয়েছে, তার খতিয়ান তৈরি হয়নি। একজন প্রত্যক্ষদর্শী শিল্পী ও লেখক আকিল আশরাফ বলেন, ‘আমরা যারা গানের লোক, গান বা বন্দুকের নলের সামনে আমাদের নিরীহ গানকেই হাতিয়ার করে বাঁচতে চেয়েছি র‍্যাপারদের প্রবল গণজোয়ারের মতো অগ্নিঝরা লিরিকে। ... র‍্যাপাররা স্বদেশি বিপ্লবীদের মতো আন্দোলনকে বরণ করল ফাঁসির রজ্জুর ন্যায়। নতুন নতুন গান আসতে শুরু করল একের পর এক, আর ‘ফেসবুক থ্রেডে’ সেগুলো ছড়াতে থাকল সারা দুনিয়ায়। ... এমন এক একটি গান বোমার মতো ফাটছিল সারা দেশে। ডিজিটাল নজরদারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নামে-বেনামে অসংখ্য হিপহিপ আর্টিস্ট নিরস্ত্র মানুষের পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে, দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে, এ দেশের আপামর সমাজকে সাহস জোগাতে রাতদিন কাজ করে গেছেন। ... ‘আওয়াজ উডা’, ‘কথা ক’, ‘গদি ছাড়’, ‘দেশ সংস্কার’, ‘বাংলা মা’, ‘দাম দে’, ‘স্বাধীনতার গন্ধ’, ‘রাজাকার’, ‘আবু সাঈদ’, ‘রণক্ষেত্র’, ‘দেশ কারো বাপের না’, ‘শকুনের চোখ’, ‘চব্বিশের গেরিলা’, ‘স্বৈরাচার’, ‘দমায়ে দেখ’, ‘৫২’, শিরোনামহীনের ‘কেন’, শূন্য ব্যান্ডের ‘শোনো মহাজন’, কাকতালের ‘রক্ত গরম মাথা ঠান্ডা’ এবং পারিসার ‘চলো ভুলে যাই’সহ অসংখ্য গান হয়ে উঠল রাজপথের আন্দোলনের বিজিএম।’ -ইজেল, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
অপর লেখক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কথা ক’ গানটি প্রকাশের পর একে একে ইউটিউবে প্রায় ৪০টি র‍্যাপ গান প্রকাশ পায়। তিনি উপরের তালিকার অতিরিক্ত ‘ছাত্র’, ‘স্লোগান’, ‘অধিকার’, ‘জবাব দে’, ‘কত খাবি’, ‘জয় বাংলা’, ‘চব্বিশের গেরিলা’, ‘রক্ত’, ‘বায়ান্ন’ শীর্ষক গানগুলোর উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের নিজস্ব কোনো শিল্পমাধ্যম যদি থেকে থাকে, তবে সেইটা বাংলা র‍্যাপ গান। এই আন্দোলনের যে তারুণ্য, তার যে ভাষা-ভঙ্গিমা, স্পিরিট, তা এই মাধ্যমটিই সবচাইতে ভালোভাবে ধারণ করতে পেরেছে। একটা বিশেষ প্রজন্মের প্রকাশভঙ্গিমা থেকে পৌঁছে যেতে পেরেছে সর্বজনের কাছে। ... অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমে আন্দোলনের বক্তব্য, স্লোগান, দাবিদাওয়ার এত প্রবল উপস্থিতি চোখে পড়েনি। ... সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাসের যত ব্যাকরণ আছে, সব ভেঙেচুরে ছাত্র-জনতার এই সম্মিলিত অভ্যুত্থান একটা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার পতন ঘটিয়েছে। এই ব্যাকরণ ভাঙার চিহ্নাবলি এই সময়ের মধ্যে প্রকাশিত বাংলা র‍্যাপ গানে।’ Ñইজেল, ৩১ আগস্ট ২০২৪ আন্দোলনকালীন র‌্যাপ, হিপহপ গান সম্বন্ধে আরও কিছু মূল্যবান মন্তব্য আছে। যেমন উভয় লেখক দু-এক শব্দে নাম ছাড়া গানের কোনো কলি বা বাণী উল্লেখ করেননি। আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে কতক গানের সম্পূর্ণ বাণী জানতে পেরেছি। প্রথম গানটি হলো নারায়ণগঞ্জের তরুণ র‍্যাপার সেজানের রচিত, সুরারোপিত ও স্বকণ্ঠে গীত র‍্যাপ গান ‘কথা ক’। ১৫ জুলাই পুলিশ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় আহত ও নির্যাতিত ছাত্রছাত্রী, এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্ররাও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। গানটি রচিত হয় এর ঠিক পরের দিন ১৬ জুলাই। এর আগে পর্যন্ত আন্দোলন-সংক্রান্ত কোনো গান রচিত হয়নি। সভা-সমাবেশে নজরুলের, রবীন্দ্রনাথের ও আধুনিক গীতিকারের দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত পরিবেশিত হয়েছে। ২০২২ সালে ইথুন বাবু রচিত ও মৌসুমি চৌধুরীর কণ্ঠে রেকর্ডকৃত ‘দেশটা তোমার বাবার নাকি, করছ ছলাকলা/ কিছু বললেই ধরছ চেপে জনগণের গলা।’ গানটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশে প্রথম থেকেই বেশ জনপ্রিয় ছিল, যা শিক্ষার্থীদের মাতিয়ে রেখেছিল। গানের মুখরা বলে দেয়, কাকে উদ্দেশ করে এটি রচিত। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় বহুল গীত আপেল মাহমুদের ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর’ এবং গোবিন্দ হালদারের ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘আমরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ ইত্যাদি গানও পরিবেশন করা হতো। প্রথম গানটি পশ্চিমবঙ্গে ও আসামেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে, কলকাতার হাসপাতালের নার্স-ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে এ গানের কদর বেড়ে যায়। আসামের ছাত্র আন্দোলনের সময় কণ্ঠশিল্পী আলতাফ হুসেন আসামি ভার্সনে এ গান গেয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এর প্রথম দুই পঙ্্ক্তি হলো : ‘অহম তোমার বাপের নাকি, মিয়া খেদিব খুঁজি।’ (আসাম তোমার বাপের নাকি, মিয়া খুঁজে বিদায় করব)। এটি সরকারের ‘বাঙালি মুসলমান খেদা’র পটভূমি স্মরণ করিয়ে দেয়। সাম্প্রদায়িকতার কারণ দেখিয়ে শিল্পীকে গ্রেপ্তারও করা হয়।

‘কথা ক’ গানের রচয়িতা, সুরকার ও গায়ক মোহাম্মদ সেজান; তিনি নারায়ণগঞ্জের অধিবাসী। গানটি রচনার প্রেরণা, প্রেক্ষাপট ও প্রবর্তনার ইতিহাস সম্পর্কে স্বয়ং সেজান যা বলেন, তা হলো এরূপ : ‘১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ছাত্রদের মারা হচ্ছিল। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠেছিল। খবরটা শুনে খুব খারাপ লেগেছিল, সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। পরদিন চিন্তা করলাম, কিছু একটা করতে হবে। আমি গানটা পারি। ১৬ জুলাই দুপুরের মধ্যে লিখে ফেললাম ‘কথা ক’। ঘোরের মধ্যে রেকর্ড শেষ করলাম; সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ গানটা প্রকাশ করি।... গানে আমি গণমানুষের কথা বলেছি, আমাদের ট্যাক্সের টাকায় গুলি আমাদের ওপর চালাবে কেন? তারাও ছাত্র, ছাত্ররা ছাত্রদের ওপর কেন আক্রমণ করবে? এই ব্যাপারগুলো কাউকে না কাউকে বলতে হতোই, ফলে আমিই বলেছি। ... নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা গানে পেলে সেটার মধ্যে শ্রোতারা নিজেকে খুঁজে পায়। দেশের সবাই তখন একই রকম সংকটের মধ্যে ছিল। গানে ওটা নিয়ে কথা বলেছি। ফলে সবাই গানের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। ... শ্রোতারা তখন বুঝেছে, এটা (র‍্যাপ গান) শুধু হাসি-তামাশা নয়, আমাদের কথাই বলছে, যা সারা দেশের মানুষের ভালো লেগেছে।’ (প্রথম আলো, ৪ নভেম্বর ২০২৪)
এবার গানের বক্তব্য শোনা যাক। ২০ চরণে সম্পন্ন গানের কলিসহ প্রথম চার চরণ : ‘৫২-র তে ২৪-এ তফাত কই রে। কথা ক।/ দ্যাশটা বলে স্বাধীন তাইলে খ্যাচটা কই রে? কথা ক।/ আমার ভাই বইন মরে রাস্তায় তর চেষ্টা কই রে? কথা ক।/ কালসাপ ধরছে গলা পেঁচায়, বাইর কর সাপের মাথা কো? কথা ক।’ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হয়; ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান। তখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মাতৃভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, এখন স্বদেশি স্বৈরাচার শাসকশ্রেণি স্বাধীনভাবে কথা বলতে দেয় না, কণ্ঠ চেপে ধরে। চরণগুলোতে সেজান উভয় আন্দোলনের মধ্যে ঐক্য ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার বিষয় বোঝাতে চেয়েছেন। উভয় শাসকের চরিত্র এক। পরের চারটি চরণে কোটা সংস্কারের দাবিতে নিরস্ত্র ছাত্রদের অহিংস আন্দোলনে পুলিশ-ছাত্রলীগের অস্ত্র নিয়ে হামলায় আহত ও নির্যাতিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পী সেজান শাসকদের শাসন করার ন্যায্যতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলেন। ‘জোর যার মুল্লুক তার! আগে ক মুল্লুক কার?/ লাঠির জোরে কলম ভাঙে, শান্তির নাম তুলল খার।/ কাইল মারলি, পরশু মারলি, মারতে আইলি আজ আবার!/ রাজায় যহন প্রজার জান লয়, জিগা তাইলে রাজা কার?’ গানের শেষ চরণে আশার বাণী : ‘রাইত দেইখা ডরাইস না কেউ, রাইতের পরে দিনডা।’ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত ‘রাইফেল রোটি আওরত’ উপন্যাসে শহীদ আনোয়ার পাশা ঠিক এমন কথাই লিখেছিলেন, ‘নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কত দূরে? মাত্র এই রাতটুকু তো! মাভৈ! কেটে যাবে।’

পরবর্তী ‘আওয়াজ উডা’ র‍্যাপ ‘গানটি রচনা করেন নারায়ণগঞ্জের অপর সন্তান ও সেজানের বন্ধু হান্নান হোসাইন ওরফে শিমুল। ১৬ জুলাই পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদসহ ৫ জন নিহত হন। এর এক দিন পরে ১৮ তারিখে হান্নান ওই গানটি লেখেন ও কণ্ঠ দিয়ে ইউটিউবে প্রকাশ করেন। তিনি নিজস্ব ফেসবুকে লেখেন, ‘কোনো সংস্থার বিরোধিতা করছি না। তবে এর পরিবর্তে আমরা আমাদের সমবয়সীদের কণ্ঠকে প্রসারিত করতে চাই। আমাদের এই দেশকে প্রভাবিত করে, এমন কোনো সমস্যার ওপর আলোকপাত করতে চাই।’ গানটি প্রকাশের পর শ্রোতামহলে জনপ্রিয়তা পায়, কিন্তু সরকার মহলে ক্রোধের সঞ্চার হয়। কারণ একটাই-সরকারের দমন-পীড়ন ও নির্যাতন উন্মোচিত করা হয়েছে গানের ভাষায়। স্বৈরাচার দাম্ভিক সরকার তা মানবে কেন? সেজান-শিমুল উভয়ে জেলহাজতের হুমকির মধ্যে পড়েন, সেজান আত্মগোপন করে রক্ষা পেলেও শিমুলকে গ্রেপ্তার করে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়, পরে জেল দেওয়া হয় (২৫ জুলাই)। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনই তিনি মুক্তি লাভ করেন।

দ্বিতীয় গানের কোরাসসহ চরণসংখ্যা ৩২। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই এটি রচিত হয়। কোরাস বা মুখরাতে পুলিশের গুলি ও গুলিতে নিহত আবু সাঈদ ও অন্যদের হত্যার প্রতিবাদে আওয়াজ তোলার কথা বলা হয়েছে। ‘রাস্তায় এত রক্ত কাগো, আওয়াজ ওডা বাংলাদেশ/ রাস্তায় গুল্লি করল কেডা, আওয়াজ ওডা বাংলাদেশ। ... শহীদ হইল আবু সাঈদ, এরপর গেল আসিফও/ রাফি গেল তারও পরে গেল ওয়াসিফ আদনানও। সোনার বাংলা রয়া যাইব, সোনার ছেলে বাদ্দা গো/ কাপুরুষ এর পরিচয় তগো কইলজা রাখসি মাপদা গো।’ শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ তুলে হান্নান লেখেন :  ‘স্বাধীন বাংলা কইসে খালি, বাংলা আর স্বাধীন হয় নাই/ দেশটা যে কারও বাপের একা, ওর বাপে কয়া যায় নাই/ হের বাপে যা কইরা গেসে, ওর ভিত্তে এডি রয়া যায় নাই।’ গানের শেষ অংশে নেপথ্য থেকে কথা ও সুর ভেসে আসে : ‘স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো/ বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ একাত্তরে দেশ স্বাধীন হলেও নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি, তাই নতুন করে দেশ স্বাধীন করার আওয়াজ ওঠে হান্নানের কণ্ঠে।

কাকতাল ব্যান্ডের পপগান ‘রক্ত গরম মাথা ঠান্ডা’ গানটিও বেশ জনপ্রিয় ছিল। গানটি আকারে বড়। প্রথম কয়েকটি চরণ এরূপ : ‘আগে শত্রু ছিল ভিনদেশি - কত রক্ত দিয়া মুক্তি আইসে/ এহন সবাই একদেশি - তাও রক্ত ঝরে রাজপথে তোমার.../ তোমার হাতের কাগজ-কলম - তোমার হাতের বন্দুকের গুলিতে/ মরে সন্তান তোমার - বন্ধু তোমার কানতাসে/ আহারে আহারে বলে - তুমি কী করতাসো সেইটা বলো আমাদের।’ গানের ভাষা এতই সহজ ও স্পষ্ট যে ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। আবেগ যতটাই বেদনায় ভরপুর, আক্রমণটা ততই তীব্র। একজন বিদগ্ধ লেখক বলেন, ‘সংগীতের স্বর সুর তাল লয়Ñএই সবগুলোর যখন এক সুনিপুণ সংমিশ্রণ ঘটে, তখন এটি এক অনন্য ক্ষমতা অর্জন করে মানুষের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করার, যেভাবে এটি এমনকি ইতিহাস বদলের যাত্রায়ও সঙ্গী হয়ে থাকবে।’ (ঐ)। গানের শেষ চার পঙ্্ক্তি ছিল : ‘মনুষ্যত্বের আধিপত্যে আসুক নতুন দিন/ রক্ত গরম মাথা ঠান্ডা কর, ধর হাল/ অমানুষের দুঃশাসনের পতন ইজ লোডিং/ আর দেরি নাইÑওই দেখা যায় সূর্য রক্ত লাল।’
এখানেও আশার বাণী-দুঃশাসনের পতন আসন্ন, সূর্যোদয় নতুন দিনের সূচনা করতে চলেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশাও ছিল ‘নতুন বাংলাদেশ’। মানভাষা বা প্রমিত বাংলা নয়, স্থানীয় চলতি ভাষার গানও কত শক্তিশালী ও সাড়া জাগানো হতে পারে, আন্দোলনের নবীন শিল্পীরা তা প্রমাণ করেছেন। মাটির ও জীবনের টাটকা সুগন্ধ পাওয়া যায়। [চলবে]
 

কমেন্ট বক্স