Thikana News
২২ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫
ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসে হয়রানি কমেনি, দুর্ব্যবহার নিত্য ঘটনা

বিমানবন্দরে প্রবাসীরা যেন ‘মানুষ’ না

বিমানবন্দরে প্রবাসীরা যেন ‘মানুষ’ না



 
আপনি একজন প্রবাসী। আপনি রেমিট্যান্সযোদ্ধা। আপনার পাঠানো বৈদেশিক মূদ্রায় দেশের অর্থনীতিব চাকা সমৃদ্ধ হচ্ছে। এ কারণে দেশের বিমানবন্দরে নামার পর ইমিগ্রেশনের কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা আপনাকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলেন। হাসিমুখে আপনার ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে দিয়ে সামনের পথ দেখিয়ে দিলেন। কোনো প্রবাসী দেশের কোনো বিমানবন্দরে এমন সুখকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন কখনো? একশ’জনকে এমন প্রশ্ন করলে উত্তর বিমানবন্দরে প্রবাসীরা যেন আসবে না। বরং তারা বলবেন- এতো আকাশকুসুম ভাবনা। কিন্তু কেন? স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কী একজন প্রবাসী নিজের দেশ নিয়ে এমন ভাবনা কেন ভাবতে পারেন না? বরং প্রবাসীরা দেশে ফিরে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসে হয়রানির শিকার হন, এমন অভিযোগ নিত্যদিনের ঘটনা। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা হাসি দূরে থাকুক, রাশভারি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন প্রবাসীদের। তাদের প্রশ্ন মুনে মনে হয়, প্রবাসী হওয়াটাই যেন বড় অপরাধ। 
ইমিগ্রেশনের পর কাস্টমস কর্মকর্তাদের নানা জেরার মুখে পড়তে হয় প্রবাসীদের। গ্রিন চ্যানেল দিয়ে পার হতে গিয়েও কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রবাসীদের সাথে চোর-পুলিশ খেলায় মেতে ওঠেন। কোথা থেকে এসেছেন সেই প্রশ্ন করেন। এরপর লাগেজগুলো স্ক্যান মেশিনে দিতে বলেন। গ্রিন চ্যানেল ব্যবহার করে বিশ্বের কোনো দেশে কোনো বিমানযাত্রী প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন এমন ঘটনা বিরল। 
অতি সম্প্রতি যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে বিমানবন্দরে চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন লিয়ানা নামে এক প্রবাসী নারী। নিরুপায় হয়ে তিনি তার ফেসবুকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন। প্রবাসী লিয়ানার খোলা চিঠি সামাজিকভাবে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। 
জর্জিয়ার আটলান্টা প্রবাসী মুজিবুর রহমান গত ১৪ আগস্ট সোমবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ইমিগ্রেশনের কাউন্টারে যাবার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাকে নানান প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন। কিভাবে আমেরিকা গেছেন সে প্রশ্নও করতে ছাড়েননি। সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এরপর যখন ব্যাগ নিয়ে কাস্টমসের গ্রিন চ্যানেল পাড়ি দিবেন, তখনই একজন কর্মকর্তা প্রশ্ন করলেন - কোন দেশ থেকে এসেছেন? এরপর লাগেজগুলো হাতের আঙুল দিয়ে টিপতে লাগলেন। এরপর বললেন- লাগেজগুলো স্ক্যান মেশিনে দিন। ২২ ঘণ্টা প্লেন জার্নির পর কাস্টমস কর্মকর্তাদের এই হয়রানি সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এসব তদারকির কেউ নেই। 
নিউইয়র্কের বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসাইন জানান, প্রায় ৪ বছর পর মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য তিনি বেড়াতে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। আসা-যাওয়ার পথে তিনি বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা তার কাছে জানতে চান, কেন এক সপ্তাহের জন্য দেশে এসেছেন? এ কথা উত্তর না দিয়ে ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তাকে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন- এই প্রশ্ন করাটা কী জরুরি? ইমিগ্রেশন কমকর্তা রাগান্বিত হয়ে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। 
ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের হয়রানির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বহু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই কাজে লাগেনি। 
প্রধানমন্ত্রীকে প্রবাসী নারীর খোলা চিঠি : 
বাংলাদেশে বেড়াতে এসে বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হয়েছেন এক প্রবাসী নারী। পরে নিজের ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়ে সেই হয়রানির কথা বিস্তারিত লিখেছেন তিনি। পোস্ট থেকে জানা গেছে, প্রবাসী নারীর নাম ‘লিয়ানা’। তার পোস্ট ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। 

লিয়ানার পোস্টটি এখানে তুলে ধরা হলো : ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলাখুলি কিছু কথা। মা হয়ে সন্তানের কাছে নিজের দেশ নিয়ে আজ আমি লজ্জিত। আমার দুই মেয়ে ব্রিটিশ নাগরিক। দীর্ঘ ৭ বছর পর তাদের নিয়ে নিজ দেশে মাত্র ১০ দিনের জন‍্য ঘুরতে এসেছিলাম এই চিন্তা করে -আমি যেমন আমার দেশকে ভীষণ ভালোবাসি তেমনই আমার মেয়ে দুটা ও আমার দেশকে চিনবে, জানবে, ভালোবাসবে। দেশে নিয়ে যাচ্ছি শুনেই আমার বড় মেয়ে খুব কান্না করেছিল- কেন তাদের নিয়ে যাচ্ছি, কী বা আছে, আর কোনোদিন যেন জোর করে না নিয়ে যাই। নিজের দেশের সৌন্দর্য তুলে ধরতে আমি দেশে নেমেই কোনো বিশ্রাম না নিয়ে তাদের নিয়ে ছুটে গেছি কক্সবাজারে। আবার ঢাকায় এসেই পরের দিন ছুটে গেছি শ্রীমঙ্গল ও সিলেট। এই অল্প কিছুদিনের মাঝেও নিজের দেশের গর্বের দিকগুলা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রচণ্ড গরমে মেয়েদের খুব কষ্ট হয়েছে তারপরও তারা আমার সাথে নিউমার্কেট, মিরপুর, বসুন্ধরা, ইষ্কাটন, পল্টন ঘুরেছে।
লন্ডনে প্রতিদিন উন্নত ট্রেনে তারা চড়ে, তারপরও নিজের দেশের গর্বের মেট্রোরেলে চড়িয়েছি। আমি খুব গর্বিত বোধ করেছি মেয়ে দুটি যখন বলেছে তারা আবার আসতে চায় আমার দেশে। অল্পদিনের মধ‍্যে তাদের মাঝে সেই ভালোলাগার জায়গা আমি তৈরি করতে পেরেছিলাম। কিন্তু নিজ দেশের এয়ারপোর্ট কর্মচারীদের অসৎ আচরণে আমি লজ্জিত হয়ে যাই। আমার সময়, আমার টাকা খরচ সব যেন এক মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে যায় যখন আমার মেয়েরা অবাক হয় এয়ারপোর্ট কর্মকর্তাদের হয়রানিমূলক আচরণে।
আমি খুব লজ্জিত আজ। মা হিসাবে সন্তানের কাছে নিজের দেশ নিয়ে লজ্জিত। জানি না আমার এই লেখা আপনার পযর্ন্ত পৌঁছাবে কিনা। তবে এতটুকু বলব—আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি তারা নিজের দেশকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
কিছু দেশ আমরা ঘুরি কিন্তু বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন হয়রানিমূলক চেকিং আছে কিনা আমার জানা নাই।
১. আমরা প্রথম যখন এয়ারপোর্ট ঢুকি একটা স্ক‍্যানসহ শরীর চেক করা হয়। যা অন‍্য দেশে হয় না।
২. ইমিগ্রেশনের চেকইন-এর পর আবার একটা চেক হয়। এইটাই সব দেশে হয়।
৩. গেট খোলা হবার পর যেখানে শুধু বোডিং পাস চেক করার কথা সেখানে কেবিন লাগেজ-এর সাথে যাদের একটা আলাদা ব‍্যাগ থাকে তাদের দাঁড় করানো হয় এবং ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়ে তাদের ছাড়া হয়। যেটা বিশ্বের আর কোথাও নাই।
৪. গেটে ঢোকার পর আবার জুতা ঘড়ি খুলে স্ক‍্যান এবং শরীর চেক করা হয়। বাইরের দেশে স্ক‍্যানে কিছু ধরা পরলেই আলাদা করে শুধুমাত্র মাত্র সেই ভ্রমণকৃত মানুষের তল্লাশি করা হয়। বাকি সবার না।
৫. জীবনের প্রথম দেখা প্লেনে উঠার আগে আবার টেবিল বসিয়ে প্রতিটা যাত্রীদের ব‍্যাগ খুলে সব ঘাটিয়ে তল্লাসি করতে। তাহলে স্ক‍্যান মেশিনটির কাজ কী ছিল?
শুধু তা-ই নয়, যেখানে স্ক‍্যান মেশিনে কোনো জীবননাশক কিছু ধরা পড়েনি সেখানে যাত্রীদের ব‍্যাগ খুলে বলা হচ্ছে এসব জীবননশক এবং কিছু মিষ্টি খাবার টাকা দিতে যেহেতু আমরা শখ করে কিনে এনেছি।
আমার প্রশ্ন হলো যদি জীবননাশক জিনিস হয় তাহলে মিষ্টি খাবার টাকা দিলে সেটা কীভাবে জীবন বাঁচানোর জিনিস হয়ে গেল? এসব কর্মকর্তা তো তাহলে টাকা নিয়ে যে কোনো দুর্বৃত্তকারীকেও প্লেনে উঠার সুযোগ করে দেবে। আমরা কিভাবে এই ধরনের এয়ারপোর্ট কর্মচারীদের কাছে নিরাপদ। এমনকি আপনিও কি নিরাপদ?
এইসব কর্মচারীদের হয়রানিমূলক আচরণ কবে বন্ধ হবে? কবে আমাদের বাইরে থাকা সন্তান দেশে যেতে চাইবে, দেশের জন‍্য কিছু করতে চাইবে?
আমি নিজে মিষ্টি খাবার টাকা দিয়ে প্লেনে বসেছি, নিজের চোখে দেখেছি এক ছোট ভাইকে টয়লেট গিয়ে তার কাঁধের ব‍্যাগ-এর জন‍্য টাকা দিচ্ছে। দেখলাম টয়লেটে লেখা যেন আমরা কোনো কর্মকর্তাকে টাকা উপহার না দিই, কিন্তু কোথাও লেখা নাই এসব কর্মকর্তা যদি আমাদের থেকে টাকা ছিনতাই করে তখন আমরা কী করব? বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে নিজ সন্তানের কাছে আজ আমি সত‍্যি খুব লজ্জিত।
লন্ডনে আমি সাধারণ একটা চাকরি করি। খুব আশা নিয়ে নিজ সন্তাদের কাছে নিজের দেশকে তুলে ধরতে ১০ দিনে আমার খরচ হয়েছে প্রায় ৯ লক্ষ টাকা, যা আমার মতো মধ‍্যবিত্তের জন‍্য সহজ না। কিন্তু আমার দেশের এয়ারপোর্ট-এর এসব অসাধু, অসৎ কর্মচারীদের মিষ্টি খাবার জ‍ন‍্য টাকা ছিনতাইয়ের পদ্ধতি আমার কাছে খুব জঘন‍্য মনে হয়েছে। ছোট দেশ হিসাবে অনেক কিছুই নেই আমাদের যা আমার মেয়েরা মেনেই নিয়েছিল, কিন্তু এয়ারপোর্ট-এর কর্মচারীদের এই ধরনের মিষ্টি খাওয়ার টাকা ছিনতাই পদ্ধতিতে আমার সন্তান আতঙ্কিত। আমরা কি তাহলে নিজ দেশে যাবার স্বপ্ন দেখব না? আমরা কি নিজের সন্তানের কাছে এইসবই তুলে ধরে দেশকে পরিচয় করিয়ে দেব? কতটা তল্লাশি হলে যাত্রী নিরাপদ হবে প্লেনে উঠার জন‍্য? কতটা নির্লজ্জ জাতি হলে নিজের মতো করে নিয়ম বানিয়ে মিষ্টি খাওয়ার টাকা ছিনতাই করতেই থাকবে? এয়ারপোর্ট খুবই অনিরাপদ যেখানে মিষ্টি খাওয়ার টাকার উপর যাত্রীর প্লেনে উঠা নির্ভর করে।
এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ হয়ত অন্ধ-বধির। এয়ারপোর্ট এসব অসৎ কর্মচারী থাকলে স্ক‍্যান মেশিন এবং সিসি ক‍্যামেরার মতো ব‍্যয়বহুল মেশিনের দরকার নেই।
আরও কষ্টের বিষয়—আমাদের ভাই বোনরা যখন দেশের জন‍্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে অচেনা অজানা দেশে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছেন, তারা জানেও না কত কঠিন জীবন পরীক্ষা তাদের জন‍্য অপেক্ষা করছে, আর সেই সময় আমাদের ইমিগ্রেশন অফিসার রা কতোটা অসম্মান নিয়ে তাদের কাগজপত্র চেক করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাদের ফেরত দিচ্ছেন নিজের চোখে দেখা। এই অতি সাধারণ মানুষগুলো কি এতটাই অসম্মানের যোগ‍্য? এই সহজ সরল ভাইবোনগুলো কি সামান‍্য সম্মান আমাদের দেশের এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন অফিসারদের থেকে আশা করতে পারে না? এতটা ছোট মানসিকতার পরিচয় কেন আমরা দিচ্ছি, যেখানে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার উপর আমাদের দেশের উন্নতির অনেক কিছু নির্ভর করে!

কমেন্ট বক্স