কারও হাতে দইয়ের খুটি, কারও হাতে মাটির কলসের গলার ভাঙা অংশ, কারও হাতে মাটির তৈরি ছোট পাতিল-আমরা সবাই কিছু না কিছু একটা নিয়ে ঘোরাঘুরি করতাম কোরবানির পশুর আশপাশ দিয়ে। এই তো ঈদুল আজহার নামাজ শেষ হয়ে গেছে। ইমাম সাহেব বড় একটা ছুরি হাতে নিয়ে একটু পরে আসবেন এবং সকলে মিলে কোরবানির পশু জবাই করা হবে। কিন্তু কোরবানির পশুর পেটের পর্দা দিয়ে ঢোল বানাতে হবে অবশ্যই। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম, কখন ঢোল বানানোর পর্দাটা কোরবানির পশুর পেট ফেড়ে বের করা হয়। আমরা একে অপরের আগে হাত পাততাম-আমাকে একটু ঢোল বানানোর পর্দা কেটে দেওয়া হোক। কার আগে কে নেবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত। পর্দা হাতে পেলে আনন্দ আর কে রাখে ধরে। জোরে জোরে চেঁচামেচি করতাম আর বলতাম, এখনই ঢোল বানাব রে। আনন্দে মন থেকে জানা-অজানা কত গান যে বের হয়ে আসত। খুব যত্নসহকারে মাটির তৈরি জিনিসের সঙ্গে সেই পর্দা লাগানো হতো। এরপর কদুগাছের ঝাল্লার ওপর, খড়ির বেড়ার ওপর অথবা টিনের চালের ছাপরার ওপর সুন্দর করে রোদে শুকাতে দেওয়া হতো। ঠাসঠাস শব্দ যেন হয়, এ জন্য একটু গুঁড়া হলুদ পর্দার ওপর ছিটিয়ে দেওয়া হতো। কচুর পাতার ডাগর কেটে ঢোল বাজানো হতো। একসঙ্গে বাঁশের মাচার ওপর বসে ঢোল বাজাতাম এবং কার তালটা ভালো হয়, সেটাও পর্যবেক্ষণ করতাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বের হলেও ঢোলটা হাতে নিয়ে বাজাতে বাজাতে যেতাম। বড়রা অনেক আনন্দ পেত। মাঝে মাঝে ঢোল বানাতে কোনো সাহাযে্যর প্রয়োজন হলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত।
এই তোরা কেডা কোথায় আছিস, কলা পাতা কেটে আনতে হবে। কোরবানির মাংস কলা পাতার ওপর রেখে ভাগ করতে হবে। বড়দের কাছ থেকে আদেশ পেলে সহপাঠীরা হইচই করতে করতে কলা পাতা কাটতে বের হতাম। একজনের কাঁধে আরেকজন চড়ে কাঁচি দিয়ে কলা পাতা কাটতাম। আবার কখনো একটা কুটার সঙ্গে কাঁচি বেঁধে লম্বা কলাগাছ থেকে কলা পাতা কাটতাম। আনাজি কলাগাছ, উত্তরী কলাগাছ, বিচি কলাগাছ ও সবরি কলাগাছ থেকে কলা পাতা কাটা হতো। আমরা কেউ কলা পাতা কাটতাম, কেউ একটা একটা করে কলা পাতা নেওয়া শুরু করতাম। কলা পাতা এক জায়গায় জড়ো করে রাখা হতো। এরপর একটা একটা করে মাটির ওপর বিছানো হতো। কলা পাতা বিছানো হলে মাংস ভাগ করা শুরু হতো। আমরা চারপাশে দাঁড়িয়ে থেকে মাংস ভাগ করা দেখতাম। অনেক সময় আশপাশে কুকুর ঘোরাঘুরি করলে লাঠি দিয়ে তাড়া করতাম। কুকুর আবার এলে আবারও তাড়া করতাম।
কোরবানির মাংস আনার জন্য খালই নিয়ে যেতাম, কখনো কলার পাতায় করে পেঁচিয়ে মাংস নিয়ে আসতাম। মা মাংস আর খিচুড়ি রান্না করত। গরম খিচুড়ির সঙ্গে গরম মাংস খেতে কী যে স্বাদ লাগত। কত মজা করে টুলে, পিঁড়িতে বা শীতল পাটিতে বসে খেতাম। কত আনন্দ আমরা পেতাম।
সন্ধ্যার আগে ঘোরাঘুরি-কে কোথায় আছিস, নদীর পাড়ে চলে আয় তাড়াতাড়ি। নদীর শীতল বাতাস লাগত গায়ে আর রেডিওতে গান শোনা হতো সাউন্ড বাড়িয়ে দিয়ে জোরে জোরে। একসঙ্গে বসে কত গল্প, অনেক রাত হলেও শেষ হতো না। রাতে কী সুন্দর তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলত। জোনাকি পোকা মিটিমিটি আলো দিত আর চাঁদমামার আলোয় দিনের মতো মনে হতো। গলা ছেড়ে গান গেয়ে অনেক আনন্দ পাওয়া যেত। কোরবানির ঈদে কত আত্মীয়স্বজন বাসায় আসত, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা হতো। কোরবানির ঈদে সবাই একত্র হলে আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে যেত। সমবয়সীরা একত্র হয়ে কোরবানির পশুকে নদী, পুকুর, খাল বা ডোবায় নিয়ে যেতাম ঝাঁপানোর জন্য অর্থাৎ গোসল দেওয়ানোর জন্য। ওরে বাবা, সে কী আনন্দ, কী হুলুস্থুল। এই সর-গরু লাথি দিতে পারে, খালি হাতে গরুর সামনে যাস না, এই লরি নে। লরি হলো বাঁশ দিয়ে তৈরি লাঠি। কেউ মাজায় গামছা বেঁধে, কেউ আবার গামছা মাথায় দিয়ে চলতাম গরুর পেছনে পেছনে। কেউ সামনে গরুর রশি অর্থাৎ দড়ি ধরে টান মারতাম, কেউ পেছন থেকে ধুর, হুর, তাড়াতাড়ি যাÑএসব কথা বলতাম। আর গরু আড়ি করলে অর্থাৎ যেতে না চাইলে লাঠি দিয়ে জোরে আঘাত করতাম। গরুকে নাড়া বা খড় দিয়ে গা সুন্দর করে পরিষ্কার করে দিতাম। গরুর শিং ধরে পানিতে চুবানি মারতাম, গরুর লেজ ধরে সাঁতার কাটতাম। গরুর গোসল শেষ হলে আমরাও গোসল করে নিতাম। গরুর রশি ধরে বাড়িতে নিয়ে এসে বড় বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখতাম। কোরবানির পশু নিয়ে কত মজা করতাম আমরা। কোরবানির পশুর গলায় দোকান থেকে গুগরি কিনে বেঁধে দিতাম। গরু মাথা একটু নড়াচড়া করলে গুগরিটা বেজে উঠত। দর্জির দোকান থেকে ছোট ছোট কাটা কাপড় কুড়িয়ে এনে মালা বানিয়ে কোরবানির পশুর গলায় দিতাম। কেউ আবার কাগজ দিয়ে ফুল বানিয়ে লাল রং করে পশুর গলায় দিতাম। গরুর কাছে এসে দাঁড়িয়ে থেকে গরুকে কত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, তা দেখে আনন্দ পেতাম। মনের মধে্য আনন্দের ঢেউ উদ্বেলিত হতো। বাজারে গিয়ে দোকান থেকে খৈল কিনে আনতাম। সহপাঠীরা মিলে সাইকেল চালিয়ে যেতাম। খড়ের সাথে চিটাগুড় মিশিয়ে গরুকে খেতে দিতাম। তুষের সাথে একটু লবণ মিশিয়ে দিলে গরু খেয়ে ফেলত এক চুমুক দিয়ে। ক্ষেত থেকে খেসারি তুলে গরুকে খেতে দিতাম। আখ ক্ষেত থেকে ডেমি কেটে এনে গরুকে খেতে দিতাম। আখের মাথা কেটে গরুকে খেতে দিতাম। বাজারি, দুইতুলি, বুইচাপা, গছি , শ্যামা ও বুরির গাছ কেটে পশুকে খেতে দিতাম। গরুর গায়ে ডাস বসলে স্যান্ডেল দিয়ে বাড়ি মারতাম। ডাসগুলো আবার শলার মধ্যে একটা একটা করে গেঁথে ফেলতাম। গরুর গায়ে আটালু থাকলে মারতাম। লতাপাতা দিয়ে মশামাছি তাড়াতাম। সেই সব আনন্দের কথা মনে পড়লে বুক ফেটে কান্না আসে।
এখন আর আমরা আগের মতো আনন্দ কোরবানির ঈদে পাই না। জীবন নানা সমস্যায় জর্জরিত। কবে ঈদ আসে আর কবে যায় চলে, তা তেমন হিসাব-নিকাশ রাখা হয় না। এখন গ্রোসারিতে কোরবানির অর্ডার দিই। তারাই সবকিছু রেডি করে দেয়। কখনো ফার্মে গিয়ে কোরবানি দেওয়া হয়। কত কোরবানির পশু দেখি। গাড়িতে করে মাংস নিয়ে আসি। একসঙ্গে বসে মাংস ভাগ করে নিই কিন্তু আগের মতো সেই আনন্দ আর কোরবানির ঈদে পাই না।