সুরমা-কুশিয়ারা নদীর তীর রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ‘অরক্ষিত’ বাঁধের কারণে ভয়াবহ বন্যা ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাধায় দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকায় অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে বিভিন্ন এলাকার নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ। এছাড়া বৃষ্টির মৌসুম শুরুর আগে তড়িঘড়ি করে কয়েকটি ইমার্জেন্সি প্রকল্পের কাজ শেষ করায় নড়বড়ে অবস্থাতেই থেকে গেছে নির্মাণাধীন বাঁধ। এ অবস্থায় কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে বাঁধগুলো। এরইমধ্যে কুশিয়ারা নদীর তিনটি বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাটের বিভিন্ন স্থানে সুরমা-কুশিয়ারার প্রবল স্রোতের তোড়ে কয়েকটি স্থানে ডাইকে (নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ) ফাঁটল দেখা দিয়েছিল। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশের শঙ্কা ছিল। সোমবার সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয়। জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের রারাই গ্রামের প্রায় ১শ ফুট ও বাখরশাল গ্রামে ৪০-৫০ ফুট, খলাছড়া ইউনিয়নের লোহারমহল এলাকার ৩০-৪০ ফুট বাঁধ ভেঙে পার্শ্ববর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানা গেছে। জকিগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ার নদী তীরবর্তী আরও কয়েকটি এলাকায় বাঁধের সমান উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে চরম শঙ্কায় রয়েছেন কুশিয়ারা তীরবর্তী মানুষজন। যেকোনো সময় বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে বলে ধারণা স্থানীয়দের।
এদিকে সুরমা নদীর ৮০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজও হচ্ছে ধীর গতিতে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ২৬ জুন। কিন্তু ধীর গতিতে কাজ হওয়ায় এখন পর্যন্ত তিনটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৩২ থেকে ৪৮ শতাংশ। বাকি দুটির কাজ কাগজে-কলমে ৯০ শতাংশ শেষ হলেও বাস্তবে অনেক কাজ বাকি রয়েছে।
২০২২ ও ২০২৩ সালের ভয়াবহ বন্যায় ভাঙনের পর গত বছর জকিগঞ্জ উপজেলায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ২০-২৫টি স্থানে ইমার্জেন্সি প্রকল্পের কাজ শুরু করে পাউবো।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ শুরুর সময় কিছু বস্তা ও মাটি ফেলে রাখা হয়। পরে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ ছিল। আবার যখন শুরু হয় তখন বিএসএফের বাধায় আবার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় চার-পাঁচমাস কাজ বন্ধ ছিল। পরে বৃষ্টিপাত শুরুর আগে তড়িঘড়ি করে কিছু মাটি ফেলা হয়।
গত কয়েক দিন থেকে টানা বর্ষণ ও উজানের ঢল নামায় পানির প্রবল চাপে এসব বাঁধের মধ্যে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। জকিগঞ্জের ছবরিয়া, শরীফগঞ্জ, থানাবাজারা, রারাইসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি স্থানে ফাঁটল দেখা গেছে। এতে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
জকিগঞ্জের ছবরিয়া এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহমদ বলেন, গত বছরের বন্যায় বাধ ভেঙে ভয়াবহ অবস্থা ছিল ছবরিয়া এলাকায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড পরে বস্তা ফেলে রেখেছিল। তিন-চার মাস আগে ঠিকাদার এস্কেভেটর নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বিএসএফ এসে বাধা দেয়। কয়েকদিন আগে কিছু মাটি ফেলে চলে যান।
তিনি আরও বলেন, এখন নদীর পানি বাড়ায় ও প্রবল স্রোতের তোড়ে ওই বাঁধে ফাঁটল ধরেছে। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে পারে।
আমলশীদ এলাকার বাসিন্দা মর্তুজা আহমদ বলেন, ডাইকের সমান উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত বছর ডাইকের বিভিন্ন ভাঙা অংশে মাটি ও বস্তা দিয়ে রাখা হয়। কিন্তু পুরোনো ডাইকের মতো শক্ত করা হয়নি। এখন পানির চাপে নড়বড়ে অবস্থা। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করতে পারে। আবার পানি বাড়লে ডাইক উপচেও পানি প্রবেশ করতে পারে।
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শাহজালাল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোস্তাক আহমদ চৌধুরী বলেন, নদী প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ চলা অবস্থায় বিএসএফ এসে বাধা দেয়। স্থানীয়রা প্রথম দিকে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু পরে বিএসএফ গুলি করার হুমকি দেয়। পরে আর কাজ করা হয়নি। বিষয়টি পাউবোকে আমরা জানালে তারা বলেন, চুপিসারে যতটুকু করা যায় করতে হবে। এভাবেই কাজ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু এলাকায় ইমার্জেন্সি প্রকল্পের কাজ একাধিকবার করা হয়েছে। তবুও বাঁধ শক্তিশালী হয়নি। ছবরিয়া এলাকায় নদীর ভেতরের অংশে বড় ধরনের খাঁদ রয়েছে। পাউবো থেকে ভেতরের অংশে কাজ না করে দিলে এই বাঁধ স্থায়ীভাবে মেরামত হবে না। এখন যেসব এলাকায় ফাঁটল দেখা দিয়েছে সেখানে সংস্কার কাজ করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশল দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, জকিগঞ্জ-কানাইঘাটে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সবকটি জায়াগায় বিএসএফ বাধা দিচ্ছে। যে যে জায়গায় নদীর কেন্দ্র থেকে ১৫০ মিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ কাজ চলছিল, সেসব জায়াগায় বিএসএফের বাঁধায় কাজ বন্ধ রয়েছে। বিএসএফ বলছে জকিগঞ্জ কানাইঘাট সীমান্ত এলাকার নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি।। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নদীর সীমানা নির্ধারণ করা না হলে বা পিলার না থাকলে তারা কাজ করতে দেবে না।
তিনি আরও বলেন, পাউবোর পক্ষ থেকে এই বিষয়টি বিজিবি ও যৌথ নদী কমিশনের কাছে জানানো হয়েছে। এই দুটি সংস্থা ভারতের সঙ্গে অসংখ্যবার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও পতাকা বৈঠক করেছে। তবুও সমাধান হয়নি। সম্প্রতি ভারত তাদের সীমান্তে নদী প্রতিরক্ষার কাজ করার জন্য আমাদের চিঠি দিয়েছে। কিন্তু আমরা বলেছি, তারা কাজ করলে আমরাও কাজ করবো। এখন এই অবস্থাতেই রয়েছে।
যেসব জায়গায় বিএসএফের বাধা নেই সেসব প্রকল্প নিয়ে তিনি বলেন, সুরমা-কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণসহ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। বর্তমানে বৃষ্টির কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে অতিরিক্ত পানির চাপে বিভিন্ন স্থানে বাঁধে ফাঁটল ধরেছে। আমাদের লোকজন সেসব এলাকায় গিয়ে আজ কাজ করবে।
তিনি বলেন, বিএসএফের বাধার কারণে সুরমা ও কুশিয়ারার অন্তত ৩০টি স্থানে বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ ছিল। এখন বৃষ্টিপাতের কারণে কাজ করা যাবে না। পানি কমলে আবার কাজ শুরু হবে।
সুরমার প্রতিরক্ষায় ৮০কিলোমিটার ডাইক নির্মাণ প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতদিন কাজ বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় কাজ শুরু হবে। বিএসএফ আর বাধা দেবে কি না সেটা কাজ শুরু করলে বোঝা যাবে।
ঠিকানা/এসআর