দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠেয় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী সোমবার (২১ আগস্ট) জোহানেসবার্গের উদ্দেশে রওনা করবেন সরকার প্রধান।
আজ ২০ আগস্ট (রবিবার) প্রধানমন্ত্রীর ব্রিকস সম্মেলন নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
চার বছর পর বৈঠকে বসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠেয় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক হতে যাচ্ছে। বৈঠকে পাঁচ দেশের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট-ব্রিকসে যুক্ত হতে বেইজিংয়ের সমর্থন চাইবে ঢাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক সূত্র বলছে, জোহানেসবার্গে আগামী ২২ থেকে ২৪ আগস্ট ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেবেন। সম্মেলনের ফাঁকে সরকারপ্রধান চীন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
ব্রিকস সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ হলেও আনুষ্ঠানিক বৈঠক নিয়ে এখনও নিশ্চিত বার্তা মিলছে না। তবে আগামী মাসে (সেপ্টেম্বরে) নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। তখন নয়াদিল্লিতে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবেন হাসিনা-মোদি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেবেন। আগামী ২২ থেকে ২৪ আগস্ট জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলন চলবে। ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ব্রিকসের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কার্টেসি কল অন করবেন। সেখানে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হবে। চীন সেপ্টেম্বরে এশিয়ান গেমসে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করেছিল, কিন্তু ওই একই সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালের চার বছর পর চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হবে। সেই বিবেচনায় বৈঠকটি অবশ্যই খুব গুরত্বপূর্ণ। দুই শীর্ষ নেতা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন। বৈঠকে নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা নেই। দুই দেশের সম্পর্ক কীভাবে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়, সেই বার্তা হয়ত দুই নেতা দেবেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক যে প্রেক্ষাপট দাঁড়িয়েছে, সেখানে হাসিনা-জিনপিংয়ের বৈঠক বেশ গুরত্বপূর্ণ। এছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পশ্চিমাদের অব্যাহত চাপের মধ্যে এই দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক হবে অনেক বড় বার্তা।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়াও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকবে। এর ফলে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। ঢাকা-বেইজিংয়ের মধ্যে অফিসিয়াল পর্যায়ের বিষয় আলোচনাধীন রয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক আলোচনায় সমাধান সম্ভব হবে।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক গভীর। এ রকম সম্পর্ক অন্যান্য আরও অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আছে। ভারতের সঙ্গে আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আছে, জাপানের সঙ্গে আছে। একেক জনের সঙ্গে সম্পর্কের গুরত্বের আলাদা আলাদা কারণ আছে। তার ফলে যত ঘন ঘন দেখা হবে, সেটাই আমরা চাই; তাও সবসময়তো হয়ে ওঠে না। ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে একটি সুযোগ গ্রহণ করে তারা কথাবার্তা বলবেন। দুই দেশের যে সম্পর্ক তাতে এ ধরনের কথাবার্তার গুরুত্ব রয়েছে অনেক।
সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, অনেক বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে হয়ত আমাদের সহযোগিতা বা এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা থাকতে পারে। সেগুলো কীভাবে দূর করা যায়। নতুন কীভাবে কোনে ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ভূ-রাজনীতি নিয়ে পরস্পর পরস্পর বিনিময় করা যেতে পারে।
ব্রিকসে বাংলাদেশ যুক্ত হওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক অবস্থানে চীন। নতুন কোনো দেশকে যুক্ত করার বিষয়ে জোটটির সদস্যদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্রিকসের সদস্য পদ পেতে বেইজিংকে পাশে চাইবে ঢাকা।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা চাইছি, ব্রিকসে যুক্ত হতে। প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে এ বিষয়ে চীনের সমর্থন চাওয়া হবে, যেন ব্রিকসে আমাদের যুক্ত করা হয়।
চলতি বছরের জুন মাসে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসের সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছে। ওই মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বৈঠকের পর বিষয়টি সামনে আনেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে সময়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশ আগস্টে ব্রিকসের সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে পারে।
গত বছর ব্রিকসে নতুন সদস্য বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করে জোটের পাঁচ দেশ। তবে পরবর্তীতে জোটের মধ্যে মতের অমিল আর বিভক্তি দেখা যায়। বিশেষ করে, ভারত ও ব্রাজিল ব্রিকসে নতুন সদস্য নেওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। এতে করে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠেয় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে নতুন কোনো সদস্য জোটটিতে যুক্ত হতে পারছে না, এটাই অনেকটাই স্পষ্ট। তাই ব্রিকসে যোগ দিতে অপেক্ষায় থাকতে হবে বাংলাদেশসহ আগ্রহী দেশগুলোকে।
এ নিয়ে ২৩টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে আবেদন করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশ চলতি বছরে আবেদন করেছে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, চীন আমাদের নেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু ভারত ও ব্রাজিল এখন নতুন সদস্য যুক্ত না করার কথা বলছে। ব্রিকস এমন একটা সংগঠন যেখানে ভারত-চায়না দুটোই আছে। পরে দেখা যাবে সার্কের মতো অবস্থা হবে ব্রিকসের। দুই দেশের রেষারেষিতে পরে সংগঠনই বন্ধ হয় কি না, এ রকম হতেও পারে ভবিষ্যতে।
ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজের ভাষ্য, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা চাইছে আমরা ব্রিকসে যাই। আর ব্রাজিল চাইছে না, বিষয়টা এমন না, চাইছে। আমরা যতটুকু বুঝতে পারছি তারা একটু ধীরে যেতে চাইছে। তারা চাইছে আরও কিছু নিয়মকানুন তৈরি হোক। তারা নিজেদের মধ্যে আগে বোঝাপড়া করে আমাদের নিতে চায়, এমন একটা ভাব বোঝা যাচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত কি হয় দেখা যাক। এটা নিয়ে এত অস্থির হওয়ার কিছু নাই।
নির্বাচন প্রসঙ্গ
চলতি বছরের শেষে না হলেও আগামী বছরের শুরুতেই বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে নানা মেরূকরণ দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে অব্যাহত বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত ও চীনের অবস্থান নিয়ে কূটনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা। ইতোমধ্যে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হলেও চীনে অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যে দিকে যাচ্ছে, চীন তার বিপরীত দিকেই যাবে।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চায় ২১০ সংস্থা
জোহানেসবার্গে হাসিনা-জিনপিংয়ের বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবশ্য দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে নির্বাচন প্রসঙ্গ আসবে কিনা, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইছে না ঢাকার কূটনীতিকরা।
দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, নির্বাচন প্রসঙ্গ আসবে কী, আসবে না সেটা আমরা জানি না। এটা একটা কার্টেসি কল। এখানে অনেক কিছু আলোচনায় আসতে পারে।
জিডিআই প্রসঙ্গ
গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই)-এ বাংলাদেশকে পাশে চায় চীন। চীনের প্রেসিডেন্টের এ উদ্যোগে যুক্ত হতে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বার বার ঢাকাকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। তবে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ জিডিআইয়ে যুক্ত হবে না বলে স্পষ্ট করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাসিনা-জিনপিংয়ের বৈঠকে জিডিআই প্রসঙ্গ আসবে কি না- জানতে চাইলে ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, আমার মনে হয় না, এ ব্যাপারে চীনের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে বলবে। আবার তুলতেও পারে। কোনো কিছুই নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যদি তারা তুলেও, আমরা বলব- আমাদের আরও পরীক্ষা-নীরিক্ষার প্রয়োজন।
বৈঠকে মোমেন-ওয়াং ই
গত বছরের আগস্টে ঢাকা সফর করেছিলেন চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। সেই সফরে চীনের প্রেসিডেন্টের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) ও গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই)-এর মতো উদ্যোগে বাংলাদেশকে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে বলেছিলেন, জিডিআই-এ যুক্ত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ইতিবাচক।
লি’র উত্তরসূরি চীনের নতুন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন গত মার্চের মাঝামাঝিতে এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, জিডিআইয়ের বিষয়ে বাংলাদেশ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়েও বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে ঢাকাকে জিডিআইয়ে যুক্ত করার বিষয়ে নানা ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
ঠিকানা/এসআর