বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১০ মে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম আইসিটি আদালতে বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে আইন সংশোধন করে এই আদালতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের সুযোগ দিচ্ছে। জাতিসংঘের তদন্তে আওয়ামী লীগ সরকার ও দলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগের বিরোধী সবাই ভাবছে আওয়ামী লীগের দিন শেষ। এরা আর ফিরে আসতে পারবে না। এই অনুমান সত্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। এই অনুমান মিথ্যা প্রমাণ করে আওয়ামী লীগকে ফিরে আসতে হলে দেশে দুটো শর্ত বিরাজমান থাকতে হবে।
প্রথম শর্ত হচ্ছে, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে দেশে সার্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হতে হবে। এমনকি যদি বর্তমান ইউনূস সরকারও দীর্ঘ মেয়াদে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ব্যতীত ক্ষমতায় থাকে, তাহলেও শর্ত পূরণ হবে। বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর থেকেই মানুষ আর আওয়ামী লীগের জঞ্জালের অজুহাতে কোনো ব্যর্থতা মেনে নেবে না।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, রাজনৈতিক কৌশলে যদি আওয়ামী লীগ ইস্যু দ্রুত সমাধান না করে দীর্ঘায়িত করা হয়। যাকে-তাকে আওয়ামী লীগের দোসর, সরকারের সমালোচনা করলেই আওয়ামী লীগের দোসর-ফ্যাসিস্ট গালি দিতে থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের জামায়াত নীতির মতো এ কৌশল বুমেরাং হবে। মানুষ এগুলো শুনতে শুনতে বিরক্ত হবে। দ্রুত রিকনসিলিয়েশনের জন্য কমিশন করে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে এসে বাকিদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় নিয়ে আসার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় আওয়ামী লীগের ফিরে আসার দ্বিতীয় শর্ত পূরণ হবে।
দেশে কেবল উপরিউক্ত অবস্থা বিরাজ করলেই স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ফিরে আসতে পারবে না। তাদেরকে ফিরে আসতে হলে চারটি কৌশল কিংবা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হবে।
প্রথম প্রক্রিয়া : আইসিটি আদালতের মাধ্যমে তারা বেকসুর খালাস হয়ে রাজনীতিতে ফিরতে পারে। সরকার আদালতে সঠিকভাবে মামলা পরিচালনা না করলে এ সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া যদি আদালত নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নিষিদ্ধ করে, তখন ওই মেয়াদের পরও ফিরে আসতে পারবে।
দ্বিতীয় প্রক্রিয়া : সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক বড় ধরনের বিভাজনের ফলে জনমনে সরকারের ওপর অসন্তোষ বিরাজ করলে এবং সেনাবাহিনীতে আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত নেতৃত্ব থাকলে সামরিক হস্তক্ষেপে ক্ষমতার পরিবর্তনের সুবাদে আওয়ামী লীগ ফিরে আসতে পারে।
তৃতীয় প্রক্রিয়া : প্রতিবেশী দেশের সামরিক আগ্রাসনের সুযোগে এবং দেশের সামরিক বাহিনীর একটি অংশের সমর্থনে (যদি প্রতিবেশীরা একটি অংশকে ম্যানেজ করতে পারে) আওয়ামী লীগ ফিরে আসতে পারে। প্রতিবেশী দেশে এ রকম উগ্র লোকজন ক্ষমতায় থাকলে তারা তাদের দেশের যেকোনো গন্ডগোলের দোষ বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারে। যে রকম সম্প্রতি পেহেলগাম হামলার অপ্রমাণিত দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে আগ্রাসন চালিয়েছে। পাকিস্তান জবাব দিতে পেরেছে। বাংলাদেশের এই লেভেলে জবাব দেওয়ার সক্ষমতা নেই। এর ওপর দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বিভাজন ও গণ-অসন্তোষ প্রকট হলে তা সম্ভব হতে পারে।
চতুর্থ প্রক্রিয়া : ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য নির্বাচিত বিএনপি সরকার যদি জামায়াতকে কোণঠাসা করে ফেলে এবং পারস্পরিক চরম অবিশ্বাস তৈরি হয়, তাহলেও তাদের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ক্যাম্পাসগুলোতে যেভাবে ছাত্রদল-ছাত্রশিবির রক্তাক্ত সংঘাতে জড়িয়েছিল, সেভাবে আবার জড়ালে ১৯৯৬ এর পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে ভিন্ন নামে নতুন দল নিয়ে আসতে হবে। জামায়াতের আস্থা তৈরিতে হয়তো বিদেশি কোনো প্রভাবশালী দেশের মধ্যস্থতাও লাগতে পারে। তবে দেশে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং জুলাই বিপ্লবের শক্তিগুলোর মধ্যে মিনিমাম বোঝাপড়া থাকে, তাহলেও আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতার ধারেকাছেও আসতে পারবে না। প্রভাবহীন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে যেকোনো নামে সর্বোচ্চ জাতীয় পার্টির মতো থাকতে পারে। এ ছাড়া যদি তারা সশস্ত্র আন্দোলনের পথে যায়, তাহলে কোনো সম্ভাবনাই কাজে লাগবে না। অনেকেই একাত্তরের গেরিলা যুদ্ধের দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এ পথে পা বাড়ালে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। বড়জোর পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির মতো থাকবে। কারণ একাত্তরে ছিল ন্যায়যুদ্ধ। নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে পাক বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিল। আর আজকে আওয়ামী লীগ গণহত্যা, গুম-খুন ও গণতন্ত্র হত্যার জন্য দায়ী। এসব কারণে তাদের ফিরে আসার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। এর ওপর সশস্ত্র পথে গেলে জনগণ তাদেরকে নির্মূলের পথে হাঁটবে। অনেক প্রাণহানি হতে পারে, তবে দিনকে দিন আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে যাবে। এখন দেখার পালা আওয়ামী লীগ তাদের ফিরে আসার জন্য কোন পথ বেছে নেয়। আর আওয়ামী লীগ বিরোধীরা তাদের প্রতিহত করতে কোন কৌশলে রাজনীতির দাবার ছক আঁকে। লেখক : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার, মিশিগান।