Thikana News
২৫ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

বিএনপি, অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচন

৫ আগস্ট ছাত্ররা ঘটালেও বিএনপির অবদান অস্বীকার করা যাবে না। দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম, জেল, জুলুম সহ্য করেছে বিএনপি। একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েই ছিল। তবে আওয়ামী পতনের সব কৃত্বিত্ব তারা দাবি করলে সেটা সঠিক হবে না। এখানে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা ছিল মূল অনুঘটক। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোনো এক অলৌকিক কারণে আওয়ামী লীগের লোকজন বিএনপির বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। 
বিএনপি, অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচন
এরশাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগকে হতবাক করে দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। পাঁচ বছর বেগম খালেদা জিয়া চমৎকারভাবে দেশ পরিচালনা করেছিলেন। আমার সব সময় মনে হতো শিল্পপতিরা রাজনীতিতে এলে দেশের জন্য ভালো হবে। তাদের চুরির ধান্দা থাকবে না। দেশের জন্য কাজ করবে। বিএনপির টিকিটে নির্বাচন করে প্রায় ৬২ জন শিল্পপতি এমপি-মন্ত্রী হয়েছিলেন সে বছর। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মুন্নু সিরামিকের এমডি হারুনুর রশিদ খান মুন্নু। আমি ঠিক তার আগের বছর ১৯৯০ সালে মুন্নুতে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করি। অবাক কাণ্ড হচ্ছে মুন্নু সাহেব আমাকে খুবই পছন্দ করে ফেলেন এবং তার রাজনীতি দেখভালের দায়িত্ব দেন। আমার জন্য এটা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমি ২০০২ পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেছি। মুন্নু সাহেব ছিলেন আপাদমস্তক একজন সৎ রাজনীতিবিদ এবং শিল্পোদ্যোক্তা। তিনি ছিলেন দানবীর। আজকের দিনে তার মতো মানুষ খুবই বিরল।

এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তারাও অনেক শিল্পপতিকে নমিনেশন দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা খুবই প্রত্যাশিত ছিল এবং শেখ হাসিনার পাঁচ বছরও চমৎকারভাবে দেশ পরিচালিত হয়েছিল। ২০০১ সালে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তখন একটা গণতান্ত্রিক ধারার প্রচলন হয়েছিল। তিনটি নির্বাচনই ছিল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং সেই নির্বাচনগুলো অপেক্ষাকৃত সুন্দর হয়েছিল। পার্লামেন্ট ছিল মুখরিত। শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে যা হয়। কারণ আমি প্রায় এক যুগ সংসদের প্রসিডিংস কাছ থেকে দেখেছি। এর পরই সব বদলে যেতে থাকে। ক্ষমতার লোভ পেয়ে বসে দলগুলোকে। ১/১১ সব লন্ডভন্ড করে দেয়। তারপর আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকে। গত পনেরো বছর কোনো নির্বাচনই হতে দেয়নি। একটা স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করে। দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন মন্ত্রী, এমপি ও অনুসারীরা। গত বছর প্রবল গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হয়। বেশির ভাগ নেতাই বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন এবং বিলাসী জীবন যাপন করছেন। অথচ কর্মী-সমর্থকেরা কষ্টে আছেন। অনেকে জেলে আছেন। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। তারা বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনা কোনো ভুল করেননি এবং যেকোনো সময় ফিরে আসবেন। অন্ধ সমর্থকেরাই আওয়ামী লীগের শক্তির জায়গা।

এখন প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। তারা সংস্কারে মনোযোগী। অনেকগুলো কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা কাজও করছে। সরকারের সফলতা অনেক ক্ষেত্রেই এখন দৃশ্যমান। আইনশৃঙ্খলা এখন যথেষ্ট ভালো। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলো তেমন খুশি হতে পারছে না। তারা দ্রুত নির্বাচন চায়। রোডম্যাপ চায়। বিশেষ করে বিএনপি। জামায়াত বা এনসিপি নামের নতুন দলটি এখনই নির্বাচন চায় না। এনসিপি আন্দোলনের মূল স্টেক হোল্ডার। আবার বিএনপির চাওয়াও যৌক্তিক। বিগত দিনগুলোতে তারাই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, নির্যাতিত হয়েছে, জেল-জুলুম সহ্য করেছে। খালেদা জিয়া বিনা দোষে দীর্ঘদিন জেলখানার নির্জন সেলে বন্দী ছিলেন। তারেক রহমান নির্বাসিত থেকে দল পরিচালনা করেছেন। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্রে ফেরার মূলকথা নয়। সংষ্কার ছাড়া নির্বাচন হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে হবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি ও জামায়াত ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করছে। মাঠপর্যায়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও দলীয় হাইকমান্ড এসব ব্যাপারে অনেক শক্ত অবস্থান নিয়েছে। বিএনপিকে এখনই সতর্ক হতে হবে। দেশের মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড অবজার্ভ করছে। তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরোনো স্টাইল থেকে তাদের বের হতে হবে। শুধু তাত্ত্বিক কথা বলে মানুষের মন গলানো যাবে না। ইউনিক কিছু করতে হবে, যা মানুষকে আশাবাদী করে।

আগামী ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা বলেছে সরকার। ঢাকার বাইরের মানুষের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড বা তাদের হৃদয়ের কথা যতখানি না পৌঁছায়, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক দলগুলোর মেঠো কথার আবেদন বেশি। দীর্ঘদিনে এই অভ্যাস তৈরি হয়েছে। সুইডিশ লেখক ও ইতিহাসবিদ জোহান্স নর্গবাগ বলেছেন, গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতিতে মানুষ সম্ভাবনা নয়, সুরক্ষা খোঁজে। তিনি ‘দ্য প্রোগ্রেস’ গ্রন্থে এই ধারণা তুলে ধরেন। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী যে কথোপজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তারাও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সম্মেলনকক্ষের অনুরাগী। বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের সামাজিক কোনো রূপান্তর গ্রামীণ পরিসরে দেখা যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কেবল গুটিকয় শহরের সমষ্টি নয়। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে গ্রামের মানুষদের যুক্ত করা না গেলে তা বিশেষ কোনো ফল আনবে না। আরেকটি বিষয় হলো, শাসন যত ভালো হোক না কেন, তা যদি জনগণের মনে স্বস্তি তৈরি না করে, তাহলে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় না। শেখ হাসিনার পতনের মূলে রয়েছে জন-অসন্তুষ্টি। উন্নয়ন একটু কম হলেও সমস্যা নেই। মানুষ স্বস্তি চায়। ৫ আগস্ট-পরবর্তী মাঠে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, হানাহানি, কলহ, ক্ষেত্রবিশেষে খুনোখুনির অভিযোগ উঠছে। মানুষ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল একটু স্বস্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদার আশায়। বাস্তবে জনপরিসরে নতুন করে অস্বস্তি বাড়ছে। এটাই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।

এদিকে ৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একমাত্র টার্গেট ছিল বিএনপি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে একবার করে গালি না দিলে তাদের পেটের ভাত হজম হতো না। অনেকটা ইবাদতের মতো ছিল ব্যাপারটা। বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে, ওবায়দুল কাদের। বিএনপি নামে যে একটা দল আছে, সেটা আওয়ামী লীগ মনে করিয়ে দিত প্রতিদিন। সেই তুলনায় জামায়াত কম অত্যাচারিত হয়েছে। আর জাতীয় পার্টির মতো সুখী দল কেউ ছিল না। দীর্ঘ পনেরো বছর আরাম-আয়েশে ছিল। পরগাছার মতো। সরকারি গাড়ি, বাড়ি, ব্যবসা, ক্ষমতা ভোগ করেছে। আর বিএনপি প্রতিদিন অত্যাচারিত হয়েছে। খালেদা জিয়া কারাগারের নির্জন সেলে দিন যাপন করেছেন দিনের পর দিন। বিএনপি কিন্তু আন্দোলন করে তাদের নেত্রীকে মুক্ত করতে পারেনি। এমনকি চিকিৎসার জন্য বিদেশেও পাঠাতে পারেনি। অথচ বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় দল, জনপ্রিয় দল। তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের বিরোধিতা করেছে, আপস করেনি।
৫ আগস্ট ছাত্ররা ঘটালেও বিএনপির অবদান অস্বীকার করা যাবে না। দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম, জেল, জুলুম সহ্য করেছে বিএনপি। একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েই ছিল। তবে আওয়ামী পতনের সব কৃত্বিত্ব তারা দাবি করলে সেটা সঠিক হবে না। এখানে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা ছিল মূল অনুঘটক। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোনো এক অলৌকিক কারণে আওয়ামী লীগের লোকজন বিএনপির বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। বরং বিএনপির প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। তাদের সব রাগ-ক্ষোভ প্রফেসর ইউনূসের ওপর। সম্ভব হলে তাকে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলতে চায়। রাজনীতি সত্যি খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস। সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। রাজনীতির প্যাঁচ বড়ই জটিল। শত্রু মুহূর্তে বন্ধু হয়ে যায়। যেমন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় বন্ধু এখন বিএনপি এবং সবচেয়ে বড় শত্রু অন্তর্বর্তী সরকার।

এখন নির্বাচন নিয়ে মন-কষাকষি চলছে। সরকার বলছে তারা অবশ্যই ২০২৬-এর জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবে। তারা ভালো সংস্কার করে নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু বিএনপি তা মানতে রাজি নয়। তারা সংস্কারও চায় আবার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। তা না হলে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে রেখেছে। এটা ঠিক যে অনির্বাচিত সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে নানা অঘটন ঘটতে পারে। তবে মানুষ যে কারণে আন্দোলন করেছে, তার যদি কিছুই না হয়, তাহলে সেই নির্বাচনের দরকার কী! নির্বাচনই সব সমস্যার সমাধান নয়। অনেকেই বলছেন, বিএনপি বড্ড বেশি তাড়াহুড়ো করছে। আবার কেউ কেউ প্রফেসর ইউনূসকে আরও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়াজ তুলছেন। বিএনপি হয়তো নিশ্চিত যে নির্বাচনে তারাই ক্ষমতায় যাবে। সে কারণেও তাড়াহুড়ো থাকতে পারে। তবে যদি ছাত্ররা আন্দোলন করে সরকারকে না হটাতো, তাহলে কিন্তু নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হতো। অন্তত আরও পাঁচ বছর। তাহলে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে কী এমন ক্ষতি হবে, তা বোধগম্য নয়। বিএনপির উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা। তবে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের কথা রাখবে বলেই আশা করা যায়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল স্পষ্ট করেই বলেছেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়। -টরন্টো, কানাডা

 

কমেন্ট বক্স