নিউইয়র্ক স্টেট থেকে বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখকে আনুষ্ঠানিকভাবে অফিশিয়ালি স্বীকৃতি দেওয়া হলো। আর এটি আমেরিকায় থেকেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য একটি বিশেষ পাওয়া এবং অনেক বড় অর্জন। এ কথাগুলোই বলছিলেন টাইম স্কয়ার ও জ্যাকসন হাইটসে এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের বর্ষবরণের আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শুভেচ্ছাদূত, অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ও সংগঠনের অন্য নেতারা। তারা জানান, নিউইয়র্ক স্টেট থেকে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখকে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আরও এক ধাপ অর্জন হলো প্রবাসী বাংলাদেশিদের। আমরা এ দেশে থেকেও বাংলাদেশকে সবার কাছে তুলে ধরতে পারছি। নিউইয়র্ক স্টেট এক্সেলশিয়র সিনেট ২০২৫-জে ২৩৪ হিসেবে নিউইয়র্কের সিনেটে ১৪ এপ্রিল ‘বাংলা নববর্ষ দিবস’ উদযাপনের প্রস্তাব পাস করে। এটি উত্থাপন করেন সিনেটর সিপুলভেদা, গভর্নর ক্যাথি হোকুল। ১৪ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে নিউইয়র্ক স্টেট এই দিনটিকে বাংলা নিউইয়ার ডে হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে এখন থেকে এটি কেবল বাংলাদেশিদের অনুষ্ঠানের গণ্ডির মধ্যেই থাকছে না, এটি পৌঁছে গেল নিউইয়র্ক স্টেটের সিনেট, গভর্নরের সীমানাতেও। নিউইয়র্কের সিনেট ও গভর্নরের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি পাওয়ায় সবাই খুশি।
এদিকে বাংলাদেশে মহাসমারোহে, ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় উদ্্যাপিত হলো পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে নিউইয়র্কে বিশেষভাবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। একাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিসরে টাইম স্কয়ারে ও জ্যাকসন হাইটসে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড। তারা গত বছরও এবারের মতো বড় পরিসরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। বাংলাদেশের আদলে নাচ, গান, মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। নারী-পুরুষের পাশাপাশি শিশুরাও তাদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে অংশ নেয়। প্রবাসে থেকেই শিশুরা অনেকেই নাচ, গান ও আবৃত্তি শিখছে। সেখানে তারা বাংলাদেশের গান এবং বাংলাদেশ থেকে প্রায় মুছে যাওয়া অনেক গানও তারা তুলে নিয়ে এসেছিল টাইম স্কয়ার ও জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায়। দুই দিনব্যাপী এই আয়োজন ছিল ১২ ও ১৩ এপ্রিল।
১২ এপ্রিল নিউইয়র্কের আকাশে ছিল মেঘ। ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এই বৃষ্টির মধ্যে পরিকল্পনামাফিক অনুষ্ঠান করতে পারবেন কি না এ নিয়ে আয়োজকদের কপালে ছিল চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু না, তাদের সেই চিন্তার ভাঁজ নিমেষেই মিলিয়ে গেল যখন হাজার মানুষ সমবেত হলো, গেয়ে উঠল ‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো’। ১২ এপ্রিল দুপুরে টাইম স্কয়ারে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উদ্্যাপিত হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২। সবাই স্বাগত জানিয়েছেন নতুন বছরকে। পুরোনোকে বিদায় জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে সবাই এসেছিলেন বর্ণিল সাজে। তারা টাইম স্কয়ারেই একটি মিনি বাংলাদেশ গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে বাঙালি পোশাকে সেজেছিলেন সবাই। এনআরবি ওয়ার্ল্ডের আয়োজনে প্রবাসীরা অংশগ্রহণ ছাড়াও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা শিল্পীরাও অংশ নেন।
টাইম স্কয়ারে ‘এসো হে বৈশাখ’ দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। একে একে পরিবেশিত হয় বাংলা গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সহস্্র কণ্ঠে শিল্পীরা সেখানে অংশ নেন। দিনভর সেখানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষেরা অংশ নেন। টাইমস স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রাও। বৃষ্টির মধ্যেও ছোট ছোট শিশুশিল্পীরা অনুষ্ঠানে আসে। তারা ওপেনটি বায়োস্কোপ গানটি পরিবেশন করে। এটি অসাধারণ পরিবেশনা ছিল বলে দর্শকরা মনে করছেন। নিউইয়র্ক স্টেট থেকে পহেলা বৈশাখকে স্বীকৃতি দেওয়ার অংশ হিসেবে নিউইয়র্কের গভর্নর হাউসে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়।
টাইম স্কয়ারের পাশাপাশি এনআরবি ওয়ার্ল্ডের আয়োজনে জ্যাকসন হাইটসেও বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপিত হয়েছে। ১৩ এপ্রিল দিনভর চলে অনুষ্ঠান। এবারের অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়। তিনি জ্যাকসন হাইটসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় নিউইয়র্কের এই ব্যতিক্রমী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেন। সেখানে তিনি এই আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে ধন্যবাদ জানান। পাশাপাশি যারা অংশ নিয়েছেন সেই সব শিল্পী ও তাদের বাবা-মায়েদেরও ধন্যবাদ জানান।
বিখ্যাত সংগীতশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন, আগামী দুই টার্মের পর হয়তো আমাদের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্য থেকে একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবেন। আমরা বাংলাদেশেকে মূলধারার সব পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছি। উত্তরোত্তর তা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, আপনারা যারা বাংলাদেশি, তারা বাসায় অবশ্যই সন্তানদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলবেন। তারা এ দেশে লেখাপড়া করে ও যেখানেই থাকে ও যায়, সেখানে ইংরেজিতে কথা বলে। কিন্তু তারা যাতে বাসায় অন্তত বাংলায় কথা বলতে পারে, সেই বিষয়টি আপনারা নিশ্চিত করবেন। সেই সঙ্গে তাদের কাছে বাংলাদেশি সংস্কৃতিকে তুলে ধরবেন। তিনি বলেন, আমরা যে এবার এত সুন্দর আয়োজন করতে পেরেছি, এটিও আমাদের আরও এক ধাপ সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। কারণ আমরা সবার কাছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পারছি। মূলধারায়ও এর গুরুত্ব বাড়ছে। এ কারণেই নিউইয়র্ক স্টেটের উদ্যোগেও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উদযাপিত হবে। এটি অবশ্যই বড় অর্জন। সবাই মিলে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পেরেছি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। অনুষ্ঠানে শুচ্ছেতাদূত ছিলেন লুৎফুন নাহার লতা। তিনিও এনআরবি ওয়ার্ল্ডকে এ ধরনের সুন্দর আয়োজন করার জন্য ধন্যবাদ জানান। সবাইকে জানান নববর্ষের শুভেচ্ছা। তিনি বলেন, টাইম স্কয়ারে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বড় সফলতা হলো এখন থেকেই নিউইয়র্ক স্টেটের উদ্যোগে বষর্বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এটি অবশ্যই একটি বড় অর্জন, কারণ এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আরও বেশি করে তুলে ধরতে পারব। তিনি বলেন, এ দেশে যেদিন এসেছিলাম, সেদিন কেবল দুটি স্যুটকেস নিয়ে দেশ থেকে এসেছিলাম। আর সব জিনিস ফেলে এসেছিলাম। তবে হৃদয়ে ধারণ করে নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশকে। সেই বাংলাদেশকে আমরা এক দিনের জন্যও ভুলিনি। এখানে এসেও আমরা নিজেদের কাজ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সংস্কৃতির চর্চা করে যাচ্ছি।
মুুক্তধারা ও এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের প্রেসিডেন্ট বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বর্ষবরণের এই অনুষ্ঠানে আপনারা সবাই অংশ নিয়ে অনুষ্ঠানকে সফল করে তুলেছেন, এ জন্য ধন্যবাদ। টাইম স্কয়ারের অনুষ্ঠানেও বৃষ্টির মধ্যে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমাদেরকে আনন্দিত করেছে। তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠান সফল করার পেছনে যারা রয়েছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
এনআরবি ওয়ার্ল্ডের অনুষ্ঠানে দুই দিনই দুটি মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। একটি হয় টাইম স্কয়ারে, অপরটি হয় জ্যাকসন হাইটসে। নিউইয়র্ক টাইম স্কয়ারে সহস্র কণ্ঠে বিশ্ব বাঙালির ১৪৩২ বাংলা বর্ষবরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলা উপলক্ষে বাংলা বর্ষবরণ ১৪৩২ স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের উদ্যোগে এই স্মারকগ্রন্থে দেশ-বিদেশের অনেকেই লিখেছেন। এটি ছায়ানটের প্রধান ও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সন্্জীদা খাতুনের স্মরণে উৎসর্গ করা হয়।
নিউইয়র্ক টাইম স্কয়ারে সহস্র কণ্ঠে বিশ্ব বাঙালির ১৪৩২ বাংলা বর্ষবরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলা উদ্্যাপন কমিটিতে পরিকল্পনাকারী ছিলেন বিশ্বজিৎ সাহা, তোফাজ্জল লিটন, আহ্বায়ক রথীন্দ্রনাথ রায়, শুভেচ্ছাদূত লায়লা হাসান, লুৎফুন্নাহার লতা, সংগীত পরিচালক মহীতোষ তালুকদার তাপস, নৃত্য পরিচালক চন্দ্রা ব্যানার্জী, স্মারকগ্রন্থের প্রধান সম্পাদক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও নির্বাহী সম্পাদক ফারুক আহমেদ।
প্রধান সমন্বয়কারী শিবলী সাদেক, সমন্বয়কারী নিরুপম সাহা, সুপ্রিয়া চৌধুরী, আল্পনা গুহ, সুতিপা চৌধুরী, গীতালি হাওলাদার, ফারজিন রাকিবা, অর্থ কমিটি শশধর হাওলাদার, সুশীল সাহা, টিটু দে, ফণী ভূষণ রায়, প্রশাসন ব্যবস্থাপনা সৌম্যব্রত দাশগুপ্তা, মঞ্চ ব্যবস্থাপনা ড. কল্লোল বসু, ফটোগ্রাফার ধীরাজ সাহা, সংগঠক তাপস সাহা, দীপক দাস, কৃষ্ণ সরকার, কার্যকরী সদস্য মনিকা রায় চৌধুরী, আয়েশা চৌধুরী, সুমন আহমেদ, সবিতা দাস, ড. রুমা চৌধুরী, ক্রিস রুদ্র। মঞ্চসজ্জা পল্লব সরকার, জেমস রায়, বাপ্পি অধিকারী, ক্রিস্টেলা কুইয়া, দেবযানী মজমুদার, সহ-মহাব্যবস্থাপনা সাজু রহমান, রায়হান উদ্দন, কৃতজ্ঞতায় মিল্টন চৌধুরী, শাহ নেওয়াজ, রানো রেওয়াজ, নুরুল আমিন বাবু, মৃদুল পাঠক ও রায়হানুল ইসলাম চৌধুরী।