আগামী বছরের মার্চের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিকল্পনা নিয়ে সরকার অগ্রসর হচ্ছে। এ বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও ল। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য নিয়ে। রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক সমঝোতায় সম্মত সিদ্ধান্তে আসতে না পারা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার ঝুঁকি নেবে না। রাজনৈতিক দলসমূহ, সরকার, নির্বাচন কমিশন থেকে উল্লিখিত তথ্য পাওয়া যায়। পরস্পর বিপরীত অবস্থান থেকে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত এবং তাদের অনুসারীরা সরে না এলে সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়েই থাকবে। এমনকি তফসিল ঘোষণার পরও সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি হিংসাত্মক রূপ নিতে পারে। এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলাসমূহের তদন্তকাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এপ্রিল-মের মধ্যে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। আগামী মে-জুনের মধ্যে মামলার কার্যক্রম শুরু হবে। পরবর্তী পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে মামলার রায় হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ আশাবাদী। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনের বাইরে রাখাই মুখ্য উদ্দেশ্য। শীর্ষ নেত্রীকে আইনগতভাবে দণ্ডিত করতে পারলে নিচের সকল পর্যায়ের সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলার দলীয় নেতাদের কাছে যথাযথ সতর্কবার্তা পৌঁছে যাবে। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রত্যুত্তর পায়নি ভারত। আনুষ্ঠানিক জবাব দেওয়া না হলেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কথা হয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কূটনৈতিক সূত্রে যতদূর আভাস পাওয়া যায়, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে না ভারত।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধশত সাবেক এমপি, মন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয়, কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, অর্থ লুট, দুর্নীতির বড় ধরনের ঘটনার অভিযোগে মামলার তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন আগামী দুই মাসের মধ্যে দেওয়ার জোর চেষ্টা চলছে। আগামী সাত-আট মাসের মধ্যে আইনগত প্রক্রিয়া শেষে অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার অপেক্ষায় কর্তৃপক্ষ। রায়ে তারা যদি দণ্ডিতও হন, শেখ হাসিনা ও উল্লিখিতরা যে নির্বাচনে অযোগ্য হবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আইনগত বৈধতা অর্জন করতে পারেন। বিএনপি, জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধীরা তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে নানাভাবে চেষ্টা হয়তো করবে। তার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে। রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষ, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা হিংসাত্মক রূপ নিতে পারে, যা গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথেই নয়, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনিশ্চিতও করতে পারে।
এদিকে প্রধান রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী বিএনপি দ্রুত নির্বাচন ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উদ্্গ্রীব হয়ে আছে। নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করে বিএনপি তার সহযোগীদের নিয়ে রাজপথে নামবে। চলতি এপ্রিলের মধ্যেই তারা সুনির্দিষ্টভাবে রোডম্যাপ দাবি করেছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে বিএনপি ও তার অনুসারীরা সরকার পতনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠ উত্তপ্ত করবে।
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে প্রেস সচিব বলেছেন, নির্বাচনী রোডম্যাপ এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। ডিসেম্বর অথবা জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। পরে আরও পরিষ্কার করা হয়েছে ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে এবং কিছু জরুরি সংস্কার চাইলে আরও তিন মাস পর অর্থাৎ আগামী বছরের মার্চে জাতীয় নির্বাচন হবে। তবে তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। প্রেস সচিব স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিএনপি যেভাবে এখনই নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করতে বলছে, তা সম্ভব নয়। অপরদিকে অপর অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচন বিলম্বিত করার পক্ষে নয়। তবে তারা তাদের প্রধান সহযোগী বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নবগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সংগঠিত করার সুযোগ দিতে চায়। তাদের সঙ্গে নিয়ে বা তাদের সঙ্গে সমঝোতায় থেকে আগামী সংসদ নির্বাচন করার পক্ষে তারা। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ-উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারেনি। তরুণ শিক্ষার্থীদের দলকে রাজনৈতিক দর্শনহীন বলে চিহ্নিত করেছে বিএনপি। তবে আগামীতে নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা ব্যতিক্রম কিছু দেখাতে পারবে নাÑএমনটি মনে করারও কারণ নেই। এখন পর্যন্ত তারা উল্লেখযোগ্য আশার সঞ্চার করতে পারেনি। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী তরুণদের কিছু অংশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, দখলবাজির ঘটনাও ঘটছে, যা মানুষকে দারুণভাবে আশাহত করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক, সংগঠক পর্যায়ের নেতাদের কারও কারও মধ্যে আত্মসমালোচনামূলক আচরণও পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা অভিভাবক, সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশারও জন্ম দিচ্ছে। দীর্ঘ ঘাত-প্রতিঘাতের পরও তাদের অনেকের মধ্যেই পরিবর্তনের ধারা দেখতে না পাওয়াটা গভীর বেদনাদায়ক ও উদ্বেগজনক। লাগাতার সংগ্রাম দুর্ভোগ দিয়েছে দেশের মানুষকে। বিরোধীপক্ষীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা নিগৃহীত হয়েছেন। কিন্তু দিন শেষে দুভার্গ্যজনকভাবে প্রবহমান গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারার বাইরে কিছু হচ্ছে না।