বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ৩১ মার্চ। সবাইকে ঈদ মোবারক। স্বাধীনতার মাসের শেষ এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যরকম একটি আনন্দঘন মূহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকবে। কোনো প্রকার নৈরাজ্য-চাঁদাবাজি শিকার না হয়েই নির্বিঘ্নে মানুষ ঘরে ফিরতে পেরেছেন। মুক্ত পরিবেশে ধনী-গরীবসহ সর্বস্তরের মানুষ ঈদ-আনন্দের খুশি উপভোগ করছেন। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ-আনন্দের মধুর সময় কাটাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও। অন্যদিকে শেখ হাসিনার অঘোষিত আদালত থেকে বন্দি খালেদা জিয়া মুক্ত হলেও ফ্যাসিস্ট তকমায় ভূষিত শেখ হাসিনার এবারের ঈদ-আনন্দ মাটিতে মিশে গেছে। তছনছ হয়ে গেছে তার সাজানো গোছানো মসনদ। তিনি এখন পরিবার-পরিজন এবং নেতাকর্মী ছাড়া দেশহীন অভাগা এক ব্যর্থ নেত্রী। রাজনৈতিক দলের বাইরে নতুন শাসনব্যবস্থায় শেখ হাসিনার এ অধপতনের মূল কারণ। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন, বেগম খালেদা জিয়াসহ অন্যদের জন্য এবারের ঈদ-আনন্দ যেন নতুন যুগের সূচনা করেছে। তেমনি, রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নিয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা ও তার কর্মী-সমর্থক ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মী, সমর্থক ও দেশের মানুষ দীর্ঘ ১৫ বছরের দুঃশাসনমুক্ত পরিবেশে এবারের ঈদ-আনন্দের খুশিতে ভাসছেন।
বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার একক কায়েমী শাসনব্যবস্থায় বন্দিদশা থেকে মুক্তি হয়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ অসংখ্য রাজবন্দি নতুন জীবনে ফিরেছেন। গুমঘর, আয়নাঘর এবং বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে অনেকে তাদের প্রিয় পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করছেন। একে অপরকে ঈদ শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা বিনিময়ে নতুনভাবে রাঙিয়ে তুলছেন। এক যুগেরও বেশি সময় পর স্বস্তিতে ঈদ উদযাপন করতে পেরেছেন বিএনপিসহ ভিন্ন মতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। কারণ- আওয়ামী লীগ শাসন আমলে কখনও হামলা বা মামলার ভয়ে বাড়ি-ঘর ছাড়া, আবার কখনও কারাগারেই করতে হয়েছিল তাদের ঈদ। বিশেষ করে, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও এ বছর ‘এক রুমে বন্দি’ অবস্থায় ঈদ উদযাপন করতে হয়নি। দীর্ঘ সাত বছর পর পুরোপুরি মুক্ত পরিবেশে লন্ডনে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া। ঈদ উদযাপন শেষে দেশবাসীসহ দলীয় নেতাকর্মীদের পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত ৩০ মার্চ খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে দেশবাসীকে শুভেচ্ছার তথ্য জানান। ডা. জাহিদ বলেন, ম্যাডাম লন্ডনে উনার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান সাহেবের বাসায় আছেন। ঈদের দিনটি উনি বাসায় আপনজনদের নিয়ে একান্তে কাটাচ্ছেন।
অন্যদিকে গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান পাশের দেশ ভারতে। নেত্রীর এই আকস্মিক পলায়নে দলের নেতাকর্মীরাও জীবন বাঁচাতে আত্মগোপনে থেকে ফেরারি জীবনযাপন করছেন। দেশের মাটিতে মুক্ত পরিবেশে ঈদ-আনন্দহীন এক বিষাদময় জীবনযাপন করছেন শেখ হাসিনাসহ তার নেতাকর্মীরা। মামলা, হামলা আর গ্রেপ্তার আতঙ্কের ভয়ে দিশেহারা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে কর্মী-সমর্থক সবাই। শেখ হাসিনা তার পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ায় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আরও বেশি হতাশার জন্ম দিয়েছে। কেউ মুখ খুলে কিছু বলতে পারছে না। দলের অনেক শীর্ষ নেতা ইতোমধ্যে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। নেতাকর্মীদের এই কঠিন পরিস্থিতিতে পাশে নেই কেউ। পুরোপুরি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে দলটি। দেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যালয়গুলো অস্তিত্বহীন এবং অনেক ক্ষেত্রে গণশৌচাগারে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের তীর্থস্থান শেখ মুজিবুর রহমানের অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত সেই ‘ধানমন্ডি ৩২’ নম্বর বাড়িটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই পতিত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের। এর মধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে দলটির বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। এবার ফ্যাসিজমের কারখানা খ্যাত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তুলছে জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া নেতারা। তাদের দাবি, জুলাই গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দ্রুত বিচার এবং রাজনৈতিকভাবে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
জুলাই গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ বহু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব মামলার রায় হয়ে যেতে পারে এবং নেতৃত্বহীন আওয়ামী লীগের এমন একটি দুঃসহ্য পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার ঈদ-আনন্দ ম্লান হওয়া বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞগণ। তাছাড়া আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার অবস্থানও স্পষ্ট নয়- তিনি ভারতে কোথায় কীভাবে আছেন। যদিও মাঝে মধ্যে অদৃশ্য ভিডিও ক্লিপে শেখ হাসিনা দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে আসছেন তিনি। ভিডিওতে বিষদ্গার করছেন বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তবে ঈদ উপলক্ষে তার দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে কোনো বার্তা দেননি শেখ হাসিনা। এতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে তিনি বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ হাসিনা। দেশের মানুষ তাদের স্বাদরে গ্রহণ করেছিল। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ঘোর অমানিশার অন্ধকার থেকে দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে দেশ শাসনের সুযোগ আসে তার হাতে। তবে সর্বশেষ টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে হয়ে উঠেন একজন স্বৈশাসক। গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার এই ফ্যাসিজমের পতন ঘটেছে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জুলাই বিপ্লবীরা।