আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন ইস্যু, বিচার ও নিষিদ্ধের ইস্যু নিয়ে গত তিন দিন ধরেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই জোরালো হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধকরণের দাবি। অন্তর্বর্তী সরকারের আপাতত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পরিকল্পনা নেই প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর থেকেই উত্তপ্ত হওয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘি ঢেলেছিল, আওয়ামী লীগের পুবর্বাসনের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে অভিযোগ তুলে জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লহার পোস্ট। এবার তা রাজনৈতিক অঙ্গনেও অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সাধারণ ছাত্র-জনতার মধ্যে বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। তবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান অনেকটায় বিভক্ত। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নিয়ে সরাসরি এখনও বক্তব্য দেয়নি বিএনপি ও জামায়াত। এরআগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিপক্ষে মত দিয়েছিলো দলটির নেতারা। আর জামায়াত আমির ড. শফিকুর রহমান ইতকাফে বসায় তার কোনো মন্তব্য জানা যায়নি। দলটির পক্ষ থেকেও অবস্থান পরিষ্কার করা হয়নি। দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি এখনই কোনো কমেন্ট করব না। দয়া করে ওদিকে ডাইভার্ট করবেন না। থ্যাংক ইউ।
আওয়ামী লীগকে ভোটে আনা নিয়ে চলমান সাম্প্রতিক আলোচনা প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, রাজনীতিতে আবার ফেরার জন্য আওয়ামী লীগ নিজে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা কেউ কেউ, যাঁরা খুব গুরুত্বপূর্ণ লোকজন, ঝগড়া করে ফোকাস করে তাদের সবার সামনে নিয়ে আসছি। (দেশে) গণতান্ত্রিক পথ থাকতে হবে এবং একই সঙ্গে তাদের (আওয়ামী লীগের) বিচার হতে হবে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করছি না। এটা রাজনৈতিক প্রস্তাব। তবে সরকার ও সরকারপ্রধান জনগণকে আহ্বান জানাবেন, সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে।
এদিকে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবির মধ্যেই নতুন নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার এবং দলটির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে তিনি সেখানে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না আওয়ামী লীগ। এদিকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে জুলাই আন্দোলনে আহতদের সংগঠন ‘ওয়ারিয়র্স অব জুলাই’, তা না হলে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে তারা। আ.লীগের বিচার দাবিতে শাহবাগ অবরোধ করেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা, এছাড়াও চট্টগ্রামে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিকে, সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনগণকে দাঁড় করানো যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এদিকে আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতেও আওয়ামী লীগকে আসতে দেওয়া হবে না বলে সমাবেশে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন। দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসঅনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, নেক্সট বাংলাদেশ উইদাউট আ.লীগ।
আওয়ামী লীগকে পুনবার্সনের চেষ্টা করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে, বাংলাদেশে আরেকটি ১/১১ হতে দেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল রাজধানীর বকশিবাজারে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির লালবাগ জোনের ইফতারে তিনি একথা বলেন। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আরেকটি ১/১১ হতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, এদেশে কোনো বিরাজনীতিকরণ হতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান নয় দলীয়করণে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হওয়ায় এর আগেও সামরিক শাসন জারি হয়েছিল, যা কাম্য নয়। জনগণ রাষ্ট্রের মালিক, তাদের রাষ্ট্রের মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে।
এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনাদের কাজ ক্যান্টনমেন্টে, আপনারা ক্যান্টনমেন্টে থাকুন। আপনাদের আমরা সম্মান জানাই। গত ১৬ বছর জাতীয় রাজনীতিতে যেভাবে নোংরা হস্তক্ষেপ করেছেন, ২৪-পরবর্তী বাংলাদেশে তা আর করতে দেওয়া হবে না। ২২ মার্চ (শনিবার) বিকালে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপি-ঢাকা মহানগর আয়োজিত সমাবেশে একথা বলেন তিনি।
সমাবেশে সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, বিগত ১৬ বছরে এতগুলো ডামি নির্বাচন হলো, আপনাদের ইনক্লুসিভিটি কোথায় ছিল? এত বছর কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে সেনাবাহিনীর কোনো একটি জেনারেলকে দেখিনি পদত্যাগ করতে। এত গুম-খুন, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন চলেছে, আপনারা প্রতিবাদ করেননি। এখন আমরা একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রত্যাশায় আছি। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা একটি সুষ্ঠু পরিবেশে ফিরে যেতে চাই। আপনারা এতে হস্তক্ষেপ করবেন না।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনী যদি জনগণের পাশে এসে না দাঁড়াত তাহলে দেশে একটি গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতো বলে মন্তব্য করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, কিছু বুদ্ধিজীবী কৌশলে গণঅভ্যুত্থানে সেনা কর্মকর্তাদের অবদান অস্বীকার করে বিভাজন তৈরি করতে চায়। এতে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণে সবাইকে এই বিষয়ে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে, কোনোভাবেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনগণকে দাঁড় করানো যাবে না বলে আহ্বান করেছেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। শুক্রবার রাতে ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্টে তিনি লেখেন, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজাতে আমরা গত কয়েকমাস কাজ করেছি। খুবই জটিল প্রক্রিয়া ছিল সব প্রতিষ্ঠানে আস্থা ও সক্রিয়তা ফেরত আনা। শক্তিশালী, জবাবদিহিমূলক এবং কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া আমরা এগুতে পারবো না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুড পারফরম্যান্সের ভিত্তি হলো পুনর্গঠিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার অপরাধীদের শাস্তি, পদচ্যুতি ও বিচারের আওতায় এনেছে। তদন্ত সাপেক্ষে অন্যদেরও আনা হবে। এছাড়া সব প্রতিষ্ঠানকেই নিজেদের হাত পরিষ্কার করতে হবে। কিন্তু, কোনভাবেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনগণকে দাঁড় করানো যাবে না।
এদিকে, গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার এবং দলটির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত। সেখানে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে দলের নেতৃত্বে শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ নেই বলেও জোর গলায় জানান তিনি। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবির প্রসঙ্গে মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘বাংলাদেশে এমন কোনো শক্তি নেই যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এ দেশের জন্ম দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ দেশের কোনায় কোনায় আওয়ামী লীগের অবস্থান। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো শক্তি নেই বাংলাদেশে। বাংলাদেশে রাজাকার, পাকিস্তানি ও পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা নিষিদ্ধ হবে; আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে না। যে দেশ জন্ম দেয়, তাকে নিষিদ্ধ করা যায় না। তার দাবি, ইউনূস ও তার সহযোগীরা যেভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আচরণ করছেন, তাতে তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়।
ঠিকানা/এসআর