মোটাদাগে কূটনীতি বা ডিপ্লোম্যাসি বলতে দর-কষাকষি ও সংলাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক গড়া ও নিজস্ব স্বার্থকে সমুন্নত করার বিষয়কে বোঝায়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের বৃহত্তম (জনসংখ্যার বিচারে) গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুসৃত কূটনীতি কতটা সফল ও কার্যকর (Effective) হচ্ছে, তা নিয়ে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন মহলে বিশেষভাবে আলোচনা-সমালোচনা হতে দেখা যায়।
গত বছরের ডিসেম্বর এবং পরে এ বছরের জানুয়ারিতে দু-দফায় বেশ লম্বা সফরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। সূত্রমতে, তার এই সফরের লক্ষ্য ছিল মূলত ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ট্রাম্পের কাছ থেকে মোদির জন্য আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করা, যা করতে তিনি ব্যর্থ হন। এভাবে উপাচার্য হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহের চেষ্টা কতটা সম্মানের ও মর্যাদাপূর্ণ পদক্ষেপ, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুই দফায় ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থান করে ট্রাম্পসহ আরও কয়েকজন মার্কিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে জয়শংকর সাক্ষাতে সক্ষম হলেও তা ছিল নেহাত সৌজন্যমূলক ও ফটোশপের মধ্যে সীমিত।
ভারত তথা মোদির কূটনৈতিক তৎপরতার এখনকার মূল কেন্দ্রবিন্দু (Focal Point) হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, যদিও এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য কোনো দেশের তেমন কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। এটা এ জন্য যে, বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয়দের যে বয়ান (Narrative), তার যে কোনো ভিত্তি নেই, সেটা সেসব দেশের নেতাদের অজানা নেই। বাংলাদেশের নেতা নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূস সম্পর্কে কোনো ‘গিবত’ তারা শুনতে মোটেই ইচ্ছুক নন।
ভারতীয়রা বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের যে তথ্য উপস্থাপন করতে চায়, তা যে অতিরঞ্জিত ও সারবত্তাহীন, সে সম্পর্কে বিদেশি নেতারা সম্যক ওয়াকিবহাল।
বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশের দূতাবাস ঢাকায় রয়েছে। এসব দেশের রাষ্ট্রদূতগণ বাংলাদেশ নিয়ে নিজ নিজ দেশে প্রতিনিয়ত যেসব বার্তা পাঠান, তাতে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোনো উল্লেখ থাকে না, বরং তাতে থাকে ড. ইউনূসের দুর্নীতিমুক্ত বিনিয়োগবান্ধব, মানুষের মৌলিক অধিকারসহ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিত এবং গণতন্ত্রের উত্তরণে তৎপরতা ও প্রত্যয়ের কথা। নিকট অতীতে ড. ইউনূসের বিদেশ সফরে তার প্রতি বিশ্বনেতাদের সপ্রশংস দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার ডাকে সাড়া দিয়ে দিল্লিতে অবস্থানকারী ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহুসংখ্যক প্রতিনিধির একযোগে ঢাকায় এসে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনায় তার প্রমাণ মেলে।
অপরদিকে মোদিসহ কিছু ভারতীয় নেতার (জয়শংকর, অজিত দোভাল প্রমুখ) চিন্তা-চেতনাজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশকে কীভাবে বিদেশিদের কাছে হেয় করে ভারতের নতজানু করা যায়, সে বিষয়। বিদেশি রাষ্ট্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির অলীক বন্ধুত্বের ঢাকঢোল পিটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত করে বাংলাদেশকে চাপে রাখাই ভারতীয় এহেন কৌশলের লক্ষ্য, যা ইতিমধ্যেই বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটনে এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তিনি ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা নালিশ তুলে ধরতে প্রয়াসী হন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারকে একটি গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে সেই সরকারের পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ববর্তী প্রশাসনের কিছু নেতার (বাইডেন, ক্লিনটন, ওবামা) মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। মোদি হাসিনার গুণকীর্তন করে ড. ইউনূস সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট ব্যাখ্যা তুলে ধরার অপচেষ্টা চালান। ট্রাম্প মোদিকে থামিয়ে দিয়ে সাফ জানিয়ে দেন, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনে তার দেশের কোনো হাত ছিল না। ট্রাম্পের মুখে এ কথা শুনে মোদি হতভম্ব হয়ে যান, যা দেখে সোজা মুখ ভোঁতা হয়ে যাওয়ার কথাটি মনে পড়ে যায়। কেউ কেউ ট্রাম্পের বক্তব্যকে মোদির জন্য চপেটাঘাত হিসেবে বর্ণনা করেন।
ভারতের কিছু নেতা ও মিডিয়া মোদি-ট্রাম্প দোস্তি নিয়ে সর্বক্ষণ বড়াই করে থাকেন। এ বড়াই যে কতটা অসাড়, তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাদের মধ্যকার দোস্তি যদি এতটাই প্রগাঢ় হয়ে থাকে, তাহলে মোদি-ট্রাম্প বৈঠকের আগে-পরে যুক্তরাষ্ট্র অবৈধভাবে বসবাসকারী বহুসংখ্যক ভারতীয়কে হাতকড়া ও পায়ে শিকল পরিয়ে সামরিক বিমানে উঠিয়ে ভারতে নিয়ে নামিয়ে দেওয়া হতো না।
ট্রাম্প-মোদি বৈঠকে ট্রাম্প মোদির বাংলাদেশ নিয়ে কথাবার্তাকে পাত্তা না দিয়ে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান, সমরাস্ত্র বিক্রি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ইস্যুকে প্রাধান্য দেন, যেই প্যাকেজের মূল্য প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার যা ভারতের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। ট্রাম্পের সঙ্গে দোস্তি যে সহজলভ্য নয়, সেটা মোদি ইতিমধ্যেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছেন।
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা প্রতিটি দেশের কূটনীতির Corner stone হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রথাসিদ্ধ এই নীতি থেকে ভারতের সরে আসা এবং প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বৈরী ও যুদ্ধংদেহী আচরণের ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে ভারতের ডিপ্লোম্যাসির দেউলিয়াত্ব আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে বলে বিদগ্ধ মহল মনে করেন।
লেখক : কলামিস্ট