সারা দিন রোজা রাখা, শরীরের ওপর অনেক ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যখন দীর্ঘ সময় কিছুই খাওয়া হয় না।
তবে সঠিক খাবার নির্বাচনে শরীরের বিপাক ব্যবস্থা বা হজম ভালো রাখতে সহায়তা করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আঁশ সমৃদ্ধ খাবার শরীরের হজম ব্যবস্থাকে ভালো রাখে এবং পুরো মাস ধরেই শরীর সুস্থ রাখতে সহায়ক হয়।
আঁশের উপকারিতা
আঁশ গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান, যা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে শুধুমাত্র উদ্ভিদভিত্তিক খাবারে পাওয়া যায়। আঁশ শরীরের হজম ব্যবস্থাকে সুস্থ রাখে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে এবং রক্তের শর্করা এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
রোজা রেখে বা যখন একটানা অনেকক্ষণ খাওয়া হয় না, তখন আঁশ সমৃদ্ধ খাবারগুলো বিপাক বা হজমের জন্য খুবই উপকারী হতে পারে।
আঁশ দুই ধরনের হয় একটি দ্রাব্য অন্যটি অদ্রাব্য।
দ্রাব্য আঁশ শরীরের পানি শোষণ করে এবং মলে এক ধরনের জেলির মতো স্তুপ সৃষ্টি করে, যা হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে এবং ডায়রিয়া কমাতে সাহায্য করে।
অপরদিকে, অদ্রাব্য আঁশ পানির সাথে মেশে না এবং এটি মলের আকার বাড়িয়ে দেয়, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক।
আঁশ সমৃদ্ধ খাদ্যের উপকারিতা
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের সাবেক প্রধান পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো বলেন, “দীর্ঘ সময় রোজা রাখার পর শরীরের জন্য সঠিক পুষ্টি গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। আঁশ সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- চিয়া বীজ, পেঁপে, ছোলা এবং মিষ্টি আলু বিপাকের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে এবং শরীরের সুষম পুষ্টি সরবরাহ করতে সক্ষম।”
এই ধরনের খাবারগুলো রমজান মাসে শরীরের ক্ষুধা মেটাতে সাহায্য করে, দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার পরও সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
তাই রমজান মাসে খাবার নির্বাচন করার সময় আঁশ সমৃদ্ধ খাবারগুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে; যা হজম ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সহায়ক। রমজানে যে খাবারগুলো খাওয়া উচিত তা নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন পার্সোনা হেল্থ’য়ের পুষ্টিবিদ শওকত আরা।
চিয়া বীজ
ছোট হলেও চিয়া বীজ বেশ শক্তিশালী একটি খাবার। এটি আঁশ, ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের মতো অপরিহার্য খনিজ উপাদানে পূর্ণ। মাত্র দুই টেবিল চামচ চিয়া সিডসে রয়েছে ১০ গ্রামের মতো আঁশ।
এছাড়া এই বীজে থাকা অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও আঁশের মতো একই ভাবে উপকারী।চিয়া বীজে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থের জন্য খুবই উপকারী। ইফতারের সময়ে দইয়ের সঙ্গে, ফলের সালাদে, স্মুদিতে চিয়া বীজ মিশিয়ে খাওয়া যায়। বা ‘আঁশ-প্যাকড পুডিং’ও তৈরি করা যায় ইফতারে।
বেদানা
এই ফল শুধু সুস্বাদু নয়, আঁশের জন্য এক শক্তিশালী উৎস। এক কাপ বেদানায় প্রায় সাত গ্রাম জটিল কার্বোহাইড্রেইটস থাকে।
লাল বেদানায় আরও রয়েছে ‘অ্যান্থোসায়ানিন’ যা একটি একটি উদ্ভিজ্জ যৌগ। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করা এই উপাদান ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং চোখের রোগের ঝুঁকি কমায়।
ইফতারে সালাদের মধ্যে বেদানা দিয়ে একটি রেসিপি আজই কিন্তু তৈরি করে নিতে পারেন। আবার চাইলে ইফতারের পর ও সেহেরি পর্যন্ত অল্প অল্প করে খাওয়া যেতে পারে বেদানারর রস।
ছোলা
ইফতারে ছোলা খুব পরিচিত একটি খাবার। আর এর প্রকারও নানান রকম। তবে সালাদ বা স্ট্যুতে হলদে ছোলা যোগ করে বা হালকা লবণ এবং অলিভ অয়েল দিয়ে রোস্ট করে ইফতারে খাওয়া যায়।
আঁশের একটি দুর্দান্ত উৎস এই ছোলা। এক কাপ রান্না করা হলদে ছোলায় প্রায় ১৩ গ্রাম আঁশ থাকে। এই ডালগুলোর পুষ্টিগুণ কেবল আঁশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এতে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, কপার, লৌহ, জিঙ্ক, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, পটাসিয়াম, থায়ামিন, বি-সিক্স এবং ফোলেইট’য়ের মতো ভিটামিন বি।
এই পুষ্টি উপাদানগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, হাড়, হৃদযন্ত্র এবং বিপাকীয় স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে।
রাস্প বেরি
দেশীয় ফল না হলেও বেরি আঁশের জন্য একটি অসাধারণ উৎস। তবে বর্তমানে বেরি খুব সহজেই পাওয়া যায় সুপারশপগুলোতে। মূলত মিষ্টি খাবার, দই বা ফলের সালাদের মধ্যে রাস্প বেরি দিয়ে খাওয়া যায়। চাইলে জুসও করা যায়।
প্রতি কাপ রাস্পবেরিতে আট গ্রাম আঁশ মিলবে। পাশাপাশি প্রচুর ভিটামিন সি এবং পলিফেনলস রয়েছে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
দইয়ের মধ্যে যোগ করে, স্মুদিতে, কেক, পুডিংয়ে রাস্প বেরি রাখা যেতে পারে।
খেজুর
গ্যাস্ট্রিকের জন্য খুবই উপকারী খেজুর। আঁশ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, পটাশিয়াম এবং ভিটামিন কে’র মতো পুষ্টির উৎস খেজুর।
ইফতারের টেবিলে খেজুর পরিচিত খাবার, যা হাড় ও হজমের জন্য ভালো।
প্রতি কাপে ১২ গ্রাম আঁশ থাকে। তবে একবারে অনেকগুলো খেজুর খাওয়া ভালো নয়। এতে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
তাই স্মুদি তৈরি করতে তাতে দুটি খেজুর দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টির স্বাদ উপভোগ করা যেতে পারে।
মিষ্টি আলু
ভিটামিন এ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসের উৎস। এগুলো রক্তের চিনির পরিমাণ স্থিতিশীল রাখতে, হজমের উন্নতি করতে এবং প্রাকৃতিক শক্তির উৎস সরবরাহ করতে সাহায্য করে।
একটি বড় মিষ্টি আলুতে প্রায় ছয় গ্রাম আঁশ থাকে। এই আলু রোস্ট করে হালকা মসলা মাখিয়ে বা সালাদের মতো খাওয়া যায়। আবার সিদ্ধ করেও খেতে বেশ লাগে।
যব
খুব বেশি খাওয়া না হলেও অর্ধেক কাপ কাঁচা যবে পাওয়া যায় ১৭ গ্রাম আঁশ। পাশাপাশি মিলবে লৌহ, পটাসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম এবং বি ভিটামিন। যা গ্যাস্ট্রিক, রো প্রতিরোধ শক্তি, হৃদযন্ত্র এবং হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
স্যুপ বা স্ট্যুতে দিয়ে খাওয়া যায় এই আঁশ সমৃদ্ধ খাবার।
পেঁপে
পেটের বন্ধু হিসেবে কাজ করে পেঁপে। এতে রয়েছে প্রচুর আঁশ যা হজমে সহায়তা করে এবং শরীরের বিপাকের জন্য ভালো।
পেঁপে খেলে খাবারের পরিপূর্ণতা আসবে এবং রোজা রেখে ক্ষুধা অনুভব কম হয়। এটি হজমে সহায়ক এনজাইম পাপাইন প্রদান করে।
সূর্যমুখীর বীজ
বাদাম ও অন্যান্য বীজের মতো সানফ্লাওয়ার বা সূর্যমুখীর বীজেও প্রচুর আঁশ থাকে। প্রতি এক কাপ থেকে মিলবে ১২ গ্রাম আঁশ।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বিপাক, শক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি ভিটামিন ই, জিঙ্ক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম এবং বি ভিটামিন পাওয়া যায় এই বীজ থেকে।
সবুজ মটর
সবুজ মটরকে অনেক সময় ‘স্টার্চ’যুক্ত সবজি হিসেবে উপেক্ষা করা হয়। তবে এক কাপ সবুজ মটরে প্রায় ৭ গ্রাম আঁশ থাকে। এছাড়া ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন সি, কে, বি রয়েছে- যা রক্তের স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং বিপাকের জন্য ভালো।
পাস্তা, স্ট্যু, স্যুপ, মাংস, মাছ, নুডুলসসহ ভাত-ধর্মী খাবারে যোগ করে খাওয়া যায় সবুজ মটর।
ঠিকানা/এসআর