উত্তর আমেরিকা প্রবাসী সাওম পালনকারী মুসলমানদের জীবন থেকে কমপক্ষে এক বছরের জন্য পবিত্র মাহে রমজানের রহমতের অধ্যায় বিদায় নিয়েছে ১০ মার্চ সোমবার এবং মাগফিরাতের অধ্যায় সূচিত হয়েছে ১১ মার্চ মঙ্গলবার। মাগফিরাতের অধ্যায়ের ওপর আলোকপাতের পূর্বে সাওম ও সালাতের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যের ওপর আলোকপাত অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও বাস্তবতার পটভূমিতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। প্রকৃত প্রস্তাবে সালাত হচ্ছে করণীয় বা ডুইং ইবাদত। তাই সালাত আদায়ের পূর্বে শরীর পাকের জন্য গোসল-অজু সম্পন্ন করতে হয়, পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় পরিধান করতে হয় ইত্যাদি। পক্ষান্তরে সাওম হচ্ছে বর্জনীয় বা রিফ্রেইনিং বা অ্যাবস্টেনিং ইবাদত। তাই সাওম পালনকারীকে সুবহে সাদিকের পূর্ব মুহূর্ত থেকে পরদিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, বৈধ স্ত্রীসম্ভোগ, চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড, পরচর্চা বা গিবত, পরশ্রীকাতরতা, অন্যের কুৎসা রটনা, পাশবিক প্রবৃত্তির যাবতীয় কামনা-বাসনা সর্বাংশে বর্জন করতে হয়। অন্যথায় সাওম নিছক উপবাসের পর্যায়ে পড়ে।
অনস্বীকার্য যে আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং আদি জননী হাওয়া (আ.) চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে আল্লাহর নির্দেশ অমান্যের মাধ্যমেই মাগফিরাতের প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। পবিত্র কোরআনের প্রথম অধ্যায়ের সুরা বাকারার ৩০ থেকে ৩৫ নং আয়াতগুলোতে বর্ণনা অনুসারে আগুনের তৈরি শয়তান আল্লাহর আদেশ সরাসরি অমান্য করল এবং মাটির তৈরি আদমকে সেজদা না করে অভিশপ্ত হলো। পরবর্তী সময়ে প্রতিশোধপরায়ণ শয়তান ছলে-বলে-কৌশলে আদম ও হাওয়াকে বিপথগামী ও প্ররোচিত করতে সক্ষম হয়েছিল। শয়তানের প্ররোচনাতেই আদম ও হাওয়া নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে আল্লাহর আদেশ অমান্যের দায়ে অভিযুক্ত হলেন এবং তাদের দেহাবয়ব থেকে বেহেশতি লেবাস খসে পড়ল, পরস্পরের গোপনীয় অঙ্গ উন্মুক্ত হয়ে গেল, তারা গাছের পাতা-লতার সাহায্যে লজ্জা নিবারণ করলেন। অভিযুক্ত আদম ও হাওয়া তওবা-ইস্তেগফারসহ আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি শুরু করলেন এবং আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অছিলায় পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁদের তওবা কবুল করার পর বেহেশতে বসবাসের সুযোগবঞ্চিত হলেন। আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) কে মাশরিক ও মাগরিবে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে স্বর্গচ্যুত আদম দম্পতি অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে নিজেদের কৃত অপরাধের জন্য নির্জন বেলাভূমিতে একাধারে কয়েক শ বছর কান্নাকাটি করলেন। অবশেষে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অছিলায় দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আদম দম্পতির অপরাধ মার্জনা করলেন। আর আদম (আ.) নবুয়তি ফেরত পেলেন এবং সুদীর্ঘ বিরহ-বিচ্ছেদের পর আরাফার ময়দানে তাঁরা পুনর্মিলিত হলেন। পক্ষান্তরে আল্লাহর আদেশ অমান্যের পর অহংকারী শয়তান ক্ষমা প্রদর্শনের পরিবর্তে ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিয়ে চির অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়েছে।
আদম দম্পতির মাগফিরাত বা ক্ষমালাভের ঘটনা বস্তুত পাপসাগরে ডুবন্তপ্রায় বিশ্ব মুসলিমের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। স্বার্থের হাতছানি ও মায়ামরীচিকায় টইটম্বুর এই বিশ্বচরাচরে মুসলমানরা বর্তমানে পাপের সাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। পাপের পাহাড় মাথায় নিয়ে আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই পরকালীন আজাব ও গজব থেকে মুক্তি কামনা করি। কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে পাপের রাহুবন্ধন ছিন্ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। মাহে রমজানের সাওম আমাদের জন্য সেই অসাধ্য সাধনের পথকে সুগম করে দেয়। সাওমের অপরিহার্য নিষেধাজ্ঞাগুলো কায়মনোবাক্যে পালন করা হলে নিজেদের রাশি রাশি পাপাচারের দায় থেকে মাগফিরাত লাভের প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।
মাগফিরাত প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের কয়েকটি সুস্পষ্ট ঘোষণার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি : সুরা হাশরের একটি আয়াতে বলা হয়েছে-ইন্নাল্লাহা শাদীদুল ইক্বাব (আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর)। আর সুরা মায়েদার একটি আয়াতে আল্লাহ বলেছেন : ওয়াল্লাহু আজিজুন জুনতিকাম (আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী প্রতিশোধগ্রহণকারী)। আবার পবিত্র কোরআনের অন্যত্র জাহান্নামকে বসবাসের জন্য অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরা ও আয়াতে আল্লাহর অপরিসীম রহমতের পাশাপাশি কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারিও উচ্চারিত হয়েছে। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, আল কোরআনে গিবত বা পরচর্চাকে জেনা বা ব্যভিচারের চেয়ে এবং ফিতনা বা সংঘাতকে কাতেল বা হত্যার চেয়েও ভয়াবহ পাপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলমানদের পারিবারিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে উভয় অপরাধই স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসেছে। পরচর্চা বা গিবত ছাড়া আমাদের ভুক্ত খাদ্য হজম হয় না আর ভ্রাতৃঘাতী নিত্য-নতুন সংঘাত-সংঘর্ষে মুসলিম বিশ্ব জর্জরিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মতানৈক্য নিত্য-নতুন ফিতনা বা বিভেদ সৃষ্টিতে জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে। তাই পবিত্র রমজানের মাগফিরাতের অধ্যায়ে আমরা এর সমূল উৎপাটন কামনা করছি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সাওম আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির পথ নির্দেশ করে। আত্মশুদ্ধির অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে যাবতীয় পাপ ও অন্যায় থেকে মুক্তিলাভের বজ্রকঠোর সংকল্প। অন্যের কাজে নাক না গলিয়ে নিজের কর্মকাণ্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পাপাচার থেকে নিজেকে ও স্বজনকে সুরক্ষার দুর্মর সিদ্ধান্ত। পবিত্র রমজানে অতিভোজনের স্থলে অন্যদের খাওয়ানোর তাগিদ রয়েছে। তাই সুস্বাদু ও মুখরোচক ইফতারি এবং বাহারি খাবারের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় না করে যথাসম্ভব সাশ্রয়ের মাধ্যমে সঞ্চিত অর্থে দুঃখীদের দুর্দশা লাঘব করতে হবে। বাকচাতুর্য বা মিথ্যার আশ্রয়ে প্রশংসা কুড়ানোর স্থলে সর্বদা মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। সদাসর্বদা আস্তাগফিরুল্লাহসহ বিভিন্ন তসবি তেলাওয়াত করতে হবে।
যাহোক, ইন্দ্রিয়ের তাড়নায়, চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে, ষড়রিপু ও শয়তানের প্ররোচনায় আমরা হরহামেশা পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছি। বর্তমানে অপরের সম্পদ লুণ্ঠনের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মানুষকে নরখেকো বাঘের মতো তাড়া করছে। মনুষ্যত্ববোধের নির্বাসন এবং দানবীয় শক্তির উত্থানের ফলে গোটা মুসলিম বিশ্ব পাপসাগরে নিমজ্জিতপ্রায়। পররাজ্য দখলের ঘৃণ্য প্রচেষ্টার ফলে বিশ্বজুড়ে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। অহর্নিশ রক্ত ঝরছে গাজা উপত্যকায়। বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিদের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার কেউ নেই গোটা বিশ্ব-সংসারে। জগৎজুড়ে ধনী-নির্ধনের ব্যবধান দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে মাৎস্যন্যায় অবস্থা বিরাজ করছে। যাহোক, পবিত্র কোরআনে পরম করুণাময় আল্লাহ বান্দার অপরাধ মার্জনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে এবং তওবা-ইস্তেগফারসহ আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আমরা বিশ্ববিধাতার মাগফিরাত প্রত্যাশা করতে পারি। কারণ আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকারকারী কাফের, আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারকারী এবং বান্দার হক আত্মসাৎকারী ছাড়া অন্য সকল অপরাধীকে ক্ষমা প্রদানের প্রতিশ্রুতি মহান বিশ্বপ্রতিপালক পবিত্র কোরআনে প্রদান করেছেন।
স্মর্তব্য, আমরা সর্বক্ষণ নিজেদের পোষ্যদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। অথচ যেসব বাবা-মা নিজেদের সর্বত্র উজাড় করে দিয়ে আমাদের মানুষ করেছেন এবং লোকান্তরিত হয়েছেন, তাদের কথা স্মরণ করার সুযোগ তেমন হয় না। নিকট ভবিষ্যতে আপনি এবং আমাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। তাই জীবদ্দশায় নিজ নিজ পরকালীন যাত্রাপথ সুগম করার অনুরোধ রইল। উপসংহারে, গোনাহর পাহাড় শিরোধার্য করে আমরা আল্লাহর মাগফিরাত লাভের প্রত্যাশায় পবিত্র রমজানের বাদবাকি সময় ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতে সক্রিয় থাকব। গিবত বা পরচর্চা, ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি সর্বাংশে বর্জন করব; ধৈর্য ধারণে সচেষ্ট হব; অন্যের প্রতি অহেতুক বিষোদ্গার কিংবা অপরের অমঙ্গল কামনা পরিহার করব এবং নিজেরা মুখরোচক খাবার গোগ্রাসে গেলার স্থলে রোজাদার ও ক্ষুধার্তদের আপ্যায়নে সক্রিয় হব। আহারে-বিহারে ও আচরণে যথাসাধ্য কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে সাশ্রয়কৃত অর্থে গরিব-দুঃখীর দুর্দশা লাঘবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব। হে রাব্বুল আলামিন, তুমি আমাদের প্রতি করুণা করো।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
 
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 মুহম্মদ শামসুল হক
 মুহম্মদ শামসুল হক  
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
