আল্লাহ তায়ালার অপার কৃপায় বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ বিশেষ ইবাদতের মধ্য দিয়ে পবিত্র মাহে রমজান অতিবাহিত করছে। আল্লাহ পাকের নেক বান্দারা তাদের ইবাদত-বন্দেগিতে এনেছেন আমূল পরিবর্তন। রাতগুলো জাগ্রত রাখছেন ইবাদতে রত থেকে। কেননা তারা জানেন, পবিত্র মাহে রমজানের রোজা ও ইবাদতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। আল্লাহ গোনাহ মাফ করে দেন।
হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াব লাভের আশায় রমজান মাসে সিয়াম পালন করবে, তার আগের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াব লাভের আশায় রমজানের রাত নামাজে দাঁড়িয়ে কাটাবে, তার আগের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদর ইবাদতে কাটাবে, তারও আগের সব গোনাহ ক্ষমা করা হবে। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)
রমজান এমন এক প্রিয় মাস, যে মাসের আগমনে ঊর্ধ্বলোকেও প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় এবং জান্নাত সুসজ্জিত করা হয়। হুজুর পাক (সা.) বলেন, ‘রমজানের শুভাগমন উপলক্ষে বছরজুড়ে জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয়। আর যখন রমজানের আগমন হয়, তখন জান্নাত বলে, হে খোদা! এ মাসে তুমি তোমার বিশেষ বান্দাদেরকে আমার জন্য মনোনীত করো।’ (বায়হাকি, সা’বুল ইমান)। মহানবী (সা.) অন্যত্র বলেন, রমজানের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখো, কেননা এটি আল্লাহ তায়ালার মাস, যা অতি বরকতমণ্ডিত এবং অতি উচ্চ পর্যায়ের। তিনি তোমাদের জন্য ওই এগারো মাস ছেড়ে দিয়েছেন, যে মাসগুলোতে তোমরা নিশ্চিন্তে পানাহার করে থাকো এবং সকল প্রকার স্বাদ আস্বাদন করে থাকো কিন্তু তিনি নিজের জন্য একটি মাস মনোনীত করেছেন।’ (মাজমাউয জাওয়ায়েদ)।
রমজানুল মোবারককে সাইয়্যেদুশ শুহুর অর্থাৎ সকল মাসের সরদারও বলা হয়েছে। এ মাস অগণিত বরকতের মাস। চৌদ্দশত বছর পূর্ব থেকে কোটি কোটি পুণ্যাত্মা এ মাস থেকে বরকতমণ্ডিত হয়ে এসেছে আর বর্তমানেও কোটি কোটি পবিত্রাত্মা এ মাস থেকে লাভবান হচ্ছে। এ দিনগুলোতে নিষ্ঠাবান রোজাদারদের দোয়া কবুলিয়তের মর্যাদা লাভ করে। তাদের প্রতি আধ্যাত্মিক রহমত বর্ষিত হয়।
রমজানের দিনগুলোতে মহানবী (সা.)-এর ইবাদত সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন : রমজানে তিনি (সা.) কোমর বেঁধে নিতেন এবং পূর্ণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা করতেন। মহানবী (সা.)-এর ইবাদতের অবস্থার বর্ণনা এভাবেও এসেছে, ‘রাতে ইবাদতের সময় তাঁর (সা.) বক্ষ আল্লাহ তায়ালার সমীপে কান্নাবনত হতো, হৃদয় বিগলিত হতো এবং বুকের মাঝে এমন কান্নার শব্দ শোনা যেত, যেভাবে হাঁড়িতে পানি টগবগ করলে শব্দ হয়।’ (শামায়েলে তিরমিজি)। রোজা পালনকারী রোজা এবং ইবাদতের কারণে আল্লাহ তায়ালাকে লাভ করে। খোদার সাক্ষাৎ এবং খোদার দিদার লাভ হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) বলেছেন : ‘তোমাদের খোদা বলেছেন, প্রতিটি নেকির প্রতিদান দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত আর রোজার ইবাদত বিশেষভাবে আমার জন্য আর আমি স্বয়ং তার প্রতিদান দেব অথবা আমি স্বয়ং এর প্রতিদান হব।’ (তিরমিজি, আবওয়াবুস সাওম)।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন কেউ রমজানের প্রথম দিন রোজা রাখে, তখন তার পূর্বেকার সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এমনিভাবে রমজান মাসের সমস্ত দিন চলতে থাকে এবং প্রতিদিন তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা সকালের নামাজ থেকে শুরু করে তাদের পর্দার অন্তরালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার ক্ষমার জন্য দোয়া করতে থাকেন।’ (কানযুল উম্মাল, কিতাবুস সওম)।
একবার মহানবী (সা.) বলেন, ‘ফেরেশতারা রোজাদারের জন্য দিন-রাত ইস্তেগফার করতে থাকেন।’ (মাজমাউয জাওয়ায়েদ)। হজরত আব্দুর রহমান বিন আওফ (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে ইমানের সঙ্গে সওয়াব এবং এখলাসের সঙ্গে ইবাদত করে, সে নিজ গোনাহ থেকে এভাবে পবিত্র হয়ে যায়, যেভাবে সেদিন সে তার মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভ করেছিল। মহানবী (সা.) আরও বলেছেন, রোজা গোনাহসমূহকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। নাজার বিন শায়বান (রা.) বর্ণনা করেন, আমি আবু সালমা বিন আব্দুর রহমানকে বললাম, আপনি আমাকে এমন কোনো কথা বলুন, যা আপনি আপনার পিতা থেকে শুনেছেন আর তিনি রমজান মাস সম্পর্কে হুজুর (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছেন। নাজার বিন শায়বান (রা.) বলেন, আমি আবু সালমা বিন আব্দুর রহমানকে বলেছি, এমন ধারণা তার মাথায় কেন এসেছে। মনে হয়, এই রেওয়ায়েত সর্বসাধারণের মাঝে প্রচলিত ছিল এবং লোকমুখে তিনি শুনে থাকবেন আর তিনি চাইলেন, আমার মুখ থেকে স্বয়ং শুনবেন। আবু সালমা বিন আব্দুর রহমান বলেন, হ্যাঁ, আমার কাছে আমার পিতা বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা রমজানে রোজা রাখা তোমাদের জন্য ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য এর কেয়াম জারি করে দিয়েছি, অতএব যে কেউ ইমানের অবস্থায় পুণ্যলাভের নিয়তে রোজা রাখবে, সে গোনাহ থেকে এভাবে বেরিয়ে আসে, যেভাবে তার মা তাকে জন্ম দিয়েছেন।
পবিত্র মাহে রমজানের রোজা জান্নাত লাভের মাধ্যম। এ বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যদি এক দিনের রোজা নিজ খুশি ও সন্তুষ্টি এবং মনোযোগী হয়ে রাখে, এরপর তাকে যদি পৃথিবীসমান স্বর্ণ দেওয়া হয়, তবু তা হিসাবের দিন তার পুণ্যের বরাবর হবে না।’ (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব)। হজরত আবু আমামা বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আরজ করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন কোনো কাজ বলে দিন, যার মাধ্যমে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। তখন হুজুর (সা.) বললেন, আবশ্যকীয় কর্ম হিসেবে রোজা রাখো, কেননা এটি সেই আমল, যার কোনো উপমা বা পরিবর্তন নেই।’ (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব, নিসাঈ, কিতাবুস সওম)।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘যে বান্দা খোদার পথে এক দিন রোজা রাখে, আল্লাহ তায়ালা তার চেহারা থেকে আগুনকে দূরে সরিয়ে দেন।’ (মুসলিম ও ইবনে মাজা)। অপর একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, মহানবী (সা.) বলেন, ‘খোদার জন্য এক দিনের রোজা পালনকারী থেকে জাহান্নাম শত বছর দূরত্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ (নিসাঈ, কিতাবুস সওম)।
শেষে এটাই বলতে চাই, পবিত্র রমজান হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগির মাস। ইতিমধ্যে রহমতের ১০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে, এখনো যারা নিজেদের ইবাদতে সেভাবে মগ্ন হোননি, যেভাবে হওয়া উচিত ছিল, তাদেরকে বলব, অবশিষ্ট দিনগুলোকে কাজে লাগান। কেননা, এ পবিত্র মাস যে আমার জীবনে আবার আসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই দিনগুলোতে ইবাতদের গুরুত্ব অনেক বেশি।
হাদিসে এসেছে, হজরত আব্দুর রহমান বিন আওফ (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) রমজান মাসকে ইবাদতের দিক থেকে সকল মাসের তুলনায় সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন এবং বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ইমানি অবস্থায় এবং নিজেকে যাচাই-বাছাই করে রাতে উঠে ইবাদত করে, সে তার গোনাহসমূহ থেকে এভাবে পবিত্র হয়ে যায়, যেভাবে সেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।’ (সুনানে নিসাঈ, কিতাবুস সওম)। সুবহানাল্লাহ! এই রমজান আমাদেরকে নিষ্পাপ হওয়ার জন্য আহ্বান করছে অথচ আমরা চলছি ভিন্ন পথে।
তাই আসুন, আমরা আমাদের পাপসমূহকে ক্ষমা করিয়ে জান্নাতের স্বাদ উপভোগ করি। সেই সঙ্গে সকল প্রকার পাপ কর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখি এবং গরিব-অসহায়দের সেবায় হাতকে প্রসারিত করি।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে পবিত্র এ দিনগুলোতে অনেক বেশি ইবাদতে মশগুল থেকে কাটানোর তওফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট