Thikana News
১৪ মার্চ ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫

বিদ্যুৎ লাগবনি গো বিদ্যুৎ...

বর্তমানে দেশে গড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ৯ হাজার থেকে ৯ হাজার ২১৮ মেগাওয়াট। বিগত দেড় দশকে দেশের মানুষকে পবিত্র রমজানে ইফতার, তারাবি ও সাহ্্রিতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে
বিদ্যুৎ লাগবনি গো বিদ্যুৎ...
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি মমতাজ বেগম যে বছর সংসদে দাঁড়িয়ে বিদ্যুতের উপচে পড়া উৎপাদনের বয়ান দিতে গিয়ে বলেছিলেন, দেশে ফেরি করে বিদ্যুৎ বিক্রি হবে আর ফেরিওয়ালারা পাড়া-মহল্লায় গিয়ে বলবে, বিদ্যুৎ লাগবনি গো বিদ্যুৎ...। সে বছরও দেশের মানুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টাই বিদ্যুৎবিহীন ছিল। বর্তমানে দেশে গড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ৯ হাজার থেকে ৯ হাজার ২১৮ মেগাওয়াট। বিগত দেড় দশকে দেশের মানুষকে পবিত্র রমজানে ইফতার, তারাবি ও সাহ্্রিতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েক মাসের মাথায় বিদ্যুৎ খাতের হাজার হাজার কোটি টাকার সীমাহীন দুর্নীতির পাহাড় মাথায় নিয়েও এ বছর রমজানে দেশের মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।
দেশে ২০০৯ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল ২৭টি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। অথচ বাড়তি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে কোনো বিদ্যুৎ নেওয়া হচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎক্ষমতা দ্বিগুণ করা হলেও গরমে লোডশেডিং থেকে মুক্তি মেলেনি দেশবাসীর। অথচ জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কৃতিত্ব জাহির করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বেলাগাম নিয়ন্ত্রণ এ খাতটিকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়েছিল। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে লুটপাটের ভয়ানক চিত্র। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিনা টেন্ডারে প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছে। এসব কাজে ওই সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা যুক্ত ছিলেন।
জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিডিবিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসেবে ৩০ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা দিতে হয়, যার মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ ক্রয় না করে দিতে হয়েছে। একইভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিডিবিকে ৩৭ হাজার ২০৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ক্রয় না করে দিতে হয়। এভাবেই লাখ কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট হয়। পিডিবির নিজস্ব প্রকল্পেও দুর্নীতি রয়েছে। গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না জেনেও দুর্নীতির উদ্দেশ্যেই পিডিবি খুলনায় ডুয়েল ফুয়েল ৩৩০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে। এই প্রকল্পের নির্মাণ (ইপিসি) ব্যয় ৪০০ মিলিয়ন ডলার (৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা)। জ্বালানি হিসেবে গ্যাস না থাকায় ডিজেল দিয়ে মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালানো হয়। ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ গ্যাসের থেকে কয়েক গুণ বেশি। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এ ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্পে নসরুল হামিদ বিপুর ঘনিষ্ঠজন ফয়সাল ইপিসি কন্ট্রাক্টরের লোকাল এজেন্ট ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, বিপু চীনের কোম্পানি হারবিন ইলেকট্রিক ইন্টারন্যাশনালের (এইচইআই) লোকজনকে বাসায় ডেকে নিয়ে ফয়সালকে লোকাল এজেন্ট করার চাপ প্রয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে কোম্পানিটির সব প্রকল্পের লোকাল এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন বিপুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফয়সাল।
সবচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরও শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হয়নি এ খাতটিতে। গত ১৫ বছরে এ খাতে চলেছে লুটপাটের মচ্ছব। তার পেছনে কাজ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে পনেরো বছর এ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছেই রেখেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। টানা চারবার সরকার গঠনে প্রতিবারই মন্ত্রণালয় বণ্টন হলেও টেকনিক্যাল ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ বিভাগকে তিনি কখনোই হাতছাড়া করেননি।
শুধু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই নয়, বিএনপি সরকারের শাসনামলেও এ মন্ত্রণালয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দখলেই ছিল। অর্থাৎ তিন দশক ধরেই রাজনৈতিক সরকারের প্রধানমন্ত্রীরা নিয়ন্ত্রণে রাখেন জনগুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রণালয়কে। ফলে এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিদ্যুৎ বিভাগ স্বনির্ভর হয়ে কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পরামর্শ দিলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের পরামর্শ অনুসারেই বিভাগকে কাজ করতে হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের স্বার্থেই বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে ভোক্তার স্বার্থ খুব কমই রক্ষিত হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ খাতকে সার্বিকভাবে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। 
রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে না রেখে বিদ্যুৎ বিভাগ দেশের জনসাধারণের কল্যাণে পরিচালিত হওয়া উচিত। বিদ্যুৎ খাত পরিচালনায় প্রয়োজন দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তির। বিশেষ করে, এ খাতে চুক্তি, ভোক্তার অধিকার, এমনকি কম মূল্যে বিদ্যুৎসেবার বিষয়টি যিনি নিশ্চিত করতে পারবেন, এমন একজন ব্যক্তির এখানে দায়িত্বে থাকা উচিত। তাতে একদিকে যেমন এ খাতের উন্নয়নে গতি পাবে, অন্যদিকে অর্থনীতির সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের জোরালো সম্পৃক্ততা থাকবে। রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় রাজনৈতিক স্বার্থেই বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে দেখা গেছে। দেশের জনকল্যাণের স্বার্থে রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে নয়, বরং পরামর্শেই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের স্বনির্ভর সিদ্ধান্তে পরিচালিত হওয়া উচিত। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কোনো প্রকল্পের চুক্তি করা হলে একদিকে যেমন ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয়, অন্যদিকে লুটপাটের সুযোগও কম থাকে। বরং থাকে দায়বদ্ধতা। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিগত দেড় দশকের শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোনো ন্যায্যতা ছিল না। উপরন্তু সরকার-সমর্থিত কিছু ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিকে এ খাত থেকে অর্থ লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। আর এসব দুর্নীতি আড়াল করতে করা হয়েছিল দায়মুক্তি আইন। এ আইনের আওতায় বিনা টেন্ডারে শতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল সরকারঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের। এতে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা সরিয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নষ্ট করা হয়েছে বিদ্যুতের প্রতিযোগিতামূলক বাজার। উচ্চমূল্যের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্ধেকই কোনো কাজে না এলেও দেশ ও জনগণের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে ঋণের বোঝা। জনগণের পকেট থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের বাড়তি মূল্য পরিশোধের জন্য।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা না থাকায় নতুন করে ঋণ নিয়ে পুরোনো ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে ৮২টি আইপিপি (ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) এবং ৩২টি কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র দেওয়া হয় বিনা টেন্ডারের মাধ্যমে। অর্থাৎ সরকার-সমর্থক ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিদের ডেকে ডেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপনে প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কয়েক গুণ ব্যয় বাড়িয়ে দেখানো হয়। এ অর্থ বিগত সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, আমলা ও মন্ত্রীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। এ খাতের ব্যয় তোলার জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। বাড়তি মূল্য পরিশোধে সাধারণের নাভিশ্বাস উঠে যায়। শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এতে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। 

কমেন্ট বক্স