* হাতে থাকবে বিশেষ চিহ্ন
* থাকবে না অস্ত্র-তদন্ত কার্যক্রম
‘ভেরিফায়েড লোক যদি না নেওয়া হয়, তাহলে এর অপব্যবহার হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভেরিফায়েড লোক নেওয়া ও তাদের কার্যক্রম মনিটরিং করা জরুরি’
- মোহাম্মদ নুরুল হুদা, সাবেক আইজিপি
‘পুলিশ অফিসার যেভাবে আইনগতভাবে প্রটেকশন পান, এই অক্সিলিয়ারি ফোর্সের সদস্যরাও সেই প্রটেকশন পাবেন’
- শেখ মো. সাজ্জাত আলী, কমিশনার, ডিএমপি
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের পটপরিবর্তনে ভেঙে পড়েছে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধ। এমন বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পরিচালিত হয় অপারেশন ডেলিভ হান্ট। কিন্তু এরপরও অপরাধীরা নানা কৌশলে একের পর এক অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পুলিশে সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ব্যাপক রদবদল ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এতে নতুন নতুন জায়গায় নতুন পুলিশ সদস্যদের বদলি পদায়ন করা হলেও জনরোষের ভয়ে এখনও পুলিশ নিষ্ক্রিয় রয়েছে। এমন পরিস্থিতি উত্তরণে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে মাঠে নামানো হচ্ছে পুলিশের ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ বা ‘সহায়ক বাহিনী’। তবে এ বাহিনীর সদস্যদের ডিএমপি অধ্যাদেশে অপরাধী গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হলেও তাদের হাতে কোনো অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে না। কোনো ঘটনার তদন্ত করার ক্ষমতাও দেওয়া হবে না। এ বাহিনীর সদস্যদের চিহ্নিতকরণে হাতে একটি বিশেষায়িত চিহ্ন যুক্ত করা হবে। পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদার মতে, পুলিশকে সহযোগিতার জন্য এ ধরনের ফোর্স ব্যবহার করার বিষয়টি পুলিশ আইনেই আছে। তবে ভেরিফায়েড লোক যদি না নেওয়া হয়, তাহলে এর অপব্যবহার হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভেরিফায়েড লোক নেওয়া ও তাদের কার্যক্রম মনিটরিং করা জরুরি। এদিকে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, ডিএমপি বিধি অনুযায়ী, তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে অপরাধ দমনে পুলিশকে সহায়তায় খুব শিগগিরই এ বাহিনী মাঠে নামবেন। গতকাল সোমবার ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে পুলিশের ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ বা ‘সহায়ক বাহিনী’ মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব ডিএমপি’র পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটা এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই পুলিশের কাজে সহায়তার জন্য এমন ফোর্স রয়েছে। তবে বাংলাদেশে এ বিষয়টি একেবারেই নতুন। এই ফোর্স নিয়ে জোরেশোরে চলছে আলোচনা। নিয়োগ কীভাবে হবে, কারা নিয়োগ পাবে, তারা কী করতে পারবে, কী পারবে না- এসব বিষয়েও তৈরি হয়েছে ব্যাপক আগ্রহ।
পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য। আইনে কী আছে, কীভাবে নিয়োগ হবে, মাঠে কীভাবে কাজ করবে প্রভৃতি বিষয়ে মিলেছে প্রাথমিক ধারণা।
গত ৮ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী খান বলেন, ঈদের আগে বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর ১০ ধারা অনুযায়ী কমিশনার নিজ ক্ষমতাবলে এই নিয়োগ দেবে। এটা হবে সাময়িক।
ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, মেট্রোপলিটন পুলিশের অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬ ধারা মোতাবেক ডিএমপি কমিশনার যদি মনে করেন, যে কোনো ব্যক্তিকে সহযোগী পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী এই সহযোগী পুলিশ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, যাদের এই অক্সিলিয়ারি ফোর্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের হাতে চিহ্নিতকরণ একটি ব্যান্ড থাকবে, যা দেখে বোঝা যাবে যে, তারা ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’। পুলিশের সহযোগী এই বাহিনী কবে থেকে রাস্তায় নামবে সেটি এখনো নির্দিষ্ট করে জানায়নি পুলিশ। তবে এ নিয়ে কাজ শুরু করার কথা জানানো হয়েছে ডিএমপির পক্ষ থেকে। তবে এই অক্সিলিয়ারি বাহিনী বা সহযোগী ফোর্স কী করতে পারবে, কী পারবে না- সেটা জানা থাকা সবার জন্য জরুরি।
ডিএমপির মুখপাত্র ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, পুলিশ যেমন দায়িত্ব পালন করে, সহযোগী ফোর্স ঠিক একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, আটক বা নিয়মিত টহলের মতো দায়িত্বগুলো পালন করতে পারবে। তবে তারা কোনো ধরনের ইনভেস্টিগেশন বা তদন্ত পরিচালনা করতে পারবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই অক্সিলিয়ারি ফোর্সের পুলিশ বাহিনীর মতো প্রশিক্ষণ, দক্ষতা কিংবা দায়বদ্ধতার জায়গাগুলো থাকবে না। এমনকি তাদের কোনো ধরনের অস্ত্র দেওয়া হবে কি না সেটি নিয়েও আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। কত সংখ্যক অক্সিলিয়ারি ফোর্স প্রাথমিকভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে সেটি নিয়েও এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে ডিএমপি।
পুলিশ বাহিনীর বাইরে হঠাৎ করে নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ যখন পুলিশের ক্ষমতা পাবে সেটির ব্যবহারে কতখানি স্বচ্ছতা থাকবে এ প্রশ্নও উঠছে সাধারণ জনমনে।
ডিএমপির ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ডিএমপি কমিশনার প্রয়োজন মনে করলে পুলিশকে সহায়তার জন্য যে কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো সময় ‘অক্সিলিয়ারি পুলিশ অফিসার বা সদস্য’ হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন। পুলিশের মতোই তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা থাকবে। তারা যদি আইনের ব্যত্যয় ঘটায় বা অপরাধ করেন, তবে পুলিশের ক্ষেত্রে যে ধরনের শান্তির কথা বলা আছে, তাদের ক্ষেত্রেও একই শাস্তির বিধান থাকবে। ডিএমপি অধ্যাদেশের ১০ ধারা প্রয়োগ কীভাবে হবে, এ-সংক্রান্ত কোনো বিধিমালাও নেই। ফলে এই মুহূর্তে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে, সেটি ঠিক করা হচ্ছে। বিষয়টি এখনো আলোচনা পর্যায়ে। নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু ও নিয়োগের পর নতুন হয়তো আরও স্পষ্ট তথ্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে শিগগিরই জানা যাবে।
পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, অক্সিলিয়ারি ফোর্স বলতে পুরো ফোর্স বোঝায় না, তবে আধা সরকারি ফোর্স, পুলিশকে সহযোগিতার জন্য এ ধরনের ফোর্স ব্যবহার করার বিষয়টি পুলিশ আইনেই আছে। যুক্তরাজ্যে এমন বাহিনী ব্যবহারের নজির আছে উল্লেখ করে সাবেক এই আইজিপি বলেন, অল্প সময়ের জন্য এ ধরনের সহযোগী ফোর্স ব্যবহার করার নজির আছে। এটা খরচও যেমন বাঁচায়, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকরীও বটে।
তিনি বলেন, ‘ঠিকমতো লোক যদি না নেওয়া হয়, ভেরিফায়েড লোক যদি না নেওয়া হয়, তাহলে এর অপব্যবহার হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভেরিফায়েড লোক নেওয়া ও তার কার্যক্রম দৈনিন্দিন মনিটরিং করা জরুরি।
তাহলে এই সহযোগী বাহিনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি কোনো অন্যায় করে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে? এমন প্রশ্নে সাবেক আইজিপি বলেন, বড় অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যাবে। আর ছোটখাটো অন্যায় করলে তাকে যে কোনো মুহূর্তে চাকরিচ্যুত করা যাবে, তাতে খুব বেশি আইন-কানুন মানতে হবে না।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ঈদের আগে বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ অফিসাররা যেভাবে আইনগতভাবে প্রটেকশন পান, এই অক্সিলিয়ারি ফোর্সের সদস্যরাও সেই প্রটেকশন পাবেন। তবে কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান ডিএমপি প্রধান।
ঠিকানা/এসআর