জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ ঘিরে দেশের মানুষের মধ্যে নানা প্রত্যাশার হাওয়া বইতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে তরুণদের লক্ষ্য দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা নিয়ে রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন উত্তাপ। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নতুন দলটির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের ভাষ্যে উঠে এসেছে দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার কথা। তার পরদিন ১ মার্চ রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে? সেকেন্ড রিপাবলিক কখন হয়? গণপরিষদ কেন হবে? এর মধ্যে তো আরও একটি উদ্দেশ্য আছে। এসব বিষয় ‘ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ষড়যন্ত্র’।
এর পরই মূলত ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ নিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক। সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে প্রকৃতপক্ষে তরুণ নেতারা কী বোঝাতে চাইছেন, সেটিও অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। বিএনপিসহ অধিকাংশ সমমনা দলের অভিমত, ফার্স্ট রিপাবলিক যখন অকার্যকর প্রমাণিত হবে, কেবল তখনই সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয়টি আসবে। ফার্স্ট রিপাবলিককে তো কেউ নেগলেট (অবজ্ঞা) করেনি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ফলে বর্তমানে সেকেন্ড রিপাবলিকের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তবে দু-একটি দল বলছে, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার স্বপ্নকে দুমড়ে-মুচড়ে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় সার্বিক বিবেচনায় সেকেন্ড রিপাবলিকই হতে পারে নতুন পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টের (বন্দোবস্ত) সমাধান। তবে এটার জন্য দরকার জাতীয় ঐকমত্য।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করেই বলেন, একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে জাতীয় নাগরিক পার্টি আসলে কী বোঝাতে চাইছে, এ বিষয়ে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, এ ভূখণ্ডের মানুষের সব লড়াই একীভূত করে মানুষের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে এটিই বোঝাচ্ছেন তারা। আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘প্রথম রিপাবলিক হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের পর যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, সেই সংবিধানে কিছু কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্বপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে। এ কাঠামো বারবার সংশোধন করা হয়েছে।’
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণাটি ফ্রান্সের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পোল্যান্ড, কোস্টারিকাসহ আরও কয়েকটি দেশের ইতিহাসের সঙ্গেও মিশে আছে শব্দটি। এটি এমন একটি রাজনৈতিক ধারণা, যা বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সার্বিকভাবে এমন ধারণায় কোনো দেশে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা শাসনকাঠামো গ্রহণ করাকে বোঝায়। বিপ্লব, অভ্যুত্থানসহ নানাভাবেই আসতে পারে এমন পরিবর্তন।
এদিকে ২ মার্চ বিএনপির নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এক অনুষ্ঠানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘এখন নতুন দল এসেছে, আপনারা সাবধান থাকবেন। আমি কিন্তু তাদের স্লোগান বুঝি না। আমি কিন্তু বুঝি নাই কাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে। আমি এখনো বুঝি নাই সেকেন্ড রিপাবলিক কী। কী বোঝায়, আপনারা বুঝেছেন কি না, জানি না? অর্থাৎ একটা অছিলা ধরে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। দয়া করে খেয়াল রাখবেন।’
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে মুক্তচিন্তা, স্বাধীন রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের সুযোগ বর্তমানে এ দেশে রয়েছে। ছাত্ররা সেকেন্ড রিপাবলিক এবং গণপরিষদের কথা বলেছে, এর ব্যাখ্যা তারা দেবে। এ নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে সরকারকে সংস্কার (রিফর্ম) প্রস্তাব দিয়েছি।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ফার্স্ট রিপাবলিক যখন কার্যকর নয় বলে প্রমাণিত হবে, কেবল তখনই সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা আসবে। আমাদের ফার্স্ট রিপাবলিক যেটা আছে, সেটাকে তো কেউ নেগলেট করেনি। সংবিধান সংস্কার কমিশন যেটা আছে, সে অনুযায়ী সংবিধানকে সংশোধন করে আমাদের এগোতে হবে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের কথা শুনলে, এই কনস্টিটিউশন (সংবিধান) তো ভেঙে দিতে হবে। তার পরই বিতর্ক লাগবে যে, ইসলামিক কনস্টিটিউশন হবে নাকি সেক্যুলার কনস্টিটিউশন হবে, রাষ্ট্রধর্ম থাকবে নাকি থাকবে না, তখন সেই বিতর্ক কে সমাধান করবে। আমরা সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদকে সমর্থন করি না।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে কতিপয় ছাত্রের উচ্চাভিলাষী এবং হঠকারী চিন্তা-ভাবনায় গত ছয় মাসে দেশে নতুন নতুন বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। কিছু হঠকারী প্রস্তাবনাও তারা নিয়ে এসেছে। যেটি রাজনীতিতে বিভাজন তৈরি করেছে, ৫ আগস্ট-কেন্দ্রিক যে জাতীয় ঐক্য ছিল, তাতেও ফাটল ধরিয়েছে। এখন সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে কী বোঝায়, তারা কী বোঝে, সেটা পরিষ্কার জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ বদরুল হাসান বলেন, ফ্রান্সসহ যেসব সমাজে এ ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, সেই পরিবর্তনগুলো হয়েছে কোনো না কোনো নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশেও একটা পরিবর্তন ঘটেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি যে সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছে, তাদের নিশ্চয় একটা দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তা আছে। সময়ই বলে দেবে এ ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যটা আসলে কী বা সেটা দেশের জন্য কী বয়ে আনবে।



ঠিকানা রিপোর্ট


