আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের কল্পনাকে হার মানাচ্ছে। বর্তমান সময়ের সবচাইতে আলোচিত বিষয় এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, যা তথ্যপ্রযুক্তি বিজ্ঞানের এক অভিনব সৃষ্টি। কোডিং করার মাধ্যমে যখন একটি কম্পিউটার সিস্টেম বা মেশিন নিজে নিজেই ডেটা থেকে শিখতে পারে এবং মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করতে পারে, তখন আমরা তাকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে থাকি।
এআই তৈরি হয়েছে ন্যানো টেকনোলজির মাইক্রোচিপ দ্বারা, যা কিনা গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত উন্নত করা হচ্ছে এবং মানবসমাজের বিভিন্ন খাতে কাজে লাগানো হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য, গবেষণা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সর্বক্ষেত্রে এখন আমরা এআইয়ের ব্যবহার দেখছি।
একসময় অ্যামাজন কোম্পানির ‘অ্যালেক্সা’ এবং অ্যাপল কোম্পানির ‘সিরি’ এআই-জগতে ভীষণভাবে সাড়া ফেলেছিল। তাদেরকে দেওয়া নির্দেশ খুব নিখুঁতভাবে তারা গ্রাহকদের জন্য পালন করত এবং গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা করে থাকত। তারপর এল এআইয়ের সাড়া-জাগানো অ্যাপলিকেশন, ভাষা মডেল বা জিপিটি। চ্যাট জিপিটি একটি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং মডেল, যা কিনা যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। আমাদের সমাজে কমিউনিকেশন মোড হিসেবে যা ব্যবহৃত হয়, সেসব তৈরিতে এটি পারদর্শী, যেমন ইমেইল, চিঠি, প্রবন্ধ, রচনা, ব্লগ, এমনকি গল্প, গান, কবিতা, অনুবাদ অথবা গবেষণার রিপোর্ট তৈরি করতে এটি জানে। চ্যাট জিপিটি নিজের প্রোগ্রামিং কোড নিজে লিখতে পারে।
এখানেই শেষ নয়। যত দিন যাচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আরও শক্তিশালী হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে আলোচিত জেনেরেটিভ এআই তার একটি প্রমাণ। জেন এআই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক নতুন রূপ, যা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডেটা থেকে নতুন বিষয়বস্তু তৈরি করতে সক্ষম। এই এআই সিস্টেম অনায়াসে অডিও, ভিডিও, টেক্সট, ছবি, মিউজিকÑএ ধরনের বিভিন্ন কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে। প্রযুক্তিতে এত উন্নতি মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার সংজ্ঞাই বদলে দিচ্ছে।
জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ছবি, পোস্টার, ভিডিও দেখেছি; যার অনেকগুলো ছিল এআই দিয়ে তৈরি। কিছু কিছু সৃষ্টিকর্ম দেখতে এতই বিশ্বাসযোগ্য যে বোঝাই যায় না যে ওটা মানুষ নয়, বরং এআই মডেল দ্বারা সৃষ্ট।
শুধু তা-ই নয়, মানবসমাজ মানসিক সুস্থতার জন্য এআইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। জীবনের নানাবিধ সমস্যা ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে কাউন্সেলিং বা মেন্টাল থেরাপির জন্য আমরা এআই থেরাপিস্ট ব্যবহার করছি, যা কিনা যেকোনো অ্যাংজাইটি বা ডিপ্রেশনের মতো মানসিক দুরবস্থায় মানুষের সেবায় ২৪/৭ সহায়তা দেবে। এটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আপনার কথা শুনবে এবং পরিত্রাণের উপায় বাতলাবে, তবে আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন যে একটা মেশিনের কাছ থেকে আপনি কোনো পরামর্শ গ্রহণ করবেন কি না।
কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা বলছেন, এআইয়ের যাত্রা সবেমাত্র শুরু, সামনে অনেক পথ বাকি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরে এআই শুধু কথোপকথন বা কন্টেন্ট তৈরিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন অনলাইন টাস্ক করতে সক্ষম হবে। তাকে দেওয়া যেকোনো সমস্যার স্টেপ বাই স্টেপ সমাধান তৈরি করতে পারবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষক দল ভয়ার্তচিত্তে একটা কথা স্বীকার করছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ঊর্ধ্বমুখী রকেট আগামীতে কখন থামবে বা কোথায় গিয়ে থামবে, সেটা তাদের সঠিক জানা নেই। এই ব্যাপারটা অনেক বোদ্ধাকে ভাবিয়ে তুলেছে। যন্ত্রের ওপর এই নির্ভরশীলতা আগামী কয়েক দশকে মানবসমাজে কল্যাণ বয়ে আনবে নাকি আনবে না, সে ব্যাপারেও অনেক বোদ্ধা সন্দিহান।
বিজ্ঞানের ব্যাপারে আমার বরাবরই প্রচণ্ড ঝোঁক। তাই লেখার মধ্যে বিজ্ঞান চলে আসে বারবার। এবারের অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ভিত্তি করে বেরিয়েছে আমার লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ‘এআই কন্যা’। বইটিতে আছে ভিন্ন ভিন্ন ধারার পাঁচটি ছোটগল্প এবং প্রতিটি গল্পেই কোনো একজন এআই কন্যা বিদ্যমান। গল্পগুলো লেখার মধ্য দিয়ে আমার বিজ্ঞানী মন অন্তর্দৃষ্টি মেলে দেখার চেষ্টা করেছে, আগামীতে কী ঘটতে পারে। গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট, বিন্যাস হয়েছে অজানা এক অদূর ভবিষ্যতের সময়কে কল্পনা করে। যার সাক্ষী হতে পারি আমরা অথবা আগামী প্রজন্মের মানুষেরা।
ভবিষ্যৎ আমাদের জানা নেই, তবে ভাবতে কোনো বাধা নেই। যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আরও উন্নতশীল হবে, মানবসভ্যতা ও মেশিন-নির্ভরতা আরও সন্নিকটে আসবে; ফলে পৃথিবীর মানুষ সীমাহীন উপকৃত হবে অথবা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে, এআই কন্যা তারই একটি কাল্পনিক চিত্র আঁকতে চেয়েছে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে তাম্রলিপি প্রকাশনী থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন চয়ন বাঙ্গালী। বইটি অর্ডার করা যাবে তাম্রলিপির ফেসবুক পেজ থেকে অথবা রকমারি ডটকমে। লেখকের নাম : শিশিরকন্যা জয়িতা।
লেখক : কলামিস্ট, ব্লগার, গল্পকার। টেক্সাস।