Thikana News
১৪ মার্চ ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫

অদৃশ্য 

অদৃশ্য 
পার্কিংলটের টিকিট কোথায় গেল? আশ্চর্য তো! মায়ার স্পষ্ট মনে পড়ে জ্যাকেটের পকেটে রেখেছিল। কোথায় পড়ে গেল?
জেএফকে বিমানবন্দরের এত বড় অ্যারাইভাল টার্মিনাল ফ্লোরে একটা ছোট কাগজ এখন কোথায় খুঁজবে! মায়া ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কেন যে গাড়িতে রেখে দিতে ভুলে গেল।
আনিস, আমার পকেটে হাত দিয়েছিলে। তখন নেওনি তো বাবা?
নো মা নো। বাট মা, বাবা?
প্লেন কেবল ল্যান্ড করেছে। বাবার বের হতে সময় লাগবে। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। বাবা বের হলেই দেখতে পাবে।
ছয় বছরের আনিস মায়ের গালে চুমু দিয়ে বলে, প্রমিজ?
হ্যাঁ, প্রমিজ। শোনো, ওই যে ডোর দেখছ, একটু আগে ওই ডোর দিয়ে এসেছি আমরা। তাই ওখানে গিয়ে দেখে আসি। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। ওকে?
ওকে মা।
মায়ার ধারণাই ঠিক। টার্মিনালে ঢোকার দরজার কাছেই পড়ে আছে সাদা ছোট টিকিট।
মায়া নিচু হয়ে তুলে দাঁড়াতেই চমকে যায়। না, মায়া একা নয়, মুখোমুখি দুজনই চমকে ওঠে!
মায়া? মায়া, তুই এখানে?
চমকে যাওয়ার সমস্ত সময়টুকু কাটিয়ে উঠতে মায়া সময় নিল না। ঠোঁটের কিনারে নোমান ডাক এলেও ফিরিয়ে নেয়। মায়া তাকায় নোমানের দিকে। একটু বেশি সোজাভাবে তাকায়। নোমানের দৃষ্টিতে উষ্ণতা মাখা।
মায়া, মায়া!
নোমান আবার ডাকতেই মায়া বলে, আমার ছেলে একা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে যেতে হবে।
ছেলে? কোথায়?
মায়া কিছু বলার আগেই আনিস দৌড়ে এসে মায়ের হাত টেনে বলে, মা কাম।
নোমানের হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেল না নিজেই রাখল, বোঝা গেল না। মায়া আনিসকে কিছু বলার আগেই সে আবার ছুটে যেতে যেতে বলে, মা কাম। বাবা আসবে।
মায়া পা বাড়াতেই নোমান ওর হাত ধরে বলে, একটু দাঁড়া।
মায়ার হাত ছাড়াতে হলো না। নোমান নিজেই মায়ার ঠান্ডা হাত ছেড়ে দেয়। বলে, দাঁড়াও মায়া।
মায়ার মনে হলো এত বছর পর আবার যেন কোথা থেকে ভেসে আসা অপ্রীতিকর বাষ্প তাকে নিঃশ্বাস নিতে দিচ্ছে না।
অ্যারাইভাল টার্মিনালÑপ্যাসেঞ্জার বের হয়ে আসছে। নোমানের হাতে সময় নেই কোনো ভূমিকা করার। নোমান মায়ার সামনে এসে দাঁড়ায়।
মায়া, আমার ভুল হয়েছিল, কিন্তু আমার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। মায়া, আমি ভুল করেছিলাম, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলের সময় তুই, তুমি...
নোমান, তোমার ভুল ছিল না। তোমার সিদ্ধান্ত ছিল। তবু যদি ভুল বলো, তবে বলি সব ভুল ভাঙানো যায় না।
মায়া দেখে, আনিস হাত নাড়ছে। মায়া পা বাড়াতে গিয়ে থেমে যায়। নোমানের ভেজা চোখে চোখ রেখে বলে, ও যদি দেখতে হুবহু তোমার মতো না হতো, তাহলে আজ বিশ্বাস করতে?
মায়ার জিজ্ঞাসা নোমানকে বোধ করি নিয়ে গেল নিরুত্তরের অন্ধকারে। দুই পা দূরে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ একটি ভুলের সীমাহীন দূরত্বের আড়ালে রয়ে গেল জনকের পরিচয়।
বাকশক্তিহীন নোমান দেখে, ছেলে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে উঠতেই অন্য প্রান্ত থেকে দু’হাত বাড়িয়ে কে একজন এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে, আনিস, মাই বয়!
নোমান আত্মবঞ্চনার কণ্ঠে বলে, আনিস?
হ্যাঁ, আমার ছেলের নাম আনিস মনজুর। কাকা রেখেছেন।
বাবা আর ছেলে এগিয়ে আসে। মায়াকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে নিয়ে ছেলের বাবা বলে, মায়াবী, তুমি পার্কিং টিকিট খুঁজছ? আহা, হারিয়ে গিয়েছে? হারানো জিনিস খুঁজতে সময় নষ্ট করে কী হবে!
মায়া বলে, না মুশফিক, পেয়েছি।
তাই বলো, নিজ থেকেই ধরা দিল? তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে কোথায়? কী হলো, এত গোমড়া মুখ কেন? আরে বাবা, একটু দুষ্টামি করলাম।
মুশফিক মায়ার কপালে আদর করে বলে, চলো বাড়ি যাই।
এই মুহূর্তটা সময়ের কাঁটায় এক মিনিট পার না হলেও নোমানের মনে হলো সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেÑওদের মাঝে অস্তিত্বহীন একজন হয়ে।
টার্মিনালে আগন্তুকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নোমানকে পেছনে ফেলে ওরা তিনজন বের হয়ে যায়। বাবা-ছেলে রাস্তা পার হয়ে গেল। মায়া দাঁড়িয়ে থাকে।
ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি সবুজ থেকে লাল হয়ে যায়। মায়া পেছনে ঘুরে তাকাতে গিয়ে থেমে যায়। কাচের দরজার ওপারে নোমানের দাঁড়িয়ে থাকা বড় বেশি স্পষ্টÑমায়ার মন বলে, নোমান দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে।
মায়া কি ঘুরে তাকাবে? নোমান কেন এয়ারপোর্টে? কাকে নিতে এসেছে? ও কি নিউইয়র্কে থাকে? না, মায়ার কোনো প্রশ্ন নেই। সাত বছর আগের একটি প্রশ্নের চাপে সব প্রশ্ন যে অর্থহীন। লাল থেকে সবুজ সিগন্যাল বাতি জ্বলে। রাস্তার ওপারে ছেলে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। মায়া রাস্তা পার হয়ে ওদের কাছে যায়।
গাড়িতে উঠেই আনিস বলে, বাবা আজ রাতে আমার সাথে থাকবে। মায়া চমকে ওঠে, আনিসের কথা বলার ধরন কি তাহলে...
ঠিক এভাবেই যেন সাত বছর আগে নোমান বলেছিল, আজ রাতটা আমার সাথে থাকবে।
কেন?
কারণ, আমি কবে ফিরে আসতে পারব, জানি না।
কার্নিশের গায়ে হেলান দিয়ে মায়া ফেব্রুয়ারিতে পরিয়ে দেওয়া আংটি ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, কালই যেতে হবে? একটা দিন থেকে গেলে খুব অসুবিধা হবে? কাল না হয় কোনো কাজি অফিসে যাই?
মায়া, কী বলছিস? লোক মরছে, বিধবা হচ্ছে, এই সময় কাজি অফিসে? কেন, আমি তোর স্বামী না? রেজিস্ট্রি না হলে যদি আমি তোর স্বামী না হই, তাহলে আমি মরে গেলে তুই বিধবাও হবি না।
মায়া উঠে যেতেই নোমান বলে, রাগ করিস না। কথাটা তুলে নিলাম। তোর জন্যই ঠিক ফিরে আসব।
পঁচিশে মার্চের রাতে বন্ধুদের সাথে নোমানের হলেই থাকার কথা ছিল। সেদিন মায়ার জ্বর থাকায় ও গেল না। সেই রাতে হলের রুম থেকে ওর কোনো বন্ধু বের হতে পারেনি। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে একে অপরের বুকে পিঠে পড়ে শেষ নিঃশ্বাস নিয়েছে।
নোমান তো সেদিন রাতেই শেষ হয়ে যেত।
নোমান সিগারেটের জ্বলন্ত গোড়া স্যান্ডেলে পিষে মায়ার গা ঘেঁষে বসে। মায়ার ঘাড়ে হাত রেখে বলে, এই ছাদে আমাদের পায়ের ছাপ কত বছরের? বিশ?
না উনিশ। আমরা তোমাদের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে যখন এলাম, তখন আমার এক বছর আর তোমার ছয়। কতবার মনে করিয়ে দিতে হবে?
যতবার ভুলে যাব ততবার তুই মনে করিয়ে দিবি। আমি ভুল করব তুই শুধরে দিবি।
মায়া নোমানের বুকে মাথা রেখে বলে, বেশি ভুল করো না। এখন যাই। বাবাকে খাবার দিতে হবে।
নোমান মায়ার চোখের সামনে হাতঘড়ি তুলে বলে, এখন রাত আটটা বাজে। ঠিক এগারোটা বাজলে এখানে আসব। পাঁচ মিনিটের বেশি দেরি করলে মেরে ফেলব।
মায়া নোমানের হাত ধরে উঠতে উঠতে বলে, উনিশ বছর ধরে শুধু মারতেই চাইলে, পারলে না। কথাটা কবে ফলাবে তুমি, কে জানে।
নোমান মায়ার কপালে চুমু খেয়ে বলে, ফিরে আসি, তখন দেখবি। সিঁড়ি ভেঙে একতলায় যাওয়ার আগে মায়া একবার দোতলায় নোমানের মায়ের কাছে এল।
মা কাকি, ডাল রেঁধেছ আজ? এক তরকারি দিয়ে আর খেতে ইচ্ছা করছে না।
মায়া মা, এমন করে বলতে নেই। তাও ভালো, এর-ওর বাগানে সবজি আছে এখনো। যার যার বাড়িতে মুরগি ছিল, সে তো প্রায় শেষ। নোমান কত দিন বাদে এল। না খেয়ে শরীরের কী হাল হয়েছে, দেখেছিস তো। আমার শেষ মুরগিটাকে জবাই করতে হলো। কী সুন্দর, রাত পোহালেই ডাক দিত।
নোমান কাছে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, কে বলেছিল তোমাকে ওর গলায় ছুরি চালাতে?
ঘাস-লতাপাতা খেয়ে চলিস, ভাবলে যে আমি মুখে কিছু দিতে পারি না।
মায়ার হাতে বাটি তুলে দিয়ে নোমান বলে, মা, এই মেয়েটা তোমাকে মা কাকি কেন ডাকে? তুমি কী হও ওর?
বাবা, এই ঘোর বিপদেও তোর ঠাট্টা যায় না। হ্যাঁ রে, তোরা কি যুদ্ধ করতে করতে এমন ধারার কথা বলিস?
হ্যাঁ বলি, তবে বলি পাক্কুগুলোকে নিয়ে। তুমি বিশ্বাস করো, ওদের গায়ে শক্তি আছে ঠিক, তবে মাথায় ঘিলু কম। 
ঘিলু কম বলেই তো এমন কাজ করতে পারল।
তুমি দেখো, আমরা জিতবই।
ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, জেতার পেছনে কত ধরনের ধ্বংস সহ্য করতে হবে কে জানে।
এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট পরে না, আরও আগেই মায়া কাঁথা আর বালিশ নিয়ে আসে। ছাদের এক কোনায় ছোট ক্যাম্পখাটের ওপর রেখে কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, সংকটময় দেশের মাথার উপরে আকাশটা কী ভীষণ শান্ত। মায়ার গলা ধরে আসেÑএই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? স্বাভাবিক হবে কি সবকিছু? কোথায় স্কলারশিপ নিয়ে সেপ্টেম্বরের সেশন ধরার জন্য নোমানের আমেরিকায় যাবার কথা। যাবার আগে বিয়ে। সব এখন ভাগ্যের অজানা অপেক্ষায়।
নোমান এপ্রিলের ১০ তারিখে এখানে দাঁড়িয়ে বলেছিল, মায়া, আমাকে যেতে হবে। মায়া কেঁদেছিল অনেকক্ষণ। নোমান বাধা দেয়নি। বলেছিল, চোখের পানি সব সময় বৃথা যায় না রে। কখনো ভেতর থেকে মূল্যবোধকে ধুয়ে মুছে আনে। ভেবে দেখ, ঘরে বসে থাকার সময় এখন?
মায়া, তুই ভিতু, নরম মনের মানুষ, তবু বলি, এখন সময় এসেছে সাহসী হয়ে ওঠার। নিজের ভেতরে শক্তি আছে সেই বিশ্বাসে ভর করে চলতে হয়। বাড়িতে তোরা চারজন। তোর উপরে আমি ভরসা করতে চাই।
সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ। মায়া চট করে চোখ মুছে নিলেও নোমান ঠিকই টের পায়। মায়াকে কাছে টেনে বলে, অপেক্ষায় বসে আছে আমার অন্তকালের প্রেমÑএই দৃশ্য যে এই জগতের সেরা দৃশ্য! এমন করেই অপেক্ষায় থাকিস। তবে আমি যদি পঙ্গু হয়ে ফিরে আসি, তখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবি না। বোঝা হয়ে থাকার চাইতে অদৃশ্য ভালোবাসায় থেকে যাব।
রাতের অন্ধকার কেটে যায়নি। মায়া তখনো ঘুমিয়ে। মায়ার শরীরের প্রতিটি বাঁক নোমানের চেনা, তবু কাল রাত যেন ছিল প্রথম, ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ রাত। মায়াও এত বেশি সপ্রতিভ আগে কখনো হয়েছিল কি?
নোমানের গলা ধরে এল। ফিরে আসবে তো সে? কোথাও কি প্যাঁচা ডেকে উঠল?
মায়া মায়া, দুবার ডেকেও মায়া চোখ খুলছে না দেখে নোমান মায়াকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে বলে, পাগলি, চুপ করে থেকে আমাকে আটকাবার কথা না ভেবে উঠে বস।
কখন যাবে?
এখন চারটা বাজে, এক ঘণ্টা পরে।
আমি যাই, চা-নাশতা নিয়ে আসি।
নোমানের দুই সহযোদ্ধা সময়মতো দুধ বিক্রেতার সাজে এসে দরজায় টোকা দিল। নোমান নিচে নামতেই দেখে মায়ার বাবা দাঁড়িয়ে। নোমানকে কাছে টেনে কিছু বলতে গিয়েও পারল না। নোমান জানে, এই মানুষটার কথা অব্যক্তই থেকে যায়।
মায়া ছাদে দাঁড়িয়ে। নোমান ফিরে তাকায়। এক পা বাড়িয়ে আবার ফিরে তাকায়। নোমান দাঁড়িয়ে পড়তেই বন্ধুরা অস্থির হয়ে ওঠে। নোমান হাত তুলে মায়াকে চলে যেতে ইশারা করে, ওদের সাথে পা বাড়ায়। মায়া আড়াল থেকে নোমানের চলে যাওয়া দেখল।
কে জানত, বিধির লিখনে ছিল নোমানের সেই যাওয়াই মায়ার জীবন থেকে চলে যাওয়া!
আজ ছয় বছর পর এই এয়ারপোর্টে বিধির অদৃশ্য লিখনের আরও একটি অংশ দৃশ্যমান হয়ে এলÑঅখণ্ডিত বিধি নোমানকে না যেতে দিল, না ফিরে আসতে দিল!
নোমানের সেদিন চলে যাওয়ার ঠিক এক মাসের মধ্যে ঘটে গেল আরেক ঘটনা।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার ছয় মাস পরে কী মনে করে মিলিটারিদের ইচ্ছা হলো এড়িয়ে যাওয়া এই এলাকাটা একটু দেখা দরকার। এই পাড়াতে এক-দুই ঘর হিন্দু থাকলেও তারা তাদের ঘরে তালা মেরে সীমান্তের ওপারে চলে গেছে এপ্রিলের শুরুতেই।
মিলিটারিদের আসার সম্ভাবনা কম আন্দাজ করে মহল্লাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের ঠাঁই দিতে সাহস করেছিল। ছেলেরা আসত পেটে কিছু দিতে, একটু ঘুমাতে।
সকলের আন্দাজকে তুড়ি মেরে একদিন ভরদুপুরে মোড়ের মুখে জিপ থামে, দু-চার বাড়িঘরে তদন্ত শেষে নোমানদের বাড়িতে এসে কড়া নাড়ল দুজন পাক আর্মি।
নোমানের বাবা দোতালা থেকে ওদের দেখেই হুড়মুড় করে নিচে নেমে চাপা গলায় ডাকে, মায়া। খটখট আওয়াজ শুনে মায়ার বাবাও বের হয়ে আসে। হতভম্ব হয়ে দুজনে দুজনার দিকে তাকায়। দরজা না খুললে গুলি চালাবে। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে মায়ার বাবা দরজা খুলে দিল।
দুজন আর্মি ভেতরে ঢুকে জানতে চাইল, বাড়িতে কে কে আছে। নোমানের বাবা উর্দু বলতে পারে না। বোঝেও সামান্য। যাদেরকে দেখার কোনো ইচ্ছা ছিল না, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাটাও ভুলে গেছে সে। রীতিমতো তোতলাচ্ছে দেখে ওরা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে মায়ার বাবার দিকে তাকায়।
মায়ার বাবা ঝরঝরে উর্দুতে বলে, আমার নাম মোহাম্মদ আনিস। আমার মেয়ে মায়া আর আমি একতলায় ভাড়া থাকি। ইনি বাড়ির মালিক আহমেদ মনজুর। উনি এবং তার স্ত্রী মমতা বেগম দোতলায় থাকেন। ওদের একটি ছেলে, সে বিদেশে কাজে আছে।
মনজুর তার এত বছরের পুরোনো ভাড়াটে, তার পরম আত্মীয় আনিসের দিকে তাকিয়ে ভাবল, ও তো মিথ্যে বলেনি। তার ছেলে তো বিদেশেই আছে। কাজেই আছে।
আর্মিদের একজন বলে, ভেতরে চলো। মেয়েকে ডাকো। আনিস ওদেরকে দরজা দেখিয়ে বলে, আইয়ে।
মনজুর বুঝতে পারে তার এখন বাথরুমে না গেলেই নয়। আনিসকে বলতেই সে মিলিটারিদের বলে, ওর প্রস্টেট সমস্যা আছে। ওকে বাথরুমে যেতে অনুমতি দাও।
ওরা ইশারায় যেতে বলেই আবার বলে, এখানে ফিরে আসবে।
বাথরুমের দরজার আড়ালে মায়া দাঁড়িয়ে ছিল। আনিস মায়া বলে ডাকতেই মায়া বের হয়ে বসার ঘরে আসে। মনজুর পাজামার গিঁট তাড়াহুড়ো করে লাগিয়ে ফিরে এল বসার ঘরে।
মায়া দাঁড়িয়ে আছে এক মিলিটারির পাশে। আনিসের সাথে কথা বলছে আরেকজন। সে বুঝল, একটা পরিষ্কার লেনদেন হতে চলছে। ওরা মায়াকে জিপে তুলবে না, যদি আনিস ওদের সাথে মদত দিতে রাজি হয়। তা না হলে যা হবে তার জন্য আনিস দায়ী থাকবে।
মায়ার দশ বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই মেয়ে ছাড়া আর কিছুই বোঝে না যে আনিস, সেই আনিস চুপ করে আছে।
মনজুর আনিসের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, হ্যাঁ বলো।
মিলিটারিরা মায়ার হাত ধরতেই আনিস বলে, আমার মেয়ে শুধু নয়, তোমরা এই পাড়ার কোনো মেয়েকে নেবে না। আমি তোমাদের সাথে থাকব।
এই মিলিটারির কি আনিসের তুখোড় উর্দু পছন্দ হয়েছিল, এমন একজন ইনফরমার তাদের দরকার এই অঞ্চলের খোঁজ রাখার জন্য। এ পর্যন্ত তার ইনফরমাররা বাংলা মিলিয়ে যে উর্দু বলে, তা সে আধা বোঝে, আধা বোঝে না।
মেজর ইমতিয়াজ এবার তার নিজের পরিচয় দিল এমনভাবে, যেন চাকরির নিয়োগপত্র দেবার সময় বুঝিয়ে দিচ্ছে সেই তার বস। সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলে, তুমি মাসে টাকা পাবে।
আমাকে টাকা দিতে হবে না। আনিস পরিষ্কার কণ্ঠে বলে।
মেজর রেগে গেল, না অবাক হলো, বোঝা গেল না। বলে, তুমি কী করো?
আমি কলেজে পড়াই। আমরা মাত্র দুজন। খরচ কম।
তাহলে তুমি বেতন নেবে না?
মেজর, আপনি বুদ্ধিমান ব্যক্তি। বেতন দেওয়া হয় যখন চাকরির আবেদন মনজুর করে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। আমি তো আবেদন করি নাই। আমাকে আপনি দেশের জন্য কাজ করতে বলছেন। সে ক্ষেত্রে বেতনের প্রশ্ন ওঠে না।
তাহলে তুমি পাকিস্তানকে ভালোবেসে কাজ করবে?
হ্যাঁ, আমার দেশকে ভালোবেসে কাজ করব।
মেজর তার ভারী গোঁফ ছুঁয়ে সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ঠিক হায়। তবে ইমান ঠিক রাখবে।
আনিস বলে, আমার ইমান ঠিক থাকবে।
মনজুর একটি অলিখিত নিয়োগপত্রের সাক্ষী হয়ে ভাবে, অন্তত এই মিলিটারির বুদ্ধি কম না। দাবার চাল সে ভালো জানে। যুদ্ধের বাজারে নারীর অভাব হয় না। তারও নেই। অথবা হতে পারে নারীর প্রতি আকর্ষণ কম। তার পরও তুলে নেওয়ার হুমকির কারণ, ওদের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার শক্তিশালী ঘুঁটি ছিল মায়া।
আনিসের শর্ত মেনে এ তল্লাটের কোনো মেয়েকে জিপে তোলেনি সেদিন, পরেও না।
মায়াকে ছেড়ে দিয়ে ওরা আনিসকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
সেই থেকে আনিসকে সকালে ওদের জিপ এসে নিয়ে যেত। বিকেলে বাড়ি পৌঁছে দিত।
ভাগ্য বলে যদি সত্যি কিছু থাকে, তবে ভাগ্য আনিসকে প্রতারণা করেনি। তিন মাসের মাথায় এক অপারেশনে এই মেজর মারা যায়। আনিস খুব ঠান্ডাভাবেই মনজুরকে যখন বলে, তখন মনে হয়েছিল, এমনটা ঘটবে তা যেন আনিস জানত। মনজুর জানার আগ্রহ দেখাতেই বলে, দেয়ালেরও কান আছে। তবে আমি কয়েক মাসের জন্য মায়াকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাব। ভয় করো না। আমি চাই আমাদের সাথে তোমরাও চলো। বেশি দিন থাকতে হবে বলে মনে হয় না।
নোমান যদি আসে?
ওকে একটা খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করব।
নোমান এক মাস বনগাঁ হাসপাতালে থেকে ফিরে আসেÑস্বাধীনতার পনেরো দিন পার করে। মায়া তখন প্রায় চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মায়া ছাদে বসে অপেক্ষায় ছিল। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে নোমানকে একান্তে দেখবে। বলবে, আমার তলপেটে হাত রাখো, ওর অস্তিত্ব টের পাবে।
নোমান আসেনি।
সেদিন না, পরের দিন না। কোনো দিন না। 
(চলবে)
 

কমেন্ট বক্স