যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রেসিডেন্টই নিজ নিজ নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কমবেশি এক্সিকিউটিভ অর্ডার জারি করে থাকেন। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। তথ্যমতে, জো বাইডেন তার শাসনামলে ১৬২টি, ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ২২০টি অর্ডার জারি করেন। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে রকম দ্রুততার সঙ্গে একের পর এক এক্সিকিউটিভ অর্ডার জারি করে চলেছেন, তাকে নজিরবিহীন বলা যায়। দায়িত্ব গ্রহণের দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি ৫০টির অধিক অর্ডারে স্বাক্ষর করেছেন। এভাবে চলতে থাকলে মেয়াদ শেষে এক্সিকিউটিভ অর্ডার জারির ক্ষেত্রে তিনি রেকর্ড স্থাপন করতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
এ পর্যন্ত ট্রাম্পের স্বাক্ষরিত অর্ডারগুলো তার সমর্থকদের কমবেশি প্রীত করলেও বহু মহলে সেসব অর্ডারের বেশ কয়েকটি তুমুল বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে, সেসব অর্ডারের বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়, যে কারণে তা নিয়ে বিভিন্ন আদালতে একাধিক মামলা রুজু হয়। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ফেডারেল আদালত ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল-সংক্রান্ত অর্ডারটি রহিত করার রায় দিয়েছে।
ট্রাম্প তার সিগনেচার ইমিগ্রেশন অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধভাবে প্রবেশকারীদের গণবহিষ্কারের লক্ষ্যে যেভাবে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এজেন্সিকে মাঠে নামিয়ে ধরপাকড় শুরু করেছেন, তা বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে সব অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাস ও ভীতির সঞ্চার করতে দেখা যায়, যে কারণে শ্বেতাঙ্গ ও ভালো ইংরেজি জানা মানুষ ছাড়া অন্য বর্ণের মানুষদের ফেডারেল এজেন্টদের দ্বারা গ্রেফতার ও হয়রানির আশঙ্কায় ঘরের বাইরে বের হতে কম দেখা যায়। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বেরোলেও তাদের অনেকে পাসপোর্ট ও আইডি সঙ্গে রাখছেন। তথ্যমতে, ইতিমধ্যে ১৫ হাজারের বেশি অভিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫ হাজারের বেশি মানুষকে নিজ নিজ দেশে ডিপোর্ট করা হয়েছে। বহিষ্কারের জন্য গ্রেফতারকৃত ২০০ অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীকে সম্প্রতি হাতকড়া ও শিকল পরিয়ে একটি সামরিক পরিবহন বিমানে করে ভারতের অমৃতসরে নামিয়ে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ভারতীয় অবৈধ অভিবাসী রয়েছে বলে জানা যায়। ভারত সরকার অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানালেও তাদের প্রতি সুআচরণের অনুরোধ করেছে।
ভারতের একশ্রেণির মোদি সমর্থক কর্তৃক মোদি-ট্রাম্প বন্ধুত্বের জিকির তুলে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের ড. ইউনূস সরকারকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার যে গালগল্প বিরামহীনভাবে প্রচার করে যাচ্ছে, চরম অপমানজনকভাবে ভারতীয়দের বহিষ্কারের ঘটনাটি তাদের জন্য ছিল চপেটাঘাত-স্বরূপ। মোদি-ট্রাম্প বন্ধুত্ব যে কেবল একটি বানোয়াট বয়ান মাত্র, তা ইতিমধ্যে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। মোদি সমর্থক ভারতীয়দের এটা বোঝা উচিত, মোদি বা ভারত নয়, মার্কিন স্বার্থই ট্রাম্পের কাছে মুখ্য বিষয়। কথায় বলে, পরের জন্য কুয়া খুঁড়লে সেই কুয়ায় নিজেকেই পড়তে হয়। সে জন্য ইউনূস সরকারকে হুমকি-ধমকি ও অপপ্রচার বন্ধ করে নিজের চড়কায় তেল দেওয়া ভারতীয়দের জন্য উত্তম হবে বলে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
ট্রাম্পের পূর্বঘোষিত মার্কিন ফেডারেল বুরোক্র্যাসি সংকোচন অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় কর্মচারী ছাঁটাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এসব এজেন্সির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা (USAI), এফবিআই, জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট ও সিআইএ অন্যতম। এসব এজেন্সির প্রায় কুড়ি হাজার কর্মীকে আট মাসের সমপরিমাণ বেতন দিয়ে ইতিমধ্যে বিদায় করা হয়েছে। সুখের বিষয়, USAID এর কর্মী ছাঁটাইয়ের কাজ একটি ফেডারেশন আদালতের আদেশে আটকে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্পের নবগঠিত ‘ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভনমেন্ট এফিশিয়েন্সির (DOGE) প্রধান ইলন মাস্কের তদারকিতে এসব ছাঁটাই কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। সংকোচন ও কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির পরিবর্তে প্রশাসন দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে অনেকের অভিমত।
ট্রাম্প বেশ কিছুদিন পূর্বে ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড ক্রয়, পানামার কাছ থেকে পানামা খালের পুনর্দখল ও কানাডা দখলের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন। অন্যের দেশ কবজা করার খায়েশের ধারাবাহিকতায় ট্রাম্প ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে সফরকারী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বিবি নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজার মলিকানা নেওয়ার ঘোষণা দেন, যা সারা বিশ্বকে রীতিমতো হতবাক করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিগত ৮০ বছরের পররাষ্ট্রনীতিতে ফিলিস্তিনে দুই রাষ্ট্র (ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন) প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সেই নীতিকে বাদ দিয়ে গাজার মালিকানা নেওয়ার পেছনে ট্রাম্পের এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। ট্রাম্প জানেন, বিগত দেড় বছরের যুদ্ধের ফলে গাজা এমনভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, সেই ধ্বংসস্তূপ সাফ করে সেখানকার বাস্তুচ্যুত ২৩ লাখ অধিবাসীকে সেখানে পুনর্বাসন করা দুঃসাধ্য ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দুরূহ হবে। তা ছাড়া সামনের দিনগুলোতে সেখানে যুদ্ধবিগ্রহ ও হানাহানি বন্ধের কোনো সম্ভাবনা না থাকায় গাজায় শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য ওই এলাকাকে ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান ও স্প্যানিশ রিভিয়েবার আদলে একটি আধুনিক পর্যটক নগরী তথা রিভিয়েরা অব দ্য মিডল ইস্ট (Riviera of the Middle East) হিসেবে গড়ে তোলাই শ্রেয় হবে, যেখানে বিশ্ব নাগরিকেরা বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট কিনে বা তৈরি করে শপিং ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রসৈকত, উপকূল ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আস্বাদ নিতে সক্ষম হবেন। এর ফলে গাজায় শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। রিভেয়েরা পুনর্গঠনকালে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের মিসর, জর্ডানসহ অন্যত্র বসবাসের জন্য স্থানান্তর করা হবে। স্পষ্টত রিভিয়েরার মতো ব্যয়বহুল ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বসবাসের এলাকায় উদ্বাস্তু শিবিরের হতদরিদ্র ফিলিস্তিনিদের ফিরে আসার সম্ভাবনা যে চিরতরে শেষ হয়ে যাবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ট্রাম্প জানান, মালিকানা নিলেও গাজায় মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির প্রয়োজন হবে না, যা পরে ওই এলাকাকে ইসরায়েলের কাছে হাস্তান্তরের ইঙ্গিতবহ। কয়েক বছর পূর্বে ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারও গাজা নিয়ে ট্রাম্পের অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। গাজা নিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে তার সমর্থকদের অনেকে ভিন্ন ধরনের একটি ধারণা (Out of the Box) হিসেবে ইতিবাচক মতামত দিলেও আরব বিশ্বসহ অধিকাংশ মহল এটিকে একটি ক্রেজি ধারণা হিসেবে বর্ণনা করেন।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের প্রবেশ রোধে একদিকে যখন দেয়াল নির্মাণসহ বহু ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তখন গাজা তথা অন্যের দেশ দখলের তার পরিকল্পনাকে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড (Double Standard) ছাড়া আর কীইবা বলা যায়। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা বাড়ানোর চিন্তা ট্রাম্পই প্রথম করেছেন, তা নয়। তার পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের অন্যতম থমাস জেফারসন ও জেমস ম্যাডিসন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধির (Expand the Sphere) পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। যুক্তরাষ্ট্রে বহু বছর ধরে প্রচলিত রীতি-ঐতিহ্যকে ট্রাম্প যেভাবে তছনছ করে দিতে চাইছেন, তা তার নিজের ও দেশের জন্য কতটা হিতকর হবে-সেটা নিয়ে ইতিমধ্যে বহু মহলে সন্দেহ ঘনীভূত হতে শুরু করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। ট্রাম্প ৭৭ মিলিয়ন মার্কিনির ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সত্য, কিন্তু সব মার্কিনির তার প্রতিটি অ্যাকশনের প্রতি সমর্থন রয়েছে-সেটা ভাবা ঠিক নয়।
লেখক : কলামিস্ট