আজ মন নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। মনোবিজ্ঞানের মতে, মানুষের মন একটা সমন্বয়ক। অর্থাৎ মানুষ তিনটি ডায়মেনশনে বেঁচে থাকে। বাস্তবিক ডায়মেনশন, মানসিক ডায়মেনশন ও আধ্যাত্মিক ডায়মেনশন। যেখানে হৃদয়ের স্পন্দন কম্পন সাড়ে সাত ফুট পর্যন্ত আর ব্রেনের স্পন্দন কম্পন সাড়ে সাত কিলোমিটার, সেখানে মনের স্পন্দন কম্পন পুরো গ্যালাক্সি ভেদ করে আরও বহুদূরে। আমাদের শরীরের অস্তিত্বের মধ্যে কোথাও মন নেই। হয়তো কথাটা শুনে অনেকেই মন খারাপ করবেন। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, জগতের সকল সম্পর্ক এমনকি বস্তু পর্যন্ত কোনো না কোনো মনের ওপর নির্ভরশীল ও অস্তিত্ববান। আর মন দিয়েই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ফুসফুসে যেমন বাতাস আসা-যাওয়া করে, হৃৎপিণ্ডে যেমন রক্ত প্রবেশ বাহির হয়, কিছুটা তেমনই ডান ও বাম ব্রেনের মধ্যবর্তী স্থান সম্ভবত ম্যালাথাস নামক গ্ল্যান্ডে ছায়ার মতো আসা-যাওয়া করে। যেখানে বিভিন্ন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত মানুষ ত্রিশূল বা তিলক আঁকে আর মুসলিম সেজদা করে। শ্বাস যেমন ফুসফুসে যে যতটা সময় ধরে রাখতে পারে, সে ততটা স্বাস্থ্যবান। তেমনি যে মন যতটা বেশি সময় নিজের মতো করে ধরে রাখতে পারে, সে ততটা ভাগ্যবান। তাই মনের সাধনা করার জন্যই মানুষ মোরাকাবা বা মেডিটেশন বা ধ্যান করে থাকে। মন বাস্তবিক আর স্প্রেচুয়ালিটির সঙ্গে সমন্বয় করে থাকে। তাই মনচর্চা একটি উত্তম কার্যক্রম।
তবু মন নিয়ে সহজ ভাষায় কিছু কথা আলোচনা করাই আমার আজকের প্রয়াস। মন দুই রকম কার্যক্রম করেÑএকটি চেতনায় অন্যটি অবচেতন। বড়ই বিচিত্র মানুষের মন। কল্পনার জগতে মন এক পঙ্খীরাজ ঘোড়া। যার কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিনতর বিষয়। মনের গতি-প্রকৃতি বোঝা অনেক কঠিন কাজ। বিবেকের কড়া শাসনকে উপেক্ষা করে সংযমের বেড়াজাল ছিন্ন করে মন ছুটে চলে তার আপন গন্তব্যে। এই চঞ্চল মন কখনো মানবকে নিয়ে যায় আলোর পথে আবার কখনো নিমজ্জিত করে গভীর অন্ধকারে। মানবের আচার-আচরণ সবকিছুর ওপর এই মনের একচ্ছত্র বিচরণ।
একটা সুন্দর মন অন্ধকারে আলোর মতো, যার মাধ্যমে কলুষতার মাঝেও নিজের অস্তিত্বকে মর্যাদাসম্পন্ন রাখা যায়। মন নিজের, নিয়ন্ত্রণ অন্যের। মনের দিক থেকে যে দুর্বল, কর্মক্ষেত্রেও সে দুর্বল। একটা মন আরেকটা মনকে খুঁজছে নিজের ভাবনার ভার নামিয়ে দেওয়ার জন্য, নিজের মনের ভাবকে অন্যের মনে ভাবিত করার জন্য। চিকিৎসকেরা যে ভুল করেন, তা হলো তারা মনের চিকিৎসা না করে শরীর সারাতে চান। যদিও মন আর শরীর অবিচ্ছেদ্য, তাই আলাদা করে চিকিৎসা করা উচিত নয়।
মন হলো সবচাইতে বড় তর্কশাস্ত্রবিদ। মন দিয়ে মন বোঝা যায়, গভীর বিশ্বাস শুধু নীরব প্রাণের কথা টেনে নিয়ে আসে। মানুষের মন যেদিনই ক্লান্ত হয়, সেদিনই তার মৃত্যু হয়। কুৎসিত মন একটি সুন্দর মুখের সমস্ত সৌন্দর্য কেড়ে নেয়। মনের কলুষতাই মানুষের আত্মা ও দৃষ্টিকে কদর্যতা দান করে এবং সেই কদর্যতাই নিজের এবং পরিবারের লোকদের জীবনকে বিভীষিকাময় করে তোলে। মনোচর্চা জীবনের সকল অবস্থায় সাফল্য এনে
দিতে পারে।
মনের ওপর কারও হাত নেই। মনের ওপর জোর খাটানোর চেষ্টা করা বৃথা। একটি মহৎ অন্তর পৃথিবীর সমস্ত মাথার চেয়ে ভালো। সব মানুষের মধ্যে একটি খোকা থাকে যে মনের কবিত্ব, মনের কল্পনা, মনের সৃষ্টিছাড়া অবাস্তবতা, মনের পাগলামিকে নিয়ে সময়ে-অসময়ে এমনিভাবে খেলা করতে ভালোবাসে। প্রাণের অবস্থাটি খুব কোমল করতে হবে। কাদামাটির ন্যায় মনকে গঠন করা চাই। তাহলে ওই মনের দ্বারা অনেক সুন্দর নতুন জিনিস প্রস্তুত হতে পারে। সফল হতে হলে মনের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়।
মানুষের মনের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো সংশয়, অবিশ্বাস আর সন্দেহ। বিশ্বে দুটি শক্তি রয়েছেÑএগুলো হচ্ছে অসি ও মন। কিন্তু পরিণামে এ দুইয়ের দ্বন্দ্বে মনের কাছে অসি শেষ পর্যন্ত পর্যুদস্ত হয়। মন যখন ঘুরে বেড়ায়, কান আর চোখ তখন অকেজো হয়ে দাঁড়ায়। দুর্বল দেহ মনকে দুর্বল করে দেয়। আত্মা কলুষিত হতে শুরু করলেই মন আকারে সরু হতে থাকে। সন্দেহপ্রবণ মন এক বৃহৎ বোঝাস্বরূপ। আমি তোমার চোখ দ্বারা দেখি কিন্তু বুঝি মন দ্বারা।
জীবন আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। মনের ওপর কারও হাত নেই, মনের ওপর জোর খাটানোর চেষ্টা করা বৃথা। পৃথিবীতে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আর মনকেই যদি নিয়ন্ত্রণ করা যেত, তাহলে দুঃখ কী জিনিস, তা মানুষ কখনোই বুঝত না। দোষ, গুণ, ভুল, ভ্রান্তি মিলেই মানুষের জীবন। অন্যকে ক্ষমা করার মতো মহৎ মন প্রত্যেকের থাকা চাই। যাকে তাকে গছিয়ে দেওয়ার নামই বিবাহ নয়! মনের মিল না হলে বিবাহ করাই ভুল। মন ধর্মের পূর্বগামী, মনই শ্রেষ্ঠ, সকলই মনোময়। সন্দেহপ্রবণ মন ভালো কাজের অন্তরায়। একটা সুন্দর মন অন্ধকারে আলোর মতো, যার মাধ্যমে কলুষতার মাঝেও নিজের অস্তিত্বকে মর্যাদাসম্পন্ন রাখা যায়। মনের অনেক দরজা আছে, সেখান দিয়ে অসংখ্যজন প্রবেশ করে এবং বের হয়ে যায়। তাই সবাইকে মনে রাখা সম্ভব হয় না। দুনিয়াতে মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নেই আর মানুষের মাঝে মনের চেয়ে বড় নেই। মন অনেক কিছুই চাইবে কিন্তু তা বিবেক দিয়ে বিচার করবে। তাহলেই তুমি বুঝবে কোনটা তোমার করা উচিত আর কোনটা করা উচিত নয়।
যে মন কর্তব্যরত নয়, সে মন অনুপভোগ্য। কেউ সময় অপচয় না করলে কমবয়সী মনটাও অনেক বড় হতে পারে। এমন মানবজনম আর কি হবে! মন যা করো তরায় করো এই ভবে। তোমার যদি পরিতৃপ্ত মন থাকে, তবেই তুমি জীবনকে উপলব্ধি করতে পারবে। মানুষের মনের ভাব কখনোই মুখে প্রতিফলিত হয় না। মুখের ওপর সর্বদা পর্দা থাকে। শুধু মানুষ যখন হাসে, তখন পর্দা দূরীভূত হয়। হাস্যরত একজন মানুষের মুখে তার মনের ছায়া দেখা যায়। মন খাঁটি না হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন। সন্দেহপ্রবণ মন ভালো কাজের অন্তরায়।
মানুষ দ্বিমনা। মানুষের ভেতরে দুটি মন আছেÑএকটা খোলা মন, অন্যটা ভালো মন। তার একটা অবজাত, অন্যটা অভিজাত। তাদের একজন ছোটলোক, অন্যজন ভদ্রলোক। পরিপূর্ণ আনন্দের সময় মানুষের মন ভিন্ন ভিন্ন দিকে ধায় না। একটা আনন্দ নিয়ে সে পড়ে থাকতে ভালোবাসে। মনের সৌন্দর্যকে যে অগ্রাধিকার দেয়, সংসারে সেই জয়লাভ করে। যে মনের দিক থেকে বৃদ্ধ নয়, বার্ধক্য তার জীবনে আসে না। মন যখন ঘুরে বেড়ায়, কান আর চোখ তখন অকেজো হয়ে দাঁড়ায়।
মনের মতো মানুষ ছাড়া সংসার করা আর ডাস্টবিনের পাশে বসে থাকা একই কথা। তুমি যদি মনের সজীবতা ধরে রাখতে চাও, তাহলে সবকিছুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে শেখো। শিশুদের মনটা স্বর্গীয় ফুলের মতোই সুন্দর। ভালো কাজ সব সময় করো। বারবার করো। মনকে সব সময় ভালো কাজে নিমগ্ন রাখো। সদাচরণই স্বর্গসুখের পথ। শক্ত মন আলোচনা করে ধারণা নিয়ে, গড়পড়তা মন আলোচনা করে ঘটনা নিয়ে, দুর্বল মন মানুষ নিয়ে আলোচনা করে। মনে পাপ থাকার এই একটা লক্ষণ। মনে হয়, সকলে বুঝি সব জানে।
মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত। যে মন সুখী এবং পরিতৃপ্ত, সেই মনই মহৎ। খাঁটি, সরল ও সুস্থ হচ্ছে সেই মন, যে ছোট-বড় সকল বস্তুকে সমভাবে গ্রহণ করতে পারে। অল্পবয়সী মনটা হিসাবে বড় হতে পারে, যদি যে সময় নষ্ট না করে। দুনিয়াতে মানুষের মনই বোধ হয় সবচেয়ে দুর্গম ও দুর্জ্ঞেয়। মনের সৌন্দর্যকে যে অগ্রাধিকার দেয়, সংসারে সেই জয়লাভ করে।
কল্পনা বাস্তবের অভাব পূরণ করে। উদ্ভট কল্পনায় মন ক্যাঙ্গারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। যেসব দৃশ্য আমরা খুব মন লাগিয়ে দেখতে চাই, সেসব দৃশ্য কখনো ভালোভাবে দেখতে পারি না, সেই সব দৃশ্য অতি দ্রুত চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়। আহত হৃদয় নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে, কিন্তু তাকে বাঁচা বলে না। মন যেন পিঞ্জরার পাখি। কল্পনায় সে ডানা মেলে উড়ে যায়। কল্পনা না থাকলে মানুষ অন্য জীবের মতো বাস্তবে বন্দী হয়ে থাকত। যদি তুমি কারও সঙ্গে তোমার ভাষায় কথা বলো, তার কাছে যেতে পারবে; যদি তার ভাষায় কথা বলো, তার হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারবে।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনের অনুভূতি পরিবর্তন হয়। আমার মনই আমার ধর্মশালা। মন যা চায় তা না পাওয়াই ভালো, আর তাহলেই মানুষ বোঝে না পাওয়ার বেদনা কী! মন দিয়ে মন বোঝা যায়, গভীর বিশ্বাস শুধু নীরব প্রাণের কথা টেনে নিয়ে আসে। যে মনের দিক থেকে বৃদ্ধ নয়, বার্ধক্য তার জীবনে আসে না। কৃতজ্ঞ কুকুর অকৃতজ্ঞ মানুষ অপেক্ষা শ্রেয়। যে দৃষ্টির সঙ্গে মনের যোগাযোগ নেই, সে তো দেখা নয়, তাকানো।
দুনিয়াতে মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নেই আর মানুষের মাঝে মনের চেয়ে বড় কিছু নেই। ভাবনাশক্তিই হলো অন্তরাত্মার দৃষ্টিশক্তি। যে মন কর্তব্যরত নয়, সে মন অনুভোগ্য। কুৎসিত মন একটি সুন্দর মুখের সমস্ত সৌন্দর্য কেড়ে নেয়। একটা সুন্দর মন অন্ধকারে আলোর মতো, যার দ্বারা অপবিত্র মাঝেও স্বয়ং সত্ত্বাকে সম্মানজনক রাখা যায়।
দুর্বল দেহ মনকে দুর্বল করে দেয় আর মন যদি চোখকে শাসন করে, তবে কখনো চোখ ভুল করবে না। জগতে আল্লাহ সুবাহান আল্লাহ তায়ালা যতগুলো নিয়ামত দিয়েছেন, তার মধ্যে মন একটা সর্বোত্তম নিয়ামত। আসুন সবাই মনকে কাজে লাগাই সর্বোত্তম ইতিবাচক চিন্তা-চেতনায়।