বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দীনতায় আজ এক অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে, উঠে আসার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। দলের প্রাণপুরুষের কন্যা গত ১৬ বছরে দলকে এতটাই নিচে নামিয়েছিলেন যে জনরোষ থেকে বাঁচতে তাকে দেশ থেকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে হয়েছে।
তার নেতাকর্মীদের মৃত্যু, পালিয়ে, খেয়ে না খেয়ে এক মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। গণমানুষের ঘৃণা এতটাই ভয়াবহ যে তার নিযুক্ত একজন ধর্মীয় আলেম, বায়তুল মোকাররমের খতিবকেও পালিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু তিনি বাস্তবতা উপলব্ধি না করে দিল্লির এক নিরাপত্তাবেষ্টনীর বাড়িতে বসে সীমাবদ্ধ গতিবিধির আওতায় মাঝেমধ্যে কিছু অপ্রয়োজনীয় ও অবাস্তব আস্ফালন করেন, যা দলের মঙ্গল না করে কর্মীদের আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। অবাক করার বিষয়, যে দলকে জনগণের দল বলা হতো, সে দল এখন জনগণের আস্থার পরিবর্তে নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আস্থা অর্জনে বেশি সচেষ্ট এবং তাই দেখে ভারতীয় এক সাংবাদিক আওয়ামী লীগকে বিজেপির বাংলাদেশ শাখা বলে অভিহিত করেছেন। যে নেতৃত্ব দলকে এই বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছে, সেই একই নেতৃত্ব ভুল স্বীকার করে দলকে গণমুখী করতে পারবেÑএ রকম কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি আওয়ামী লীগ কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না? তার আগে প্রশ্ন করা প্রয়োজন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কি দরকার আছে? আছে; বাংলাদেশে দ্বিদলীয় সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা ও ভবিষ্যতে নতুন কোনো স্বৈরাচারকে মোকাবিলার জন্য একটি আদর্শিক আওয়ামী লীগের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, সেটা নিয়েই একটি ব্যক্তিগত অভিমত।
যেকোনো সমাধান খোঁজার আগে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করাই যৌক্তিক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সমস্যা (১) শেখ হাসিনা স্বয়ং (২) রাজনীতির মাঠে দাঁড়ানোর প্রতিবন্ধকতা (৩) সৎ ও মুক্তচিন্তার নেতৃত্বের অভাব (৪) বঙ্গবন্ধু পরিবারের কাউকে খুঁজে পাওয়া।
শেখ হাসিনা : আওয়ামী লীগকে উঠে দাঁড়াতে হলে সর্বপ্রথম কাজ হবে শেখ হাসিনাকে তার অপশাসনের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো। দলের ৯০ শতাংশ নেতাকর্মীর শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্য থাকলেও বাস্তবতা ও দলকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মাইনাস হাসিনা আওয়ামী লীগ গঠন করে অন্তত দুই বছর ধৈর্য ধারণ করার মানসিকতা রাখতে হবে। তাদেরকে বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বর্তমানে সব ঘৃণা বা ক্ষোভ শেখ হাসিনার প্রতি। তার একক সিদ্ধান্তেই নির্বাচনগুলো ও বিচারব্যবস্থায় অনিয়ম, অর্থনৈতিক তছরুপ, ছাত্রহত্যা, গুম, খুন, বিরোধীদের প্রতি নির্মম অত্যাচার, ভারতের প্রতি অতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিষয় সংঘটিত হয়েছে। তা ছাড়া শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৮/৭৯, তিনি কত দিন শারীরিকভাবে সক্ষম থেকে দল পরিচালনা করতে পারবেন? যিনি গত ১৬ বছর ক্ষমতা, অর্থ, বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, সেখান থেকে একটি সীমাবদ্ধ জীবনে এসে নিজের ও পরিবারের লোকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, ভারত ছাড়া বিশ্বের কোথাও তাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি, জাতিসংঘের রিপোর্ট এতটাই নেতিবাচক যে, তিনি নেতৃত্বে থাকলে দলের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়া কঠিন হবে। এই তো সেদিন ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি বলে দিয়েছেন তার ক্ষমতাচ্যুতিতে আমেরিকার কোনো হাত ছিল না। তার মানে তাকে পুনর্বাসন করার কোনো দায়িত্ব আমেরিকার নেই। তা ছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগে নেতিবাচক রিপোর্ট রয়েছে, যে ঘটনা ঘটেছিল ২০১৮ সালে, ট্রাম্পের প্রথম শাসনামলে। সে সময় আমেরিকার একজন রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে ছাত্রলীগের ছেলেরা আক্রমণ করেছিল এবং শেখ হাসিনা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। ড. ইউনূসকে ডোনাল্ড ট্রাম্প অপছন্দ করেন, কিন্তু তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তিনি একটি কথাও বলেননি। তার বাংলাদেশকে মোদির হাতে তুলে দেওয়ার অর্থ এই নয়, মোদি সাহেব সামরিক অভিযান পরিচালনা করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে বসাবেন। ইউনূস সাহেব যা করছেন তা কোনো পাওয়ারফুল মহলের প্রেসক্রিপশনেই হচ্ছে। সুতরাং শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে আসবেন, এ রকম অলীক স্বপ্ন থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরত থেকে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
রাজনীতির মাঠে শারীরিক উপস্থিতি : একটি রাজনৈতিক দলকে টিকে থাকতে হলে মাঠে বা তৃণমূলে উপস্থিতি প্রয়োজন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ টিকে আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, মাঠে কেউ নেই বা নামা সম্ভবও নয়। মাঠে নামতে হলে প্রথমে প্রয়োজন জনরোষকে প্রশমিত করা। শেখ হাসিনা সরে দাঁড়ালে সেটা আস্তে আস্তে প্রশমিত হবে, তখন তৃণমূল নেতাকর্মীদের ড. ইউনূসকে বা অন্য কোনো বিরোধী দলকে সমালোচনা থেকে সরে গিয়ে অন্তত দুই বছর আত্মসমালোচনায় ব্যস্ত থেকে জনগণকে বোঝাতে হবে আওয়ামী লীগ একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে চায়। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত ফারুক খানের ফেসবুক পোস্টটি সে রকম একটি উদাহরণ হতে পারে। যদিও তিনি জেলে বসে সে রকম পোস্ট দিতে পারেন কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশের জেলে ফোন নেওয়া কোনো বিষয় নয়। তা ছাড়া তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদও আসেনি। আর রাজনৈতিক মাঠের অন্য শক্তিগুলোর কথাও মাথায় রাখতে হবে। তরুণ ছাত্ররা, বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামি দলের নিজেদের মধ্যে যে পার্থক্যই থাকুক, আওয়ামী লীগের বেলায় সবাই এককাট্টা হয়ে মাঠে নামবে। সুতরাং রাজনৈতিক মাঠে নামার জন্য ধৈর্য ধারণ ও আত্মসমালোচনা পর্বটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সৎ ও মুক্তচিন্তার নেতৃত্ব : শেখ হাসিনা বা রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণেই হোক, আওয়ামী লীগে কোনো সৎ ও মুক্তচিন্তার নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। তার মানে এই নয় যে আওয়ামী লীগে সে রকম লোকের অভাব। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের সকল নেতা-কর্মী জানেন, কারা আদর্শিক বা কারা সুবিধাভোগী। শেখ হাসিনা সরে দাঁড়ানোর পর ওই তৃণমূল কর্মীরাই সৎ লোকদেরকে সামনে আসার জন্য উৎসাহিত করতে তৎপর হতে হবে। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘ সময় যদি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বহীন বা আদর্শিক স্থান থেকে দিকনির্দেশনা দিতে না পারে, তাহলে কর্মীরা ক্রমশ নিষ্ক্রিয় বা
অন্যত্র চলে যাবে।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো সদস্য : এটা ঠিক, বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ নেতৃত্বে না থাকলে দলকে দীর্ঘ মেয়াদে ঐক্যবদ্ধ রাখা যাবে না। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এই সময়ে তাকে দায়িত্বে আনা সঠিক হবে না। যেহেতু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ এখন সীমিত, তাই সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, ড. আবদুর রাজ্জাক বা নারায়ণগঞ্জের আইভী রহমানÑএ জাতীয় লোকদের সামনে এনে দলের হাল ধরতে দেওয়া উচিত। এরপর যদি কখনো দলীয় কোন্দল ভাগাভাগির পর্যায়ে যায়, তাহলে ১৯৮১ সালের মতো পুতুলকে নিয়ে এসে শেখ হাসিনার মতো নেতৃত্বের পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যতই শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত থাকুক, দলকে বাঁচাতে হলে আবেগ ত্যাগ করে নতুন পথ খুঁজতেই হবে। সবচেয়ে কঠিন কাজটি শেখ হাসিনাকেই করতে হবে। তাকে বুঝতে হবে, তার পক্ষে স্বাভাবিক দেশে ফেরা অসম্ভব। তিনি যে দেশে ফেরার কথা বলছেন, তা হতে পারে ভারতের হস্তান্তর বা স্বেচ্ছায় দেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ। সেটি করতে গেলে দলকে আরও অগোছালো রেখে যাওয়া হবে এবং ইতিহাসে সব নেতিবাচক কথার পাশাপাশি সাহসিক মৃত্যুর কথাটাও হয়তো লেখা হবে। তার চেয়ে তিনি সঠিক কাজটি করে দলকে একটি দিকনির্দেশনা দিয়ে সরে যাওয়াটাই আওয়ামী লীগের এগোনোর রাস্তা। -নিউইয়র্ক