অভিবাসনের দ্বিতীয় ঘটনা ১৭৮০ সালে। আমেরিকা তখন পশম রফতানি করে চীনে। ফিরে যাওয়ার সময় কলকাতা থেকে নিয়ে যায় পাট ও কার্পাস। নিউইয়র্ক ও বস্টনে জাহাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেটের কিছু মানুষ। তাদের কেউ কেউ থেকে গিয়েছে সেখানে। বাড়ি বাড়ি আইসক্রিম কিংবা অন্যান্য পণ্য ফেরি করে বেড়ানোই ছিল তাদের জীবিকা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ১৯৪৭ সালে বিভাজিত হয় বাংলা। বাড়তে থাকা রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে জাহাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রেণি বের হয় নতুন সুযোগের সন্ধানে। বের হয় না বলে বের হতে বাধ্য হয় বলাই বোধ হয় অধিক যৌক্তিক। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে আর দু’চোখে নিরাপদ জীবনের স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল সেই আনকোরা জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। বলে রাখা ভালো, আমেরিকার ১৯২১ সালের অভিবাসন আইনে একটা সুযোগ রাখা হয়। কোনো নন-আমেরিকান যদি কোনো আমেরিকানকে বিয়ে করে, তবে তার জন্য আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করা বৈধ। এ সুবিধা লুফে নিয়েছিল বহু নন-আমেরিকান। বাংলাদেশিরাও কাজে লাগিয়েছে নিজেদের মতো করে।
পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকেই, অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকেই অভিবাসনের নতুন স্রোত শুরু হয়। স্বাধীনতার আগ দিয়ে ষাটের দশকে রাজনৈতিক উত্তাল মুহূর্তেও বিপুলসংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানি নিরাপত্তার আশায় আশ্রয় নেয় যুক্তরাষ্ট্রে। এ অভিবাসীদের মধ্যে সমাজের ওপর দিকের শ্রেণিটাই বেশি ছিল। বিশেষ করে, বাঙালি ছাত্র, ডাক্তার ও বিত্তবান ব্যক্তিরা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর শুরু হয় নতুন স্রোতোধারা। স্বাধীনতার পরও দীর্ঘ সময় দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল। গভীর হচ্ছিল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও। ফলে তরুণসমাজ ক্রমে আমেরিকায় নিজের ভবিষ্যৎ গোছাতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, আটলান্টা, ওয়াশিংটন ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো অঞ্চলে। অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
আশির দশকেই মোটামুটি নির্ধারণ হয়ে যায় অভিবাসনের গতিপথ। বদল যায় চালচিত্রও। এবার অভিবাসীদের অনেকেই পেশাজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রী। আশির দশকের প্রথম দিকে অভিবাসীরা ছিল প্রধানত ১০-৩৯ বছর বয়সী তরুণ শ্রেণি। ক্রমে তারা তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সেখানে নিতে শুরু করে। ক্যালিফোর্নিয়া, নিউজার্সি, নিউইয়র্ক, আটলান্টা, টেক্সাস ও ওয়াশিংটন মুখর হয়ে ওঠে বাঙালির পদধ্বনিতে। ক্রমে সহজলভ্য হয়ে ওঠে মসজিদ এবং হালাল মাংসের দোকান। আমেরিকার প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেই এখন কমবেশি বাঙালি বসবাস করে।
১৯৬৫ সালের ‘দি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট’ এ ক্ষেত্রে এশিয়া থেকে যাওয়া আমেরিকানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এর মধ্য দিয়ে ১৯২৪ সালের কিছু নিষেধাজ্ঞা বাতিল হয়ে পড়ে। সহজ হয়ে ওঠে পারিবারিক পুনর্মিলনের ধারণা। অর্থাৎ আমেরিকার কোনো নাগরিকের কোনো পারিবারিক সদস্য অন্য কোনো দেশে থাকলে তাকে আমেরিকার মূল স্রোতে নেওয়ার ধারণা। আশির দশক থেকে এখন অবধি এ পারিবারিক পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অনেক বাংলাদেশি গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। উদাহরণস্বরূপ, একটা তথ্য তুলে ধরা যেতে পারে। ১৯৯৬ সালে ৭৭১ জন বাংলাদেশি প্রবেশ করেছে পেশানির্ভর সুবিধায়। অন্যদিকে পারিবারিক পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েছে ৮ হাজার ২২১ জন। ২০০৪ সালে চালানো এক জরিপে দেখা যায়, ১৯৭১ থেকে ২০০২ সাল অবধি ৯৩ হাজার বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে, যারা আসলে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নয়।
১৯৬৫ সালের অ্যাক্টের কারণে অনেক বাংলাদেশি নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে নিজেদের আত্মীয়স্বজন নিয়ে গিয়েছে অভিবাসী হিসেবে। জায়গাগুলো এখন যেন অনেকটা বাংলাদেশি ছিটমহল। বিস্তৃত আমেরিকার গর্ভে বিন্দু বিন্দু বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী। সত্তর থেকে আশির দশকে এসব অঞ্চল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তেমন অগ্রসর ছিল না। পাঁচ বছর অবস্থান করলেই আমেরিকায় নাগরিকত্ব দাবি করা যায়; এই নীতিটিও অনুপ্রাণিত করেছে বাংলাদেশিদের। গ্রিনকার্ড হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা তোড়জোড় শুরু করে পরিচিত মানুষদের সেখানে নেওয়ার জন্য। এভাবেই ক্রমে বেড়ে চলছে অভিবাসন। ২০১০ সালে চাকরিসূত্রে আমেরিকা যাওয়া ৮২৭ জন অভিবাসীকে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ঠিক একই বছর ৪ হাজার ৯৩৫ জন আমেরিকান নাগরিকদের আত্মীয় হিসেবে, ৬ হাজার ৬ জন পারিবারিক সূত্রে, ২ হাজার ৮০০ জন ডিভিতে ও ১৭১ জন উদ্বাস্তু কিংবা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে আমেরিকা যায়। ফলে দেখা যাচ্ছে, পারিবারিক যোগসূত্র আমেরিকায় অভিবাসনে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে কাজ করছে।
নব্বইয়ের দশকে ডাইভারসিটি ভিসার (ডিভি) সুযোগ শুরু হয় বাংলাদেশিদের জন্য। এ সময়ে একসঙ্গে আমেরিকায় ঢোকে ৫ হাজার ৫৫ জন। অভিবাসনের নীতি অনুসারে প্রার্থীকে এর আগে আমেরিকায় থাকা কোনো নাগরিকের নাম উল্লেখ করতে হয়। এর ফলে প্রথমত, নিজ দেশের লোক খুঁজে বের করা একরকম বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য। দ্বিতীয়ত, সেখানে থাকা অভিবাসীদের মধ্যে গড়ে ওঠে নিজস্ব বন্ধন। এখন নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে ছোট্ট ছোট্ট বাংলাদেশি সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। অধিকাংশই কাজ করে গ্যাস ফিলিং স্টেশনে, মুদি দোকানে কিংবা ছোটখাটো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে।
বর্তমানে বাংলাদেশিরা আমেরিকার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল এশীয় জনগোষ্ঠী। যেখানে ভারতীয়দের বৃদ্ধি ৮৫ শতাংশ, পাকিস্তানিদের ১০০ শতাংশ; সেখানে বাংলাদেশিদের বৃদ্ধি ১৫৭ শতাংশ। আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে, ২০০০-১০ সালের মধ্যে আমেরিকায় বাংলাদেশি জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে বাংলাদেশিরা এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। তারা সেখানে গড়ে তুলেছে লিটল বাংলাদেশ। মূল স্রোতে মিশে না গিয়ে টিকিয়ে রেখেছে স্বাতন্ত্র্য। আমেরিকা তাদের কাছে যখন অভিবাসন ভূমি এবং চাকরি পাওয়ার জায়গা, লিটল বাংলাদেশ তখন স্বদেশের ঘ্রাণ ও মানসিক প্রশান্তি।
ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করা বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর বড় অংশ এসেছে ডিভির মাধ্যমে। কেউ চাকরিসূত্রে আবার কেউ পারিবারিক সংযুক্তি নিয়ে। একটা বড় অংশ ভাষাগত দক্ষতা না থাকার কারণে কাজ করে মুদি দোকানে। কেউ আবার দাঁড় করিয়েছে স্বতন্ত্র ব্যবসা।
লস অ্যাঞ্জেলেসে অধিকাংশ মানুষই বসবাস করে লা ফিয়েট, অক্সিডেন্টাল, হুভার স্ট্রিট, কমনওয়েলথ, ভার্জিল, ওয়েস্টমন্ট, নিউ হ্যাম্পশায়ার ও ডাউনটাউন অঞ্চলগুলোতে। বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের মাধ্যমেই বাংলাদেশিদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মুদি দোকানগুলো। যা-ই হোক, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় তাদের শক্ত শিকড় গজিয়ে উঠেছে। পুরুষেরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত হলেও নারীরা সাধারণত ঘর সামলানোর দায়িত্বেই থাকে।
তার পরও এসব জায়গার সঙ্গে অভিবাসীদের একপ্রকার গভীর আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে। সেখানকার সমাজে তারা নিজেদের আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত করতে প্রচেষ্টা চালায় অবিরত। উদাহরণস্বরূপ, ন্যাশভিলে পরিবারের সংখ্যাই সাকল্যে ৭০টি। অথচ তাদের অধিকাংশই ডাক্তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা উচ্চ পর্যায়ের চাকরিজীবী।
বাংলাদেশ স্বাধীনেরও পূর্বে জর্জিয়ায় আসেন আলী আহমেদ নামের এক ব্যক্তি। তিনি চট্টগ্রামের মানুষ। তিনি জর্জিয়ার সাভানাহ সমুদ্রবন্দরে এসে নামেন। সেখান থেকে তিনি জর্জিয়ার বাকেট শহরে বসবাস শুরু করেন। জর্জিয়ায় তিনিই প্রথম বাঙালি বলে ধারণা করা হয়। এরপর ওপি ওয়ান, ডিভি ভিসায় অনেকে এসেছেন। বর্তমানে ২০-২৫ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী জর্জিয়ায় বসবাস করে।