শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই উদ্বেগ ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু। এরই মধ্যে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু সাড়ে তিনশ ছুঁই-ছুঁই করছে আর আক্রান্ত হয়েছেন ৭২ সহস্রাধিক মানুষ। প্রতিরোধব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে পরিস্থিতি চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার ভয়াবহ হতে পারে বলে বছরের শুরুতেই সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এর পরও যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বর্তমানে সারা দেশেই ডেঙ্গু রোগী ব্যাপক সংখ্যায় বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই অবস্থায় দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে শঙ্কিত দেশবাসী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ডেঙ্গুর দ্রুত বিস্তারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। ৭ আগস্ট তিনি বলেন, দেশের সব জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। তার মতে, এডিস মশা নিধন কার্যক্রম শুধু ঢাকাতেই পরিচালনা করলে হবে না, সারা দেশেই এটি জোরদার করতে হবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। একই সঙ্গে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর গৃহীত ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছে সংস্থাটি। ৭ আগস্ট সোমবার দুপুরে মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক ফারহানা সাঈদের সই করা এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানানো হয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। ৮ আগস্ট মঙ্গলবার প্রেসক্লাবের সামনে মহিলা পরিষদ ঢাকা মহানগর শাখা আয়োজিত মানববন্ধনে এ তাগিদ দেন বক্তারা। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন কেবল বর্ষা মৌসুমের আতঙ্ক নয়। ফলে এর ভয়াবহতা বাড়ছে। এটি মোকাবিলায় দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর তৎপরতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও ব্যাপকভাবে সচেতন হতে হবে।
দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৭৪২ জন। আর এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে আরও ১৩ জনের। এর মাধ্যমে চলতি মাসের প্রথম আট দিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল ২০ হাজারের বেশি। আর চলতি বছরে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৭২ হাজার ২২৫। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে মৃত্যু হয়েছে ৩৪০ জনের। ৮ আগস্ট মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আলমিনা দেওয়ান মিশু নামের এক তরুণ নারী চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। ৭ আগস্ট সোমবার দিবাগত রাত সোয়া একটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে থাকাকালে মারা যান তিনি।
এর আগে গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়। ওই বছরে ২৮১ জনের মৃত্যুর কথা জানায় অধিদপ্তর। কিন্তু চলতি বছরের ৩ আগস্ট সে রেকর্ড ভেঙে যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবমতে, চলতি মাসের প্রথম আট দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০ হাজার ৩৯৩ জন, এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৮৯ জনের। গত জুলাইয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন, আর মৃত্যু হয়েছে ২০৪ জনের। তার আগের জুন মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৫ হাজার ৯৫৬ জন। সে সময় মারা যান ৩৪ জন। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন এবং মে মাসে ১ হাজার ৩৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। মারা যান জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন এবং এপ্রিল ও মে মাসে দুজন করে।
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রথম নজরে আসে ২০০০ সালে। এরপর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০১৯ সালে। সে বছর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫ এবং মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ড. আতিকুর রহমান জানান, ডেঙ্গু এখন সিজনাল নেই, সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটা বাড়ছে। গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ জুন মাস থেকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর মে মাস থেকেই আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিরোধক ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সব জায়গায় প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। একই সঙ্গে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তাহলে হয়তো রক্ষা পাব, না হলে ডেঙ্গু এবার মহামারি আকার ধারণ করতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, শক সিন্ড্রোমের কারণে বেশি মানুষ মারা যেতে পারে। তাই অবহেলা না করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর চৌধুরী বলছেন, মশা নিধনে শুধু জেল-জরিমানা আর জনসচেতনতা বাড়িয়ে কাজ হবে না। সঠিকভাবে জরিপ চালিয়ে দক্ষ জনবল দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।