২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-এর সেই ঐতিহাসিক দিনটির এক শাশ্বত সাক্ষী হয়ে মুষ্টিমেয় যে কজন আজও বেঁচে আছি, তাদের মধ্যে আমি একজন। আমি তখন ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনের দশম শ্রেণির ছাত্র। থাকি ঢাকার আজিমপুরের সরকারি কলোনিতে। তখন সেখানে ছিল সব তিন তলা আবাসিক ভবন। একেক ভবনে ছিল ১২টি করে ফ্ল্যাটবাড়ি, মোট ৪২টি ভবনে ছিল ৫০৪টি ফ্ল্যাট। অর্থাৎ ৫০৪টি পরিবারের বাসোপযোগী একটা আবাসিক এলাকা। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে ২০ তলা ভবন, একেকটি ভবনে সম্ভবত ৮০টি করে পরিবারের বসবাস। আধুনিকতার ছাপ রয়েছে সেই সব বিল্ডিংয়ে, তবে আবাসিক লোকসংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে একই ভবনে থেকেও আজ একজন আরেকজনকে চেনে না বললেই চলে।
আমাদের সময় তা ছিল না। আমরা পাড়াতো সখ্যে একসঙ্গে চলতাম, ফিরতাম ও খেলাধুলা করতাম, আড্ডা দিতাম, মুকুলফৌজ করতাম, ছাত্রসংঘ ও পাড়াতো লাইব্রেরি গড়তাম এবং বিভিন্ন সময়ে নাটক ও বিচিত্র অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করতাম। প্রায়ই একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম কলোনির ইমারতগুলোর সামনে পেছনের খোলামেলা মাঠগুলোতে। আর বর্তমানে যেখানে আজিমপুর গার্লস স্কুল গড়ে উঠেছে, সেখানের খোলামেলা এলাকাই ছিল আমাদের বড় মাঠ। আর খেলা দেখতে যেতাম বেশ দূরে ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশন বা ডিএসএ গ্রাউন্ডে। তখনো ঢাকায় স্টেডিয়াম গড়ে ওঠেনি। দলবেঁধে হেঁটে আজিমপুর থেকে যেতাম ডিএসএ গ্রাউন্ডে, যা ছিল বর্তমান জাতীয় স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। তখনো গুলিস্তান গড়ে ওঠেনি। বলাবাহুল্য, হেঁটে যাওয়া দূরত্বটা বেশ দীর্ঘ হলেও বন্ধুবান্ধবেরা দলবেঁধে হেঁটে যেতে খুব কষ্ট হতো না।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ডিএসএ গ্রাউন্ড থেকে একটা খেলা দেখে ফিরছিলাম দল বেঁধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোণে মেডিকেল কলেজ গেট, যেখানে এখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গড়ে উঠেছে, সেখানে পৌঁছাতেই দেখলাম, রিকশায় বসে একজন টিন পেটাতে পেটাতে ঘোষণা করে যাচ্ছে, আগামীকাল সকাল থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে (তখন মাইকের প্রচলন খুব ছিল না)। ১৪৪ ধারা যে কী, তা বুঝতাম না। তবে জানতাম, মিটিং-মিছিল করা যাবে না, একসঙ্গে চারজনের বেশি চলাচল করা যাবে না, করলে পুলিশ ধরে নিয়ে জেলে পুরবে ইত্যাদি। এদিকে ওইদিন সকালেই স্কুলে শুনে এসেছি পরদিন দেশব্যাপী হরতাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমাবেশ এবং সমাবেশ শেষে ছাত্ররা মিছিল করে বেরিয়ে ঘেরাও করবে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ ভবন, যা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মূল ভবন। সেখানে সেদিন মুখ্যমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা আসবেন। সেখানে তাদের আটক করে ছাত্ররা আদায় করবে তাদের দাবি- জেলে আটকে রাখা সকল রাজবন্দীর মুক্তি।
আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, ২১ ফেব্রুয়ারির সেই হরতাল করব, স্কুলে যাব না ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করব। তাই সরকারের এই ১৪৪ ধারা জারি ও মিটিং-মিছিল নিষেধের পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ি থেকে বেরোনোর মায়ের যে নিষেধাজ্ঞা জারি হবে, সেটার ভয় বেড়ে গেল। তবু সাবধানে মায়ের চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। নিচে এসে দেখলাম, আমার বাল্যবন্ধু মুহিব (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার) অপেক্ষা করছে। আমাদের আরেক বন্ধু সরফউদ্দীন (পরবর্তীকালে সিলেটের ছাতক পেপার মিলে কাজ করত) ও আজিমপুর কলোনির আরও কয়েকজন বন্ধুও এসে হাজির হলো। আমরা সবাই হেঁটে রওনা দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে।
পলাশী ব্যারাক দিয়ে হেঁটে রেললাইন পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনে। তখন তেজগাঁও থেকে রেললাইন ছিল নীলক্ষেত, পলাশী, বকশীবাজার, নাজিমউদ্দীন রোড হয়ে পুরোনো রেলস্টেশন ফুলবাড়িয়া হয়ে গেন্ডারিয়া ও সব শেষে নারায়ণগঞ্জ। পলাশী রেলগেট পাড়ি দিতেই চোখে পড়ল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রদের পিকেটিং। ওনারা আমাদের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এগোতে বললেন। আমারা তা-ই করলাম। আমরা তিনজন আলাদা হয়ে একসঙ্গে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর এগোতেই দেখলাম, প্রাদেশিক পরিষদ ভবন ঘিরে রেখেছে সশস্ত্র পুলিশ। আরও এগোলে মেডিকেল কলেজ গেট পাড়ি দিয়ে দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয় গেট পর্যন্ত কয়েক লাইন করে রাস্তার বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সশস্ত্র পুলিশ। আমরা ডান পাশ ধরে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধখোলা গেটে। আমরা একজন একজন করে আধখোলা গেট দিয়ে ঢুকে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। দেখলাম, ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সামনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ প্রায় ভরে গেছে এবং মিটিং শুরুর প্রস্তুতি চলছে।
আগেই বলেছি, সেদিনের সেই হরতাল ও ছাত্রসভার উদ্দেশ্য ছিল সরকারের কাছে জেলে আটকে রাখা রাজবন্দীদের মুক্ত করার দাবি জানানো। সেই মুক্তি আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা গাজীউল হককে আহ্বায়ক করে ১৭ সদস্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে সেই কমিটির মিটিংয়ে ঠিক হয় হরতাল করে ছাত্ররা প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমাবেশ করবে এবং সমাবেশ শেষে মিছিল করে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ ভবন ঘেরাও করে পেশ করা হবে ছাত্রদের দাবি- জেলে আটকে রাখা সকল রাজবন্দীর মুক্তি। সেই ঘটনাবহুল দিনের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের ওপর রাজবন্দীদের মুক্ত করার চাপ সৃষ্টি করা। রাজবন্দীদের মুক্তি আন্দোলনের এসব প্রস্তুতি দেখেই সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ঢাকা শহরে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করে মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয়।
সেই নিষেধাজ্ঞা শুনে ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ঢাকার বিভিন্ন ছাত্রাবাসে আলাদাভাবে মিলিত হয় ও সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা মেনে নেবে না। তারা ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল করবে এবং তাদের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা মিছিল করে প্রাদেশিক পরিষদ ভবন ঘেরাও করে তাদের দাবি আদায় করবে। যদিও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সেদিনের হরতালের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, তবু যেহেতু ইতিমধ্যে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’ গঠিত হয়েছে, তাই ছাত্ররা তাদের সিদ্ধান্তগুলো ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’কে জানিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল। সেদিনই সন্ধ্যার পর নবাবপুর আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে আবুল হাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সভায় ছাত্রদের সিদ্ধান্তগুলো জানিয়ে দেওয়া হয়। তবে সামনে নির্বাচনের সম্ভাবনা, আর তখন ১৪৪ ধারা ভাঙলে হাঙ্গামা হবে এবং সেই সুযোগে মুসলিম লীগ সরকার নির্বাচন বন্ধ করে দেবে। তাই ১৪৪ ধারা ভাঙা যাবে না বলে কর্ম পরিষদের অধিকাংশই মতামত জানালেন।
তবে সভায় উপস্থিত যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছাত্রনেতা অলি আহাদ দৃঢ় কণ্ঠে জানান, সরকারি আদেশ মেনে নেওয়া অর্থাৎ ১৪৪ ধারা না ভাঙার অর্থ হলো ভাষার দাবিরও কবর দেওয়া। তারা তাই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি হলেন না। তারা জানালেন, পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে ছাত্রসভা হবে, সেই ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে যদি রায় হয়, তবে তারা ভাঙার পক্ষেই থাকবেন। সেদিনই রাত ১২টার দিকে ফজলুল হক মুসলিম হল ও ঢাকা হলের মাঝখানের পুকুরের পূর্ব পাড়ের সিঁড়িতে বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ১১ জন নেতৃস্থানীয় ছাত্র চুপিসারে সমবেত হয়ে পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। সেই বৈঠকে আরও স্থির হয়, পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সভায় সভাপতিত্ব করবেন বিশ্ববিদ্যালয় রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক গাজীউল হক। ২১ ফেব্রুয়ারি তাই রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলনেই সীমিত হয়ে থাকল।
সন্দেহ হচ্ছিল, সরকার ২১ ফেব্রুয়ারির সেই সভা পণ্ড করার উদ্দেশ্যে সভার সঙ্গে জড়িত নেতাদের গ্রেফতার করে সেই রাতেই জেলে পাঠাবে। তাই সেই বৈঠকেই ঠিক হলো অনুষ্ঠানের পূর্বে যদি গাজীউল হক গ্রেফতার হন, তবে সেই সভায় সভাপতিত্ব করবেন এম আর আখতার মুকুল, আর মুকুলও যদি গ্রেফতার হন, তবে সভাপতিত্ব করবেন কমরুদ্দীন মসুদ। বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সভার শুরুতেই শামসুল হককে বক্তৃতা করতে দেওয়া হবে, যাতে তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সিদ্ধান্ত সবাইকে জানিয়ে দিতে পারেন। তারপর বক্তৃতা করবেন বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন)। সবশেষে সভাপতির ভাষণ দেবেন গাজীউল হক। ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত দেবেন তিনি। তবে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে সত্যাগ্রহী কায়দায় অর্থাৎ ১০ জন ১০ জন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে। এটাও ঠিক হলো, সত্যাগ্রহীদের প্রথম দলের নেতৃত্ব দেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র হাবীবুর রহমান শেলী। স্বল্পক্ষণ স্থায়ী সেই পুকুরপাড়ের বৈঠকে কোনো প্রকার বিতর্ক ছাড়াই নেওয়া হলো এসব ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।
ছাত্রনেতারা সে রাতে হলে বা হোস্টেলে নিজ নিজ রুমে না থেকে বিভিন্ন জায়গায় রাত কাটান ও পুলিশ আসার অনেক আগেই পৌঁছে যান বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। আর গাজীউল হক তো আগের রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে আত্মগোপন করে থাকেন পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে অস্ত্রধারী পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি সত্ত্বেও আমরা হাজির হলাম যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। প্রায় সাড়ে ১১টায় শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সেই ঐতিহাসিক সভা। সবাই দাঁড়িয়ে ছিল, তবে আমরা যারা ছোট ছিলাম, তাদের বড় ভাইয়েরা সামনে বসিয়ে দিলেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সভাপতি হিসেবে গাজীউল হকের নাম প্রস্তাব করলেন এম আর আখতার মুকুল, সমর্থন জানালেন কমরুদ্দীন মসুদ। আগেকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমেই ডাকা হলো শামসুল হককে তার বক্তব্য পেশ করতে এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সিদ্ধান্ত সভাকে জানিয়ে দিতে। তার পরপরই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ১৪৪ ধারা ভাঙার সপক্ষে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখলেন আবদুল মতিন (ভাষা মতিন)। সেদিনের শেষ বক্তা ছিলেন ঐতিহাসিক সেই ছাত্রসভার সভাপতি গাজীউল হক। সভাপতির ভাষণে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ১৪৪ ধারা ভাঙার ঘোষণা দিলেন।
ঘোষণা করা হলো ১০ জন ১০ জন করে শান্তিপূর্ণভাবে সত্যাগ্রহ কায়দায় ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। সঙ্গে সঙ্গে সত্যাগ্রহী দল গঠনের কাজ শুরু হয়ে গেল। আগের রাতের ফজলুল হক হলের পুকুরঘাটের সিঁড়ির মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক হাবীবুর রহমান শেলীই প্রথম সত্যাগ্রহী দল নিয়ে বেরিয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের আধখোলা গেট দিয়ে। দ্বিতীয় দলটি নিয়ে বেরিয়ে যান ইব্রাহিম তাহা, ডা. আজমল ও আবদুস সামাদ এবং তৃতীয় দল নিয়ে বেরোন আনোয়ারুল হক খান। তিনটি দলের সবাইকেই গ্রেফতার করে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। এমন সময় পুলিশের তরফ থেকে গেটের দিকে হামলা ও লাঠিচার্জ শুরু হয়। লাঠিচার্জের পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তে একটু রদবদল করা হয়। ঠিক হয় চতুর্থ দলটিতে যাবে কেবল মেয়েরা।
তখন মহিলা পুলিশ ছিল না। তাই পুলিশ হয়তো মেয়েদের কিছুটা হলেও ছাড় দেবে, এই ছিল সেদিনের ছাত্রনেতাদের মনে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রীদের যে দলটি বের হলো, তার নেতৃত্ব দেন সাফিয়া খাতুন। সেই দলে ছিলেন সুফিয়া ইব্রাহীম, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন নাহার, হালিমা খাতুন, ডা. শরীফা প্রমুখ। কিন্তু পুলিশ কোনো বাছবিচার না করে মেয়েদের ওপরও লাঠিচার্জ করল। আহত হলেন সুফিয়া ইব্রাহীম ও রওশন আরা বাচ্চু। মেয়েদের গ্রেফতার না করলেও পরবর্তী সত্যাগ্রহী দলগুলোর ওপর পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে এবং প্রায় সবাইকে ট্রাকে উঠিয়ে জেলে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট ও অভ্যন্তরে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে। লাঠিচার্জ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার কারণে ছাত্ররা আরও মারমুখী হয়ে ওঠে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের মাঝখানের দেয়াল ডিঙিয়ে মেডিকেল কলেজ গেটের দিকে চলে যায়। সেখান থেকে ছাত্রদের লক্ষ্যস্থল অ্যাসেম্বলি ভবন অর্থাৎ জগন্নাথ হলের মূূল ভবন আরও কাছে পড়বে, তাই।
তবে সেখানে পুলিশ তাদের আবার বাধা দেয়। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগ এলাকা, যেখানে তখন ছিল অসংখ্য তরজার ব্যারাক, সেই এলাকা সম্পূর্ণ ছেয়ে যায়। ভাগ্যিস, সেদিন হরতাল থাকায় রোগীর ভিড় ছিল না। ডাক্তার-নার্সরা মেডিকেল কলেজের ভেতরে আশ্রয় নেন। আমরাও সেদিন মেডিকেল কলেজে ঢোকার পর আশ্রয় নিয়েছিলাম মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগের বারান্দায়। কাঁদানে গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে অশ্রুসজল চোখে মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি রুমের বারান্দায় পৌঁছাতেই দেখলাম, ট্রে ভর্তি তরল প্যারাফিন নিয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সবার চোখে ফোঁটা ফোঁটা করে ওষুধ দিচ্ছেন। আমাদের চোখেও ওষুধ দিলে চোখের জ্বালাটা আস্তে আস্তে কমে এল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আমাদের ছোট দেখে ইমার্জেন্সি রুমের বারান্দায় একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে আবার চোখে ওষুধ দিয়ে আমাদের বললেন, মেডিকেল কলেজের গেটের বাইরে গোলমাল চলছে, পুলিশ গোলাগুলি ছুড়ছে, তাই আমরা সেখান থেকে যেন না বেরোই। তাদের কথামতো আমরা সেখানেই বসে থাকি।
আমাদের সেই অপেক্ষালগ্নে ঢাকার মাটি লাল হয়ে যায় ভাষার দাবিতে। পুলিশ গুলি চালায়, শহীদ হন আবুল বরকত, রফিক ও নাম না-জানা ১২-১৩ বছরের এক কিশোর। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ব্যারাক হয়ে ওঠে এক পুণ্যভূমি। শহীদের রক্তে সেদিনের রাজবন্দী মুক্তির দাবি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে পরিণত হয়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে শহীদের রক্তস্নাত সেই পুণ্যস্থানজুড়ে পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছে আজকের শহীদ মিনার, সংগ্রামী বাঙালির মুক্তির প্রতীক, যা আজ প্রতিবছরই ২১ ফেব্রুয়ারিতে ফুলেল সাজে সাজিয়ে লাখ লাখ বাঙালির অর্ঘ্য নিবেদনের এক পুণ্য বেদিতে পরিণত করে। সেদিনের সেই আত্মদানের প্রতি জানায় সশ্রদ্ধ সম্মান। আজ থেকে তেহাত্তর বছর আগে সেই সংগ্রামী দিনগুলোতে যারা সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যাদের অনেকেই আজ আর নেই। তারা বা আর যারা অনুল্লেখিত রয়ে গেলেন, তাদের সবার প্রতি আজ কৃতার্থচিত্তে নিবেদন করি একুশের শ্রদ্ধাঞ্জলি। আর সেদিনের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে থাকা মুষ্টিমেয় আমরা যে কজন বাংলার বিপ্লবী ইতিহাসের পরম লগ্নের সেই ঘটনাবহুল দিনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম, তারা সেদিনের সেই বিদ্রোহীদের সহগামী হওয়ার সৌভাগ্য পাওয়ায় নিজেদের ধন্য ও কৃতার্থ বোধ করছি।
লেখক : ভাষাসৈনিক