ঠিকানা ৩৫ বছরের পথচলা শেষে ৩৬ বছরে পা রাখল। ১৯৯০-এর উত্তাল সময়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ঠিকানার জন্ম। জন্মলগ্ন থেকেই মানুষের, বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালিদের গভীর ভালোবাসা নিয়ে পথচলা শুরু করে। এখন ভরা যৌবন ঠিকানার। যুদ্ধে যাওয়ার সময়। কিন্তু ঠিকানা জন্মকাল থেকেই যুদ্ধ করে আসছে। কিছু বৈরী মানুষ শৈশবকাল থেকেই ঠিকানাকে গলাটিপে মারতে চাইলেও সব সময় প্রবাসের সৎ ও সাহসী মানুষেরা চারপাশে শিল্ড তৈরি করে ঠিকানাকে সঠিক নিশানায় চলার পথ করে দিয়েছে। যাক, আজ জন্মদিনের শুভক্ষণে কোনো কুকথা নয়। আজকের এই দিনে কেবলই সাফল্যের কথা, ৩৫ বছরে এগিয়ে চলার গল্প।
প্রতিবছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। তাই কিছু পোশাকি ও প্রচলিত কথা দিয়েই দায় সারা যায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সম্পাদকীয়র। কিন্তু ঠিকানা কোনো দিন দায়সারা কাজ দিয়ে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করেনি, সম্পাদকীয়র দায়ও সারেনি এ-যাবৎকাল। ঠিকানা যেমন তার অতীত পথচলার ঐতিহ্যই কেবল রক্ষা করেনি, সঙ্গে তার দায়িত্ব পালনের পথচলার কথাও স্মরণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি অর্জন করেছে। ঠিকানা কর্তৃপক্ষ, সেই সঙ্গে তার সাংবাদিক কর্মীদল সব সময় বিশ্বাস রেখে চলে, পাঠকের চাহিদা কখনো এক বিন্দুতে স্থির থাকে না। পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ী সকলেরই স্বাদ, দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিনিয়ত পাল্টায়। সেদিকটি একটি পত্রিকায় কর্মরত সবাইকে মনে রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
ঠিকানা এ কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে এখনো করে চলেছে বলেই বর্তমান সময়ের অনিবার্য অনেক চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করা সম্ভব হয়ে উঠছে। বর্তমান সময়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রযুক্তিকে মোকাবিলা করা। বিজ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতি মানবসভ্যতাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে-বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের এত এত বিস্ময়কর অগ্রগতি ড্রোন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেখেই আমাদের বিহ্বল অবস্থা, এরপর আমাদের অবস্থা কী হবে, তা এ সময়ে কল্পনা করাও অসম্ভব বলে মনে হয়। কাগজ, কালি আর ছাপার মেশিনের প্রথম যুগের ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত সংবাদপত্র বা সন্দেশ সমাচার রক্ষা করার আজ আমাদের ওপর যে দায়িত্ব পালনের চ্যালেঞ্জ, সেটা গ্রহণ করেই আমরা সংক্ষুব্ধ সময়ে এগিয়ে চলার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। এ লড়াইয়ে আমরা বিজ্ঞানমনস্ক অনেক শুভানুধ্যায়ীকেও সঙ্গে পাচ্ছি। যদি এমন শুভানুধ্যায়ী আমাদের সঙ্গে থাকে, তবে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সামনের যেকোনো চ্যালেঞ্জও আমরা মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে পারব এবং এও বিশ্বাস করি, বিজ্ঞানের অগ্রগতির মধ্যে আজকের সংবাদপত্র, ছাপাখানারও রূপান্তর ঘটবে। সেদিন আজকের আমরা কেউ না থাকলেও আমাদের উত্তর প্রজন্ম আমাদের আজকের লড়াইকে সমীহ ও নতচিত্তেই স্মরণ করবে।
এবার ঠিকানার প্রতিষ্ঠাকালের বাস্তবতা এবং সে সময়ে বাঙালি প্রবাসী জনগোষ্ঠীর চাহিদা কেমন ছিল, এসব বিবেচনায় নিয়ে বাঙালির প্রথম আত্মোপলব্ধি ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলন যে চেতনায় ঘটেছিল, সেই চেতনাই হবে ঠিকানার মৌল চেতনা-এমন বিশ্বাস নিয়েই ঠিকানা প্রকাশের তাগিদ বোধ করেন ১৯৯০ এর টগবগে তরুণ এম এম শাহীন। সঙ্গী হিসেবে পান আরও কিছু সৎ, অনুপ্রেরণাদায়ী স্বজন ও বন্ধু। তার মধ্যে অন্যতম অগ্রজ কীর্তিমান সাঈদ-উর-রব; যিনি পরবর্তীকালে ঠিকানার সম্পাদকীয়’র দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করেন এবং ঠিকানাকে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে দেন। কর্তৃপক্ষের দূরদৃষ্টি এবং সুনিপুণ দক্ষতায় ঠিকানা আজও তার লক্ষ্যে স্থির। সে কারণে মানুষের অন্তহীন ভালোবাসায় আজও সিক্ত।
ঠিকানার প্রকাশকালের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায়, প্রবাসী স্বজনেরা সেসময়ে অনেকটাই দিশেহারা। নতুন দেশ, নতুন সমাজ। স্বজনবিচ্ছিন্ন প্রবাসীদের দিকনির্দেশনার কেউ নেই। তখন ঠিকানা বাতিঘরের মতো দূরবর্তী অন্ধকারে আলো ফেলে প্রবাসীদের জন্য সম্ভাবনার সকল দুয়ার খুলে দেয়।
নতুন প্রবাসীরা সাধারণত কর্মসংস্থান, আশ্রয়স্থল (বাড়ি ভাড়া, বাড়ি ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের সন্ধান), বিনোদনের অভাব অনুভব করেন সবচেয়ে বেশি। সেই সঙ্গে থাকে ভাষার জটিলতা। এসবের সহজ সমাধান দেখাতে পারে প্রকৃতই একটি প্রবাসীবান্ধব সংবাদপত্র। সেই হাহাকার এবং চাহিদা কিঞ্চিৎ হলেও মেটাতে পারে একটি প্রকৃত সংবাদপত্র। প্রবাসীদের এসব মৌলিক চাহিদা মেটানোর আকাক্সক্ষা নিয়ে ১৯৯০ সালে আত্মপ্রকাশ করে ঠিকানা। কিন্তু এত সব নিয়েও চিত্ত শান্ত হয় না। আরও বৃহত্তর পরিসরে জনগণের সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশু ঠিকানার সব দায়িত্ব অগ্রজ সাঈদ-উর রবের হাতে তুলে দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়ে সপরিবারে চলে যাই তার নাড়িপোঁতা মাটি কুলাউড়ায়। ঠিকানা প্রকাশের মতোই জানপ্রাণ সঁপে দেই সেখানকার জনগণ তথা সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের কিছু মানুষের বৈরিতা মোকাবিলা করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে উঠি। তবু লড়াইয়ের ময়দান ছাড় না। ঠিকানাও এদিকে বৈরিতা মোকাবিলা করে করে এগিয়ে যায়। কোনো বৈরিতাই ঠিকানার অগ্রযাত্রা রোধ করতে পারে না। সাঈদ-উর-রবের সুদৃঢ় নেতৃত্ব, সুচিন্তিত পরিচালনা এবং সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মীদলকে পরিচালনার দক্ষতা ঠিকানাকে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী যাত্রার সক্ষমতা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এখন আবার আমি দায়িত্বভার বুঝে নিয়েছি ঠিকানার। এখন সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার জগতে অনেক ওলট-পালট ঘটে গেছে। কিন্তু ঠিকানা তার লক্ষ্য ঠিক রেখে তার অগ্রসরমানতা অক্ষুণ্ন রেখেছে।
অনেকেই এত কঠিন বৈরী সময়েও ঠিকানার অগ্রগতির রহস্য জানার কৌতূহল প্রকাশ করেন। না, কোনো জাদুমন্ত্র নেই ঠিকানার সাফল্যের পেছনে। কেবলই কর্মরত সবার সততা, আন্তরিকতা এবং ঠিকানার প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য। ঠিকানা একুশের জাতক। একুশ বাঙালিকে কারও কাছে মাথা নত না করার শিক্ষা দিয়েছে। একুশের চেতনায় শাণিত ঠিকানা কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করে না। কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। যারা একুশের অঙ্গীকারে অটল, তারা অজেয়। ঠিকানা একুশের আলোয় আলোকিত। ঠিকানা সত্যের কাছে বিনয়ী। মিথ্যার কাছে তেমনি নির্মম, কঠিন। ঠিকানা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সব মানুষকে সম্মান করে চলে। তাই তো ঠিকানার শির উঁচু। বুক টান। ঠিকানার কাছে পাঠকের স্থান, সত্যের স্থান সবার উপরে। তাই তো সৎ ও সাহসী মানুষ ঠিকানার সাথিÑআজ, আগামীকাল এবং তারপরও।
ঠিকানার এগিয়ে চলার আরও একটি রহস্য, দেশ ও বিদেশের সমসাময়িক ঘটনাকে গুরুত্ব দেওয়া। তাই তো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ, দেশে দেশে টানাপোড়েন ঠিকানার দৃষ্টি থেকে বাদ যায় না। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের যে নাভিশ্বাস, মানুষের যে বিড়ম্বনা, তাও উঠে আসে ঠিকানার সাংবাদিকদের কলমে। ঠিকানার চৌকস সাংবাদিকদের চোখে ধরা দেয় আমেরিকার নির্বাচন, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ। তার ১৬ বছরের শাসনের অবসান। ঠিকানায় স্থান পায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরাখবর থেকে নাগরিক জীবন, খেলাধুলা, বিনোদন সবকিছু। তাই ঠিকানার দুর্বার এই পথ আজও অব্যাহত। আমাদের প্রত্যাশা-ঠিকানা কোন দিন লক্ষ্যচুত হবে না, ঠিকানার প্রতি তার পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ীদের আশীর্বাদধারা চিরদিন বর্ষিত হবে। ঠিকানা প্রবাসস্বজনদের পত্রিকা হয়ে মানবিকতা ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা থেকে কখনো বঞ্চিত হবে না।
ঠিকানা ৩৫-৩৬ বছর নয়, একদিন শতাব্দী স্পর্শ করবে। সেদিন আমরা থাকব না, কিন্তু আমাদের পূর্বসূরিরা থাকবে। তাদের স্মরণে আমাদের মতো পূর্বসূরিরা হয়তো একটু জায়গা পাবে। তাদের স্মরণে আমরা সার্থক হব, ধন্য হব। ঠিকানার এই ৩৬ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ীসহ প্রবাস ও স্বদেশের সব স্বজনকে ভালোবাসা, শুভেচ্ছা, অভিনন্দন। সহকর্মী সবাইকে শুভেচ্ছা।