এবিএম সালেহ উদ্দীন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপমহাদেশের রাজনীতিতে একজন সর্বালোচিত নাম। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। বহু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে তিনি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন এবং বাংলাদেশ স্বাধীনের বহু আগেই তিনি (পাকিস্তান আমল থেকে) ভারতবর্ষের একজন আলোচিত রাজনীতিক হিসেবে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ স্বাধীনের মধ্য দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা হিসেবে খ্যাতিমান ও প্রতিষ্ঠিত হন।
রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা ও মেধা ছিল প্রখর। গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাঁর চৌকস নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম বেগবান হয়। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সবচেয়ে সার্থক ও সফল নেতা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও তিনি ছিলেন শক্তিশালী এবং খ্যাতিমান। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মুক্তির জন্য লড়াই করেন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের পর ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
কিন্তু পাকিস্তানি শাসকবর্গ আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে গড়িমসি করতে থাকে। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালাতে থাকে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন শহরে গণহত্যা চালায় এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। অতঃপর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমগ্র দেশব্যাপী সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ শহীদের ত্যাগ ও রক্তস্রোতের মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
দেশ স্বাধীনের পর পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে তথা নিজের স্বভূমিতে ফিরে আসার পর তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জননেতা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা বুঝে নেওয়ার পর তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সর্বোত চেষ্টা করেন। সদ্য স্বাধীন দেশটিকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করার জন্য প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যান। তাঁর নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ‘আন্তর্জাতিক সংস্থা কমনওয়েলথ’ এর সদস্যপদ লাভ করার চেষ্টা করে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু বহির্বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করতে শুরু করেন। তাঁর মাঝে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় ও আলাপ-আলোচনায় অনুপম দক্ষতা লক্ষ করা যায়। কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভের পর বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭৩ সালে এই সম্মেলনে যাওয়ার সময়ও তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনদানকারী বন্ধুদের কথা ভোলেননি। তাই অটোয়া যাওয়ার পথে বেলগ্রেডে প্রেসিডেন্ট টিটোর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য যুগোস্লাভ সরকারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। টিটো শুধু যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্টই নন, তিনি ছিলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি। নেহরু, নাসের, সুকর্ণর সঙ্গে তাঁর নামও সমস্বরে উচ্চারিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের এককালের নেতা স্তালিনের সঙ্গে আদর্শগত বিরোধের পর সামরিক জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসেরের সঙ্গে একযোগে নিরলস ভূমিকা রাখেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিসমূহের প্রতি বিশ্বাসী এবং একাত্মতার ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে সেসব নীতির সমর্থক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট টিটো তথা যুগোস্লাভ সরকারের সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এসবকে তিনি তাঁর সুষ্ঠু বিবেকবোধ ও নীতিনিষ্ঠার অপরিহার্য অংশ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
কমনওয়েলথ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থন করতে পাকিস্তানসহ বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র বিরোধিতা করে। পাকিস্তানের সুরে নাইজেরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াকুব গওন সরাসরি বিরোধিতা করেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ করলে তার দেশের বায়াফ্রার স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে বলে সে দেশের রাষ্ট্রনায়ক ইয়াকুব ছিলেন ভীতসন্ত্রস্ত। একবার তিনি বঙ্গবন্ধুকে একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্নও করেন : ‘আচ্ছা বলুন তো, অবিভক্ত পাকিস্তান ছিল একটি শক্তিশালী দেশ, কেন আপনি সেই দেশটিকে ভেঙে দিতে গেলেন?’
স্বভাবসিদ্ধ হাসি দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর নীরবতা ভাঙলেন। হাসির ফাঁকেই বঙ্গবন্ধু ঠিক করেছিলেন উত্তরটি। তিনি তর্জনী সংকেতে গম্ভীরভাবে বলেন, ‘শুনুন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনার কথা হয়তো-বা ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়তো শক্তিশালী ছিল, তবে তার চেয়েও শক্তিশালী ছিল অবিভক্ত ভারত। সেসবের চেয়েও শক্তিশালী হতো সংঘবদ্ধ এশিয়া, যদি মহাশক্তিশালী হতো একজোট এই বিশ্বটি।’
এ কথাটি বলেই তিনি নিজের গলার সাদা চাদরটি হাতে নিয়ে তুলে দিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াকুব গওনের হাতে।
তিনি বললেন, ‘এই নিন, বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে আমার এই ক্ষুদ্রতম উপহার।’
তখনো নাইজেরিয়া বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। বঙ্গবন্ধু জোর আশা প্রকাশ করলেন, কমনওয়েলথে সরকারপ্রধানরা, পাকিস্তানিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং দুই দেশের মাঝে সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনাকে সরকারিভাবে ব্যক্ত করবেন।
বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি ও খ্যাতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠালাভের আরেকটি কারণ ছিল গণমানুষ। গণমানুষের স্বাধীনতা, মুক্তি ও অধিকার আদায়ের প্রত্যয়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেটিকে আজীবন ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধু অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী অখণ্ড ভারতের কণ্ঠস্বর শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের গণমানুষের স্বার্থে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিলেন।
গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতিতে যোগদান করে বঙ্গবন্ধু একজন বিশ্বাসী ও নিবেদিতপ্রাণ অনুজপ্রতিম বিশ্বস্ত ও বিশ্বাসী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী যেমন তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি, জমিদারিসহ সমস্ত অর্থ-সম্পদ সাধারণ মানুষের স্বার্থে বিলীন করে দিয়ে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সাধারণ মানুষের কাতারে চলে এসেছিলেন; মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সঙ্গেও বঙ্গবন্ধু একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর দুই মহান রাজনৈতিক গুরু মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো তিনিও তাঁর সর্বস্ব রাজনীতির পথে ব্যয় করেছেন। তাঁদের মতো বঙ্গবন্ধুরও আন্তর্জাতিক পরিচিতি শুরু হয়েছিল সেই তখন থেকে।
রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর ছিল অসাধারণ প্রজ্ঞাবোধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ অবদান আছে। আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যে তারা অবশ্যই অবিস্মরণীয়। কিন্তু দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণ রাজনীতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং পাকিস্তান যুগে রাজনৈতিক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। পূর্বসূরি নেতাদের মতো বঙ্গবন্ধুও তাঁর সমগ্র জীবন গণমানুষের স্বার্থে ব্যয় করেছেন।
জনগণের মাঝে স্বস্তি-শান্তি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি সংগ্রামের (রাজনৈতিক) মাঠে বঙ্গবন্ধুকে অনেক প্রতিবন্ধকতা ও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে (১৯৬৬) গণঅধিকারমূলক একটি যুগান্তকারী ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির শীর্ষে উঠে আসেন। দক্ষিণ এশিয়ায় সেটি ছিল গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার সনদ।
জনগণের মৌলিক অধিকারের আন্দোলন ও সংগ্রামে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে বহুবার জেল খেটেছেন। একসময় আন্দোলনের ক্ষিপ্রতা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১ নম্বর আসামির তালিকায় অভিযুক্ত করা হয়। একপর্যায়ে কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁসির অর্ডার দেয়। কিন্তু গণমানুষের আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক দাবির মুখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পরাজিত হয়। বঙ্গবন্ধু বেকসুর খালাস পেয়ে যান।
মহান ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধুর মতো এত বৈচিত্র্যময় চড়াই-উতরাই এবং এত বেশি জেল খাটার নজির বিশ্বের কম রাজনৈতিক নেতার জীবনে ঘটেছে। পাকিস্তান সরকারের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার ও প্রতিবাদী ভূমিকায় ছিলেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু করার কিছুক্ষণ আগে এবং পরের দিন ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি গ্রেফতার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে স্থানান্তরিত হন। পাকিস্তানের কারাগারে স্বদেশে ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বন্দিজীবন কাটান। সেটি ছিল তাঁর জীবনের শেষ জেলখাটা। পরবর্তী সময়ে (১৯৭২) স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে তাঁর সর্বশেষ জেলজীবনের যবনিকা টানা হয়। বলা বাহুল্য, গণমানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জীবনে বহুবার জেলখাটার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর পরিচিতি বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু যখন বীরের মতো পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসলেন, ঢাকা বিমানবন্দরে তাঁকে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সেদিনের খবরটিও আন্তর্জাতিক বিশ্বের আলোড়ন সৃষ্টিকারী সংবাদে রূপান্তরিত হয়। তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও জনকল্যাণের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানের একনিষ্ঠতাই তাঁকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে অধিক পরিচিত করে তোলে।
বিশ্বের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী নেতা আমেরিকার মার্টিন লুথার কিং এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে গিয়ে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নিয়েছিলেন। জীবনসংগ্রামে লুথার কিং জয়ী হলেন নিজের জীবন দিয়ে। নিজের জন্মভূমি আমেরিকায় আততায়ীর গুলিতে তিনি মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তেমনি বিশ্বের মানবতাবাদী আরেক নেতা ম্যান্ডেলা ২৭ বছর জেল খেটেছেন। সমগ্র বিশ্বে তাঁরা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ম্যান্ডেলা জীবনের কঠিনতম সময়ে কারানিবাস এবং নানাবিধ নির্যাতন সয়েও মানবতার মুক্তিসংগ্রাম থেকে পিছপা হননি। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অনড় ও সোচ্চার। গণমানুষের স্বার্থে নিজের নীতিবোধের সুদৃঢ় অবস্থানের ফলেই নেলসন ম্যান্ডেলা জয়ী হলেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।
পৃথিবীতে মানবতার স্বার্থে, স্বাধীনতা ও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন হয়। সেসব আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এবং অংশগ্রহণকারীরা কারাবরণ করেন, নির্যাতনের শিকার হন, এমনকি অনেকের ফাঁসি হয় ও করুণ মৃত্যু ঘটে। ফ্যাসিবাদ ও শোষণের শিকার হয়ে কত মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে কারাবরণ করার (ফাঁসির আদেশসহ) এমন অনেক ঘটনা আছে। সেগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের উত্থানপর্ব এবং তার বহুমাত্রিক বিচক্ষণতায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু বিশ্বের একজন আলোচিত রাজনীতিক হিসেবে পরিগণিত হলেন। গণমানুষের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে কারাবরণের বিষয়টি তাঁকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সৌদি আরবসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন না দিলেও পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর সেসব দেশের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ভাষণ প্রদান করেন। সেটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ঐতিহাসিক ভাষণ। সেই ভাষণের (মাতৃভাষা বাংলায়) মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর পরিচিতি আরও বেশি বেগবান হয়।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক দিন আগে সাতই মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (বর্তমান সোহরওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ভাষণটি ঐতিহাসিক এবং সেটিও ইতিহাসের অংশ। সাতই মার্চের সেই ভাষণের মূলকথা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।
ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একটি বিখ্যাত উক্তি : ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব।’ আন্তর্জাতিক বিশ্বে সুভাষচন্দ্র ছিলেন একজন বিশ্ব রাজনীতিক। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে তিনি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তারও অনেক পরে এসে স্বাধীনতার জন্য সুদৃঢ়ভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছেন :
‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
প্রকাশ থাকে যে, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সর্বশেষ পর্যায়ে সাতই মার্চের উত্তাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগামসংকেত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের এমন অঙ্গীকার পৃথিবীর কম নেতার মাঝেই পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তযুদ্ধ ও স্বাধীনতার জন্য এই ভাষণটি ঐতিহাসিক এবং এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ভাষণের প্রেরণায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র মানুষ স্বাধীনতার জন্য ব্যগ্র-ব্যাকুল ও উদ্দীপ্ত উত্তাল হয়ে উঠেছিলেন। এই ভাষণের মূল প্রেরণা শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর স্বাধীনতাবঞ্চিত নিপীড়িত মানুষকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রেরণাদায়ক ও শক্তি-উদ্দীপক হতে পারে।
অন্য কিছু না হলেও শুধু সাতই মার্চের ভাষণের কারণেও বঙ্গবন্ধু তৃতীয় বিশ্ব তথা আন্তর্জাতিক বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কেননা সেই ভাষণে নিপীড়িত গণমানুষের মুক্তির কথা আছে। আত্মসংগ্রামের আহ্বান আছে। স্বাধীনতার কথা আছে।
পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণার উৎস হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা অক্ষয়, চিরন্তন ও অবিস্মরণীয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মর্ম উপলব্ধিতে বিশ্বের শান্তি ও মুক্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রেরণা, সাহস ও শক্তি জোগায়। তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের মুক্তিসংগ্রামকে উদ্দীপ্ত ও জাগরণ সৃষ্টি করতে পারে। নতুন রাষ্ট্রপুঞ্জের দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিগণিত করতে। তাঁর স্বপ্ন ছিল দুঃখী ও নিপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! দুঃসময় তাঁকে সেটি সম্পন্ন করতে দেয়নি। তবে সে সময় তাঁর স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হলেও তিনি যে গণমানুষের সফল নেতা ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।
এখানে কমরেড হিলটনের একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘সফল মানুষেরা কাজ করে যায়। ভুল করে ভুল শোধরায়, কিন্তু হার মানে না।’
বঙ্গবন্ধুও সে রকম সাহসী মানুষ ছিলেন। তিনি গণমানুষের স্বার্থে নিজের সর্বস্ব বিলীন করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নেতা হিসেবে তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণমানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের জন্য তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার আত্মত্যাগী নেতা।
আজ যারা তাঁকে নিয়ে রাজনীতি করছেন অথবা সমালোচনা করছেন, তারা তাঁকে কতটুকু ভালোবাসেন। বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে যারা রাজনীতি করছেন, তাদের হৃদয় ও দেমাগে তারা আসল বঙ্গবন্ধুকে কতটুকু ধারণ করেন। দেশ ও গণমানুষের জীবনের নিরাপত্তা, স্বস্তি-শান্তি ও দুঃখী মানুষের সুখ-শান্তি নিয়ে তারা কতটুকু ভাবছেন।
তিক্ত হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুর নামে রাজনীতি করে কেউ কেউ বড় নেতা ও মন্ত্রী হয়ে গণমানুষের কথা ভুলে যান। অনেকে প্রবাসীদের কটাক্ষ ও উপহাস করেন। প্রবাসীদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করেন! অথচ দেশের সরকারের সিংহভাগ রেমিট্যান্স/রাজস্ব আয় হয় বহির্বিশ্বে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিকট থেকে।
একটি সংঘবদ্ধ কুচক্রী গোষ্ঠী রাজনীতির নামে জনসাধারণের ভোট ছিনিয়ে নেয় কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর জনগণের কথা মনে রাখে না। এই বখাটে শ্রেণির বিশেষ গোষ্ঠী এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ রাজনীতির জায়গাগুলোকে কলুষিত করে তোলে। রাষ্ট্রপুঞ্জে তাদের দৌরাত্ম্য ও প্রাধান্য বিস্তারের মাধ্যমে এবং ক্ষমতার দাপটে নির্লজ্জভাবে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে।
তাদের অনেকেই দেশের ব্যাংকগুলোকে শূন্য করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ির অবৈধ মালিক হয় এবং বাংলাদেশকে একটি পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত করার অপচেষ্টা করে। তবে সময়ের ঘূর্ণিপাকে ওই অভিশপ্ত নেতারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এসব দুষ্টাচার ও দুর্বৃত্তপনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নীতির পরিপন্থী। সরকারের ভেতরকার এসব দুষ্টচক্র কখনোই বঙ্গবন্ধুর মতো নির্লোভ, নির্ভেজাল গণমানুষের নেতা হতে পারবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর তুলনা শুধুই বঙ্গবন্ধু, অন্য কেউ নয়।
এখানে বর্ণবাদবিরোধী নেতা, নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, ‘সম্পন্ন করবার আগে সবকিছুই অসম্ভব মনে হয়।’
সত্যিকার অর্থে যেকোনো অসম্ভবকে জয় করতে হলে কঠিন সিদ্ধান্ত ও সৎ সাহস রাখতে হয়। বঙ্গবন্ধুর মাঝে সে রকম সৎ সাহস ও দৃঢ়তা ছিল। জীবনে তিনি অনেক সাহসী ভূমিকা নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি কতটা ত্যাগী এবং সৎ সাহসী নেতা ছিলেন। তিনি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করেছেন এবং সফলও হয়েছেন।
তৃতীয় বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ রাজনৈতিক পরিচিতি ছিল ঈর্ষণীয় এবং তিনি একজন সফল নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অতএব, আমাদের উচিত সকল স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবদানের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও শ্রদ্ধা জানানো।
আল্লাহ কৃতজ্ঞতা পছন্দ করেন। এ মুহূর্তে মেরি ডেভিসের বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেন :
‘আমি যত বেশি কৃতজ্ঞ, আমি তত বেশি
সৌন্দর্য দেখি।’
আর সৌন্দর্য দেখার জন্য তীক্ষè মেধা ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন। সেটি বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ছিল। বঙ্গবন্ধু মানুষকে ভালোবেসেছিলেন এবং মানুষের ভালোবাসাও অর্জন করেছিলেন।
এ মুহূর্তে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত লাইন মনে পড়ছে। তিনি তাঁর কবিতায় আহ্বান করেন :
‘একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো-
দেখবে, নদীর ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে।
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো...।’
বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইতিহাসস্বীকৃত গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা। নিপীড়িত মানুষের নেতা। তিনি অবিস্মরণীয়। তিনি অনির্বাণ।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক