সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার জোরালো চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। ভারত সরকার তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। শেখ হাসিনার ভিসার মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এতে সন্তুষ্ট নয়। অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনাকে হত্যা মামলার আসামি করে রেড অ্যালার্টও জারি করেছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে তাকে হস্তান্তর করতে ভারত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিদেশি একাধিক দেশ ও সংস্থার মাধ্যমেও এ ব্যাপারে ভারত সরকারকে বলা হয়েছে। ভারত সরকার বিষয়টি বিব্রতকর মনে করছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়। শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশেও যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় ভারত সরকার ঝুঁকিপূর্ণ বলে তাতে সম্মত হয়নি। ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে তুলে দেবে না বলেই জানা যায়।
অন্যদিকে কোনো অবস্থাতেই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ও তার সহযোগীরা যথাযথ কর্মপরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। তবে নির্বাচন-ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুপারিশ করেনি। তারা বলেছে, কাউকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা তাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে খুন, গুম, দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নির্বাচনের সুযোগ পাক, নির্বাচিত হয়ে আসুক- দেশের মানুষ তা চায় না। কমিশন চেয়েছে, বিচারিক আদালতে দোষী সাব্যস্তরা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে।
নির্বাচন কখন হবে, স্থানীয় নাকি জাতীয় নির্বাচন আগে হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপি এ বছরই নির্বাচন চায়। তারা নির্বাচন বিলম্বিত করা, পারতপক্ষে পিছিয়ে আগামী বছরের শেষার্ধে বা মাঝামাঝি নেওয়ারও পক্ষে নয়। তারা সংস্কারের বিপক্ষেও নয়। বিএনপি নির্বাচন, সংসদ-সংক্রান্ত জরুরি বিষয়গুলোর সংস্কার চায়। নির্বাচনের পর নির্বাচিত সরকার বাকি সংস্কারগুলো করবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এ পর্যন্ত যেসব সংস্কার হয়েছে তার ৯০ শতাংশই বিএনপি করেছে। সংস্কার প্রশ্নে বিএনপিকে কারও কাছ থেকে সবক নিতে হবে না। বিএনপির মহাসচিব এ বছরের আগস্টের মধ্যে সংসদ নির্বাচন চেয়েছেন। তিনি এই বলেও সতর্ক করেছেন, অতিবিপ্লবী হয়ে সংকট সৃষ্টি না করার জন্য। ন্যূনতম সংস্কার করে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে রাজনৈতিকভাবে মিথ্যা, হয়রানিমূলক আড়াই হাজারের অধিক মামলা প্রত্যাহারের প্রশাসনিক, আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। এসব মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিএনপি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে জামায়াতের নেতাকর্মীরা জড়িত।
ড. ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের অভিলাষ দৃশ্যমান নয়। তবে তাকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছেন, সেই বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী ও তাদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি সবার আগে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন চায়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তারা প্রার্থী দেবে। ভিপি নুরুল হক নুরের সংগঠনও অভিন্ন অবস্থানে। সম্মিলিতভাবেই নির্বাচন করতে আগ্রহী তারা। সংগঠন গড়ে তোলা ও প্রার্থী বাছাই-প্রক্রিয়া তারা চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোদমে। জামায়াতে ইসলামী এ বছরের শেষের দিকে নির্বাচনের পক্ষে।
প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, তাদের নির্বাচনের বাইরে রাখার কথা প্রকাশ্যে বলছে না। জামায়াতে ইসলামীও রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় স্বার্থচিন্তায় এ ব্যাপারে দৃঢ় কোনো অবস্থানে নেই। তাদের মতে, আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী, নেতাদের দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচারের বিচার হোক আগে। তারপর জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে তারা নির্বাচন করবে কি না। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচন চরমোনাইর পীরের খেলাফত আন্দোলনসহ সমমনা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে করবে জামায়াত। ডা. শফিক স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, জামায়াত কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হবে না। স্পষ্টতই তিনি বিএনপিকে ইঙ্গিত করেছেন। জামায়াত গভীরভাবে আশা করে, ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করলে দেশের মানুষ তাদেরকেই বেছে নেবে। জামায়াতসহ ইসলামপন্থীরা ছাড়া আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি- সবাইকে দেশের মানুষ দেখেছে। তারা নতুন রাজনীতি, নতুন মুখ চায়।
জামায়াত নেতাদের এ বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জোট সরকারের সময় জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী ও জেনারেল সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী হয়েছিলেন। মন্ত্রী হিসেবে তারা দলীয় লোকদের স্বার্থে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। কাজেই জামায়াত ক্ষমতাবহির্ভূত ছিল, ক্ষমতার স্বাদ পায়নি বলার সুযোগ নেই। তবে ইসলামি শক্তিসমূহের সম্মিলিত প্রয়াস ধর্মপ্রাণ মানুষদের মধ্যে ক্ষীণ আকারে হলেও আশার সঞ্চার করতে পারে। তারা আগামী বছরের গোড়ার দিকে জাতীয় নির্বাচন চেয়েছে। তার আগে উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তাদের।
নির্বাচন-ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে চার মাসের মধ্যেই স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব। স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠানের জন্য বৈষম্যবিরোধীদের ও তাদেরই রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবিও এটাই। তা না হলে বৈষম্যবিরোধীরা রাজপথে নামবে। প্রশ্ন উঠেছে, আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্যই কি তারা সবার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস শুধু বিব্রতকরই নয়, অনেকটা বিপজ্জনক অবস্থায় পড়েছেন। দৃশ্যত তিনি ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চান না। আবার তার অনুসারী বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের দমিত করতে পারছেন না, উল্টো তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন দেওয়া হলে বিএনপি তার বিপক্ষেও অবস্থান নিতে পারে। এই দলটির ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যায়ে যোগ্য, জনদরদি একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। তা সত্ত্বেও জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। বিএনপি এ কথাও বলেছে, জাতীয় নির্বাচনে কোনো দল ১০ আসনে জয়ী হলেও সব দলকে নিয়েই তারা সরকার গঠন করবে। এই বক্তব্য তাদের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনের পথচলাটা সহজ হবে না।