সংবিধান অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও বলেছেন, অক্টোবরেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এ অবস্থায় আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির হাতে সময় আছে দুই মাসেরও কম। এর মধ্যে যদি বিএনপি দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়, তাহলে একাদশের মতো আরেকটি পরাজয় দলটির জন্য অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন স্বয়ং দলটির নেতাকর্মীরাই। বিএনপির হাইকমান্ডের অনেকে বলছেন, যেকোনো মূল্য সরকারকে সরাতে হবে। রাজপথের কঠিন আন্দোলন নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
বিএনপি ও জোটের সূত্রগুলো বলছে, চলতি আগস্ট ও আগামী সেপ্টেম্বরকে টার্গেট করে নতুন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। চলতি আগস্ট মাসে ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে সমাবেশ, অবস্থান, পদযাত্রা, রোডমার্চ কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তাদের মূল টার্গেট সেপ্টেম্বর। আগস্ট শোকের মাস হওয়ায় গতানুগতিক কর্মসূচি দিয়ে তারা রাজপথে থাকবে। সেপ্টেম্বরে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করার মতো কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকবে তারা। শান্ত পরিবেশ সেপ্টেম্বরে বিনষ্ট হতে পারে বলেও মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। যে কর্মসূচিতে সরকারের টনক নড়বে, তেমন কর্মসূচিই নেওয়া হবে। আগস্টের মধ্যে যদি সরকার দাবি না মানে, পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দেয়, তাহলে অহিংস কর্মসূচি থেকে সহিংস কর্মসূচির পথেও তারা হাঁটতে পারে। বিদেশিদের কাছে দেশের অবস্থা ইতিমধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। শুধু বিদেশিদের দিকে তারা আর তাকিয়ে থাকবে না। টার্গেট রাজপথের কর্মসূচি। বিএনপির অন্য একটি সূত্র বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে আন্দোলনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে আদালতেও যেতে পারে।
বর্তমানে সরকার পতনের এক দফার ঘোষণা দিয়ে মাঠে রয়েছে বিএনপি। তবে বর্ষার কারণে দলীয় কর্মসূচি পালনে ব্যাঘাত ঘটছে। তারেক রহমান ও জুবাইদা রহমানের সাজার প্রতিবাদে ৪ আগস্ট শুক্রবার সমাবেশ করেছে হাঁটুপানিতেই। ভাটা দেখা গেছে নেতাকর্মীদের উপস্থিতির। জুলাই মাসের বড় সমাবেশগুলোতে উপস্থিতি ফকিরাপুল ও নাইটিঙ্গেল মোড় ছাড়িয়ে গেলেও আগস্টে এ পর্যন্ত হওয়া সমাবেশগুলোতে লোক ছিল হাতে গোনা। কিছু নেতাকর্মী ভিজেছেন আর কিছু নেতাকর্মী ছাতা নিয়ে বসে থেকে বক্তব্য শুনেছেন। এর মধ্যেই চলে এসেছে এইচএসসি পরীক্ষাগুলো। আগামী ১৭ আগস্ট শুরু হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এই পাবলিক পরীক্ষা। অন্যদিকে অতিবৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শোকের মাস আগস্ট, বন্যার পদধ্বনি আর এইচএসসি পরীক্ষার কারণে বিএনপির আন্দোলনের প্রেক্ষাপট কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। তাই আগস্টে নরম কর্মসূচি দিয়ে সময় পার করে সেপ্টেম্বরে মরণকামড় দিতে চাইছে বিএনপি ও তার সহযোগীরা।
দলটির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরুর পর থেকেই কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপি সবকিছু সমন্বয় করেছে। সরকারের ১৪ বছরের আমলনামা, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও নানা তথ্যচিত্র সিডি আকারে উপস্থাপন করেছে। আন্দোলন-সংগ্রামে বিদেশিদের কিছু প্রেসক্রিপশনও তারা গ্রহণ করেছে। সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশি হামলা-মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জার্মানিসহ ঢাকায় নিযুক্ত ২৫টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে বিএনপি। সেখানে অবস্থান কর্মসূচিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের হামলা, গুলিবর্ষণ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, মামলা-গ্রেপ্তার, নির্যাতনের ঘটনা ভিডিও ফুটেজসহ কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, সেটিও কূটনীতিকদের জানায় বিএনপি। এ ছাড়া ২৮ জুলাই মহাসমাবেশের আগের দিন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গেও বৈঠক করেন দলটির নেতারা। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতির মাধ্যমে বিএনপির ভূমিকাও তুলে ধরা হয়। ঢাকায় পদযাত্রা, প্রবেশমুখে অবস্থান ও মহাসমাবেশের মাধ্যমে ইতিমধ্যে বিএনপির জনপ্রিয়তার বার্তা উপস্থাপিত হয়েছে। সমাবেশে লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতি ও ২৯ জুলাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঢাকায় প্রায় তিন ঘণ্টা সংঘর্ষের মাধ্যমে সাংগঠনিক শক্তির ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে দাবি আদায়ে রাজপথে এমন কর্মসূচি আরও পালন করা হবে। দাবি আদায়ে সরকার নরম না হলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায় নিতে হবে বলেও দাবি তোলা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে।
অন্যদিকে ২৯ জুলাই বিএনপির যেসব নেতা রাজপথে নামেননি, ঢিলেমি করেছেন, তাদের তালিকাও করা হচ্ছে। আগামীতে তাদের বিষয়ে দলে ভালো কোনো অবস্থানও থাকবে না। রাজপথের ভূমিকার মাধ্যমেই নেতাকর্মীদের ভাগ্য নির্ধারিত হবেÑতারেক রহমান এমন বার্তা দিয়েছেন বলে দাবি দলটির বড় অংশের। শীর্ষ নেতাদের অনেকে অসুস্থ থাকায় রাজপথে নামতে না পারলেও চিন্তিত নয় বিএনপি। তরুণ নেতাদের দিয়ে ঢাকামুখী টার্গেট করে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত আন্দোলনের ফল আগামী সেপ্টেম্বরে তোলার প্রস্তুতি নিয়ে হাঁটছে তারা। তবে পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে চলতি আগস্টেও যেকোনো মুহূর্তে বড় ঘোষণা আসতে পারে। সেপ্টেম্বরে যে বড় কর্মসূচি রয়েছে, তা নিয়ে দলে পর্যালোচনা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিস্থিতির আলোকে কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। গোপনীয়তা রক্ষায় তা আগেই জানানো হচ্ছে না। তাই ঘোষণার আগ পর্যন্ত দলের সিনিয়র নেতারাও জানবেন না কর্মসূচির ব্যাপারে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আগামীতে কোনো দিবস বা ইস্যুতে আমাদের আন্দোলনে বিরতি আসবে না। নির্দিষ্ট দিনক্ষণের অপেক্ষা করা হবে না, যেকোনো মুহূর্তে বড় কিছুর ঘোষণা আসবে। দেশে এখন গণতন্ত্র রক্ষার চেয়ে আর বড় কোনো ইস্যু নেই। বিদেশিরাও আজ বলছেন, এই সরকারকে সরে যেতে। দেশের জনগণ আওয়াজ তুলেছে সরে যেতে।’