দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আমন্ত্রণে ৬ আগস্ট সে দেশে গেছে। আওয়ামী লীগের এই প্রতিনিধিদলের ভারত সফর মূলত কোনো দেশেরই সরকারি কার্যক্রমের অংশ নয়। এটি দুই পক্ষেরই একান্ত দলীয় কর্মসূচি। ফলে দুই দেশের রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে এ নিয়ে বেশ আগ্রহ ও ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের এই সফরের দুই মাস আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করে এসেছে। ওই সফর নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা হয়। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা প্রভাব খাটানোর পাশাপাশি চীন ও ভারত এ বিষয়ে বেশ সতর্ক ও সজাগ। ফলে নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের চীন ও ভারত সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
জানা গেছে, ভারত সফরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সে দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রেসিডেন্ট জগত প্রকাশ নাড্ডা ও জেনারেল সেক্রেটারি বিনোদ তড়ের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে মিলিত হয়েছে। ৭ আগস্ট সোমবার দুপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য মেরিনা জাহান কবিতা ও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বিজেপির প্রেসিডেন্ট জে পি নাড্ডার বাসভবনে তার সঙ্গে বৈঠক করেন। বিজেপির আমন্ত্রণে সফররত দলের নেতারা এরপর বিজেপির সদর দপ্তরে পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি বিনোদ তড়ের সঙ্গেও আলোচনায় মিলিত হন। আন্তরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠক দুটিতে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক নানা বিষয়ের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা, জঙ্গিবাদ দমন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিশেষ গুরুত্বসহ আলোচিত হয়েছে বলে জানা গেছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গেও দেখা করার ইচ্ছা আছে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের।
এর আগে গত ২১ মে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করেছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বেইজিংয়ে যায় আওয়ামী লীগের ১৭ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদল। আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করাসহ চীনের সহায়তার বিষয়টি গুরুত্ব পায় ওই সফরে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিনিময় ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
এদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের দিল্লি সফর নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমও বেশ সরব। দেশটির পাঠকপ্রিয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস, আনন্দবাজারসহ একাধিক গণমাধ্যম এ সফর নিয়ে নানা বিশ্লেষণ করছে। হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সফর ভারত সরকার নয়, বরং শাসক দল বিজেপির আমন্ত্রণে। বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। এ পরিস্থিতিতে বিজেপির আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগ নেতাদের ভারত সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। গণমাধ্যমটি আরও বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে যখন আমেরিকা ‘অসন্তুষ্ট’, তখন ভারত সরকার ও বিজেপি যে আওয়ামী লীগের ‘পাশে রয়েছে’, এই সফরে সেই বার্তাই যেন স্পষ্ট।
ভারতীয় আরেক প্রভাবশালী গণমাধ্যম আনন্দবাজার বলছে, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের এই সফর যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও বিজেপি সূত্রের দাবি, দলীয় সম্পর্ক নিবিড় করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, কয়েক বছর ধরেই তারা দলীয় স্তরে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার কর্মসূচি নিয়ে চলেছে। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সফর তারই অংশ। ‘রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবাদ’ সম্পর্কে বিজেপি কী চিন্তা করে, সেটি বিদেশিদের কাছে ব্যাখ্যা করা ও তার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক দৃঢ় করতেই এই উদ্যোগ।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে বাংলাদেশে। আরও একটি সাধারণ নির্বাচন হতে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে কয়েক দিন আগেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অসম্মান করা ব্যক্তিদের মার্কিন ভিসা দেওয়া হবে না।’ যদিও গত নির্বাচনগুলোতে কারচুপির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এসবের মধ্যেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার দিকে মন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এদিকে সেপ্টেম্বরে জি-টুয়েন্টি সম্মেলনে যোগ দিতে শেখ হাসিনার দিল্লি যাওয়ার কথা। তার আগে আওয়ামী লীগের এই প্রতিনিধিদল দিল্লি পৌঁছাল।