দেড় বছরের অপহৃত সময়ের কষ্টগুলোর কথা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। এগুলো কেবল সিনেমায় অ্যাকশন মুভিতে দেখা যায়। অত্যন্ত কষ্ট ও বিপৎসংকুল অবস্থায় সময় পার করেছি। প্রতিটি ক্ষণ ছিল দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর ভয়। বেঁচে ফিরব—এটা কখনো কল্পনাও করিনি। দেড় বছর পর ইয়েমেনে আল-কায়েদার জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এ কথা বলছিলেন জাতিসংঘের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সুফিউল আনাম।
৯ আগস্ট বুধবার দেশে ফেরার পর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন সুফিউল আনাম। এর আগে দুবাই থেকে এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে বুধবার (৯ আগস্ট) বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। বিমানবন্দরে তাকে গ্রহণ করেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) শীর্ষ কর্মকর্তারা।
সুফিউল আনাম বলেন, ‘ভেবেছিলাম সবাই আমাকে ভুলে গেছে। ঠিক আগামীকাল আমার অপহরণের এক বছর ছয় মাস পূরণ হবে। আমি একটা পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যখন ফিরছিলাম, তখন আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এ সময় আমাকে আমার দেশ, পরিবার, সমাজ, ভাষা, আবহাওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল। অপহৃত সময়ের কষ্টগুলোর কথা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। অত্যন্ত কষ্ট ও বিপৎসংকুল অবস্থায় আমি সময় পার করেছি। প্রতিটি ক্ষণ ছিল সন্ত্রাসী, দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর ভয়।’
ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত বিপৎসংকুল পরিস্থিতিতে ছিলাম। যেটা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। সেই চিত্র শুধু সিনেমায় দেখা যায়। আমি ছিলাম পাহাড়ের ভেতরে, ছিলাম মরুভূমিতে। আমি আকাশ-বাতাস দেখতে পারিনি মাসের পর মাস।’
প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) আমার উদ্ধারকাজে নিয়োজিত হয়। তারা সফলতার সঙ্গে আমার চার সহযোগীসহ আমাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এ জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের এই দায়িত্বের কথা ভুলব না।’
অপহরণকারীরা কোনো ধরনের নির্যাতন করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালন করে দুটি গাড়িসহ আমরা পাঁচজন যখন এডেনে ফিরছিলাম, তখন একটি চেক পয়েন্টে আমাদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। বাকি চারজন ইয়েমেনের অধিবাসী ছিলেন। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়ের মাঝখানে একটি সেন্টারের মধ্যে। আমাদের ভাগ্য ভালো, তারা আমাদের কোনো নির্যাতন করেনি। দুর্ব্যবহারও করেনি। তারা শুধু আমাদের চোখ বেঁধে পাহাড়ের মধ্যে শেল্টারে নিয়ে যায়। যতক্ষণ সেখানে আমাদের রাখা সম্ভব হয়েছে, ততক্ষণ রেখেছে। তারপর সেখান থেকে মরুভূমির মধ্যে একটি ট্যাংকে নিয়ে গেছে। সারাক্ষণ আমার চোখ বাঁধা ছিল। গত দেড় বছরে আমাদের ১৮ বার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এগুলো কোথায়, সেই সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই।’
খাবারদাবারে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের কাছে যত দিন ফান্ড ছিল, তত দিন খাবার ও অন্যান্য বিষয় দিতে কোনো ত্রুটি করেনি। যখন তাদের হাতে টাকা শেষ হয়ে যায়, তখন আমরা খুব কঠিন সময় পার করেছি।’
আপনাদের কেন টার্গেট করেছিল এবং কী পরিমাণ মুক্তিপণ চেয়েছিল—এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কী পরিমাণ টাকা-পয়সা চেয়েছিল সেই সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি যেহেতু জাতিসংঘের কর্মকর্তা, সেই হিসেবে আমাকে টার্গেট করেছে বলে আমার মনে হয়। তাদের দাবিদাওয়া পূরণ করার জন্য তারা আমাকে টার্গেট করেছে বলেছে। আমাকে দিয়ে যেসব ভিডিও ক্লিপ তৈরি করেছে, সেখানে আমাকে বলেছে, তারা তাদের দাবি পূরণ করতে চায়। কিন্তু দাবিগুলো কী—সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই।’
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ যে প্রয়োজন, সেটা কীভাবে বুঝলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর যে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, তা আমি বুঝতে পারিনি। কালকে উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি জানতামই না যে বাংলাদেশ থেকে আমাকে উদ্ধার করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে যে উদ্যোগ চলছে, সেটা আমি জানতাম না।’
অপহরণ হওয়ার পর কি বুঝেছিলেন বেঁচে ফিরবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, আমার মনে হয়েছে আর কখনো ফিরতে পারব না বা বাঁচব না। যেকোনো বিপৎসংকুল মুহূর্তে তারা আমাদের হত্যা করবে। আমাদের মনে হয়েছে, যেকোনো অপারেশনের মাধ্যমে যদি আমাদের উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়, তাহলে তারা আমাদের হত্যা করবে। হত্যা করে তারা পালিয়ে যাবে।’
জাতিসংঘের কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছিলেন—এমন প্রশ্নে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘জাতিসংঘের কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছি, তা আমি জানি না। তবে আমি যতটুকু জানি, তারা সক্রিয়ভাবে আমাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। আপনারা জানেন যে জাতিসংঘের নানা বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তারা সরাসরি একটা দেশের অভ্যন্তরীণ কিংবা নিরাপত্তাব্যবস্থায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি কোনো উদ্ধারকাজের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাদের ওই দেশের সরকারের মাধ্যমে যেতে হয়। এখন ওই সরকারের কতটুকু সক্ষমতা ও দক্ষতা আছে, তার ওপর নির্ভর করে একজনকে উদ্ধারের কাজ।’
এ সময় এনএসআইয়ের পরিচালক ইমরুল মাহমুদ বলেন, ‘এটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রধানমন্ত্রী আস্থা রেখেছিলেন। দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছিল। দেড় বছরের চেষ্টায় এই সফলতা। ৩০ লাখ মার্কিন ডলার চেয়েছিল অপহরণকারীরা। কিন্তু কোনো টাকা-পয়সা দিতে হয়নি তাকে মুক্ত করতে।’
তবে কীভাবে উদ্ধার করা হলো—নিরাপত্তার স্বার্থে সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি ইমরুল মাহমুদ। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন এনএসআইয়ের অতিরিক্ত পরিচালক বদরুল হাসান চৌধুরী ও উপপরিচালক বদরুল হাসান বিদ্যুৎ।
প্রসঙ্গত, সুফিউল ইয়েমেনের রাজধানী এডেনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগের ফিল্ড সিকিউরিটি কো-অর্ডিনেশন অফিসার (প্রধান) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি অপহৃত হন তিনি। ওই দিন জাতিসংঘের একটি ফিল্ড মিশন শেষে এডেনে ফেরার পথে ইয়েমেনের মুদিয়াহ প্রদেশ থেকে সুফিউল আনামসহ জাতিসংঘের আরও চার কর্মীকে অপহরণ করে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সদস্যরা। এরপর নানা কৌশলে মুক্তির জন্য ইয়েমেন যায় বাংলাদেশের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। মঙ্গলবার তাকে উদ্ধার করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে বুধবার দেশে ফিরলেন তিনি।
ঠিকানা/এনআই