ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবে রমজান মাসে কোনো রাজনৈতিক দল কর্মসূচি পালন করে না। কিন্তু এবার বিএনপি ব্যতিক্রম ঘটাল। রমজান মাসেও বিএনপির বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। প্রতি শনিবার ধরে ধরে বিএনপি ঢাকা এবং সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ, অবস্থানসহ
নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর মধ্য দিয়ে রমজান মাসে রাজনৈতিক কর্মসূচি না করার সংস্কৃতি ভাঙল বিএনপি। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এর সমালোচনা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, রমজানের পবিত্রতা নষ্ট করছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা এতে উল্লসিত। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কর্মসূচি থেকে সরে এলেই রাজনৈতিক আবেদন নষ্ট হয়ে যাবে। এ কারণেই বিএনপি অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, সেপ্টেম্বর মাসকে টার্গেট করে তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এই সময়ের মধ্যে তারা একটি বড় পরিস্থিতি তৈরি করতে চান এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সংকটকে একটা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চান। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও মনে করছে, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন নিয়ে যে সংকট ও অনিশ্চয়তা, সেটি তারা দূর করতে চায় এবং তারা দেশকে একটি নির্বাচনী মহাসড়কে তুলতে চায়। আওয়ামী লীগ-বিএনপির এই পাল্টাপাল্টি অবস্থান সেপ্টেম্বরে রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করবে এবং চূড়ান্ত পরিণতি তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নির্বাচন সামনে রেখে পরস্পর বৈরী দুই পক্ষ যেভাবে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে, তাতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কতটা সংঘাত-সংঘর্ষমুক্ত ও রক্তপাতহীন-শান্তিপূর্ণ হবে, তা নিয়ে ভোটার সাধারণসহ সর্বসাধারণের শঙ্কা, সংশয় তীব্রতর হচ্ছে। বিরোধীদলীয় জোটে বিভক্তি সৃষ্টি ও তাদের কর্মসূচিতে কর্মী-জনসম্পৃক্ততা কম দেখানোর নানামুখী প্রয়াসও চলছে।
বিএনপি ও তার সহযোগীরা গত কয়েক মাস ধরেই কর্মসূচি পালন করে আসছে। বিভিন্ন নামের এসব কর্মসূচি অহিংস ও শান্তিপূর্ণই ছিল। অবশ্য জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ও বিএনপির উগ্রবাদী কিছু সদস্যের ব্যতিক্রমী আক্রমণাত্মক ঘটনা ছাড়া। রাজধানীসহ মহানগরগুলো ছাপিয়ে গ্রাম পর্যায়েও তারা কর্মসূচি পালন করেছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে জনমনে বিএনপি সম্পর্কে যে একটা প্রচণ্ড ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করাই দলটির উদ্দেশ্য। এ পর্যন্ত তাদের এই পরিকল্পনা অনেকাংশেই সফল হয়েছে। শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বিএনপি তাদের প্রতি মানুষের সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলেই দলটির নেতারা মনে করেন। তাদের কর্মসূচির পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক কর্মসূচি পালন করার ঘটনা জনমনে বিএনপির প্রতি সহানুভূতি বাড়াতেই ভূমিকা রেখেছে।
এ পর্যন্ত মোটামুটি অহিংস ও শান্তিময় পরিবেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পালিত হলেও জনমনে নতুন করে একটা আশঙ্কার বীজ ছড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ বরাবর বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিচ্ছে না বলে দাবি করে আসছে। কিন্তু রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, পাল্টা কর্মসূচি না হলে একই দিনে একই সময়ে কেন কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে? আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের কর্মসূচিকে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও শান্তির পক্ষে বলে বলছেন। নির্বাচন পর্যন্ত এ ধরনের শান্তির সপক্ষের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আগামীতে বিএনপি-জামায়াত হিংসাত্মক পথে যেতে পারে। উদ্দেশ্য দেশে নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও অগণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, সরকারি মহল থেকে এ ধরনের বক্তব্য রাখার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল, কোণঠাসা করাও মুখ্য উদ্দেশ্য হতে পারে। আবার এটাও মনে করা হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য, আভাস না পেয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রকাশ্যে এ ধরনের আশঙ্কামূলক বক্তব্য রাখা হতে পারে না। বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখায় সরকার, সরকারি দল কোনো রকম বিভ্রান্তমূলক তৎপরতা চালানোর ঝুঁকি নেবে না।
বিএনপি ও তার সহযোগীরা এ পর্যন্ত নীরব পদযাত্রা, গণ-অনশন, অবস্থান কর্মসূচি পালন করার পরও সরকারের টনক নড়ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। কিন্তু কোনো কর্মসূচিতেই সরকার নীতি স্বীকার করবে না। বিএনপি আগামী আরো কয়েক মাস অহিংস কর্মসূচি পালন করবে। কিন্তু তাদের শেষটা হবে ভিন্নতর। শান্তিপূর্ণ পন্থায় তারা জনসমর্থন অর্জন এবং সরকারের বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক মহল আরো মনে করেন, নির্বাচন বর্জন করে নীরবে ঘরে বসে থাকা, অহিংস শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোর মধ্যেই বিএনপি তার কার্যক্রম সীমিত রাখবে না। তারা এমন কিছু কর্মসূচি দেবে, যাতে সরকারের পক্ষে ভোটার সাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান দুরূহ হয়ে পড়তে পারে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুই সপ্তাহ আগে থেকে তারা আন্দোলনের রূপ পাল্টাবে। নৌপথ, ঢাকাসহ সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, নৌবন্দরে অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হবে। কর্মসূচিভিত্তিক এমন কর্মকাণ্ড ঘটানো হতে পারে, যাতে অনাকাক্সিক্ষত শক্তির, বিদেশিদের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়তে পারে। তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির সর্বাত্মক চেষ্টা করবে, যাতে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এগিয়ে এসে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে; যা কূটনৈতিক চাপ হিসেবেই প্রতিভাত হবে। বিদেশিদের অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য, বিপুলসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, গত উপনির্বাচনে ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে পাঁচটি আসনে। একটিতে ২০ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের এই হিসাব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এত সংখ্যক ভোট পড়েনি বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সর্বাধিক সংখ্যক ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে সরকার ও সরকারি দল। কিন্তু কী করে তা সম্ভব হবে? মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখ থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বিএনপি লাগাতার হরতাল, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও, শহরের স্থানে স্থানে অবরোধ কর্মসূচি দেবে। শাহজালাল বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর অচল করবে বিরোধী দল। স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বজায় রাখতে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে যথাযথ কর্মপন্থা নেবে। বিএনপি ও তার অনুগামীরা এ ধরনের একটা পরিস্থিতিরই অপেক্ষায় রয়েছে। ব্যাপক হিংসাত্মক ঘটনা, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী ও সরকারি দলের কর্মীদের হামলা, বিরোধীদলীয় কর্মীদের হতাহতের ঘটনাই হবে বিএনপির শেষ পুঁজি। ভয়-ভীতিকর পরিস্থিতিতে ভোটার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে কম হবে। একই ভোটারের বারবার ভোট দেওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ জানালে পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এতে ভোটার উপস্থিতি শূন্যের কোটায় নেমে আসতে পারে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত লাগাতার হরতাল, অবরোধ কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনাও করে রেখেছে বিএনপি। সে ক্ষেত্রে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে নির্বাচন কমিশন। আইনগত ব্যবস্থা, বিধান না থাকায় এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিরোধী দল এর বিপক্ষে আদালতের আশ্রয় নেবে। নির্বাচন ব্যাহত করা, নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করার যাবতীয় ব্যবস্থা নেবে বিএনপি ও তার অনুগামীরা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মতে, শেষ পর্যন্ত একটা রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা রয়েছে। গত দুই নির্বাচনের মতো না হলেও কোনো রকমে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সর্বাত্মক চেষ্টা করবে সরকারি মহল। এ ধরনের সম্ভাব্য নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ হবে অনেক বেশি হিংসাত্মক, যা রাজনীতি, রাজনীতিবিদদের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।