প্রবাসে বিএনপির রাজনীতি করেন। কিন্তু গত ১৬ বছর তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের হাতে গুম-খুনের ভয়ে দেশে যাননি তারা। এখন সময় বদলেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশে এখন অন্তবর্তী সরকার। শিগগির নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, তাই এক বুক আশা নিয়ে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আকাক্সক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের বিএনপি নেতারা ছুটে যাচ্ছেন দেশের মাটিতে।
দল যদি মনোনয়ন দেয় তাহলে প্রার্থী হতে চান যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রায় দুই ডজন নেতা। কতজন মনোনয়ন পাবেন, আদৌ কেউ পাবেন কীনা, তা জানেন না কেউ। তাই বলে আশা করা তো দোষের কিছু নয়।
আশায় বুক বাধা এসব নেতা বলছেন, আমরা প্রবাসে নিঃস্বার্থভাবে দেশ ও দলকে ভালোবাসি। নির্বাচনে অংশ নেওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকারেই দেশের মাটিতে পা রেখেছি। আশাকরি দল আমাদের নিরাশ করবে না।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি, নিউইয়র্ক স্টেট, মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং বিভিন্ন অঙ্গ ও সংগঠনের নেতাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনায় এগিয়ে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় নেতারা। দীর্ঘদিন ধরে কোনো কমিটি না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিতে বিভক্তি রয়েছে। ফলে এ দলে নেতার ছড়াছড়ি। সবাই মনে করেন তারা যোগ্য এবং দলের জন্য তারাই নিবেদিত। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতাদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন- জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বেবী নাজনীন, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সদস্য আব্দুল লতিফ সম্রাট, সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সদস্য গিয়াস আহমেদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সদস্য জিল্লুর রহমান জিল্লু, বর্তমান কেন্দ্রীয় সদস্য মিজানুর রহমান মিল্টন ভুঁইয়া, ডা. মুজিবর রহমান মজুমদার, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল পাশা বাবুল, সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, সোবেক সহ-সভাপতি আলহাজ সোলায়মান ভূঁইয়া, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মাহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আকতার হোসেন বাদল, সাবেক সহ-সভাপতি দিনাজ খান (ফ্লোরিডা), সাবেক যুগ্ম সম্পাদক পারভেজ সাজ্জাদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফোরামের সাবেক সভাপতি এ কে এম রফিকুল ইসলাম ডালিম, নিউইয়র্ক মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিবুর রহমান সেলিম রেজা, যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আবু সাঈদ আহমেদ। এসব নেতাদের অনেকে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছেন। অনেকে বাংলাদেশ থেকে ফিরেছেন এবং আবার যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বেবী নাজনীন দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন নিউইয়র্কে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি বাংলাদেশে গিয়েছেন। ইতিমধ্যে নিজ নির্বাচনী এলাকা নীলফামারিতে অলিখিত প্রচারে নেমেছেন তিনি। ঠিকানাকে তিনি জানিয়েছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে দলের মনোনয়ন চাইবেন।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সদস্য আব্দুল লতিফ সম্রাট যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সভাপতি। বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচন করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তিনি নিউইয়র্কে বিভিন্ন সভা সমাবেশে নেতাকর্মিদের কাছে এ জন্য দোয়া চেয়েছেন। গত ১ মাস যাবৎ তিনি বাংলাদেশে।
ঢাকা-১ আসনে নির্বাচন করতে চান যুক্তরাষ্ট্র শাখা বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য গিয়াস আহমেদ। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বিএনপির রাজনীতি করেন। আমেরিকার মূলধারা তথা প্রশাসনে বাংলাদেশ, এমনকী বিএনপির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। তাঁর তৎপরতায় সিনেটর ক্রাউলির নেতৃত্বে বাংলাদেশ ককাস বাংলাদেশ সফর করেছে। তিনি নিজেও ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন। এই ককাসের প্রভাবে চট্টগ্রামে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংসদ হয়েছে তিনি বাংলাদেশকে আরও ভালো সাহায্য করতে পারবেন। তাঁর মতে দলীয় প্রার্থিতা পেলে তিনি প্রত্যাশিত আসনে নিশ্চিতভাবে জয়ী হবেন।
জিল্লুর রহমান জিল্লু সিলেট-৪ (বিয়ানীবাজার) আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী। এলাকায় পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত জিল্লুর রহমান জিল্লু দলীয় নমিনেশন পেলে শতভাগ জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। আগামী ১৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার তার বাংলাদেশে যাবার কথা রয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মিল্টন ভুঁইয়া। সন্দ্বীপের কৃতি সন্তান। স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন কমিটর সাবেক সদস্য সচিব। তিনি ইতোমধ্যেই চট্রগাম-৩ (সন্দ্বীপ) থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই তিনি সন্দ্বীপে গিয়েছিলেন। হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে তিনি সভা সমাবেশ করেছেন। এলাকায় তার পক্ষে জোয়ার উঠেছে। স্থানীয় জনগণ তাকে নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ করছেন। তার স্বপক্ষে সন্দ্বীপে হাজার হাজার পোস্টার শোভা পাচ্ছে। তার নামে হাসিনার শাসনামলে একাধিক মামলা ছিল। তিনি ডিসেম্বরে আবার দেশে গিয়েছেন। জামিন নিয়েছেন মামলাগুলোর। এলাকায় প্রতিদিন সভা-সমাবেশ করেছেন। একই আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা বাবুল। তিনিও এখন বাংলাদেশে।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আলহাজ সোলায়মান ভূঁইয়া জিয়াউর রহমানের সময় থেকে বিএনপির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তিনি ফেনী-৩ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন এবং নিজ এলাকায় তার বিশেষ পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপির নির্যাতিত ও পঙ্গু হয়েছেন এমন নেতা-কর্মীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। গত ৭/৮ বছর ধরে তাদের মামলার খরচ জোগান। ঈদ উপলক্ষে তার ইউনিয়নের দরিদ্রদের মধ্যে সেমাইসহ নানা সামগ্রী বিতরণ করেন। কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের জন্য ‘লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পাঠিয়েছেন।
চাঁদপুর-৫ আসন থেকে প্রার্থী হতে চান আকতার হোসেন বাদল। তিনি দেশে-প্রবাসে বিএনপির জন্য কাজ করছেন। তাঁর দাবি, তিনি আমেরিকার মূলধারার কাছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিএনপির সমস্যা তুলে ধরছেন। তিনি বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠিত আরএলবি (রুদশী-লিপি-বাদল) ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাঁর এলাকায় বৃত্তি ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়ে, স্কুল-কলেজে কম্পিউটার-ল্যাপটপ দিয়ে, দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিয়ের জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে তিনি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। আমেরিকায় অর্জিত অভিজ্ঞা ও প্রযুক্তি বাংলাদেশে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ছাত্রজীবন থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী পারভেজ সাজ্জাদ চট্টগ্রাম-১০ আসন থেকে মনোনয়ন চান। তিনি বলেন, দেশে বিএনপির নির্যাতিত, কারাবন্দী ও মামলার আসামি প্রায় ২০০ নেতা-কর্মীর জন্য তিনি তাঁর আয়ের একটি অংশ নিয়মিত ব্যয় করছেন। তাঁদের পরিবারের জন্য ঈদের খরচ পাঠান। আর্থিকভাবে অসচ্ছল, কিন্তু লজ্জায় ভিক্ষা করতে পারেন না, তার এলাকার এমন ব্যক্তিদের তিনি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন। এলাকায় প্রতিষ্ঠিত তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেও তিনি জনগণের সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন।
মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনে প্রার্থী হতে চান ফ্লোরিডা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি ব্যবসায়ী দিনাজ খান। তিনি বলেন, ‘দেশে ও প্রবাসে আমার বিপুল সম্পদ আছে। দেশের স্বার্থে সততার সঙ্গে কাজ করার জন্যই আমি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাই। আমি মসজিদে, গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করি। আমার কোনো বদনাম নেই।’
ঢাকা-১০ আসন (সেনাপাড়া-পর্বতা) থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন বিএনপি নেতা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, দেশে-প্রবাসে তিনি বিএনপির জন্য নিবেদিত। তাঁর দাবি, ঢাকা-১০ আসনের তিনি স্থায়ী বাসিন্দা। ওই এলাকায় বিএনপির যোগ্য প্রার্থী নেই। তিনি এলাকার বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন। নির্বাচন করার উদ্দেশ্যে তিনি প্রায়ই বাংলাদেশে যান।
আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, যুক্তরাষ্ট্র জাতীয়তাবাদী দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ কে এম রফিকুল ইসলাম ডালিম। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রথম সভাপতি ডা. মুজিবুর রহমান মজুমদার নির্বাচনে অংশ নেবেন কীনা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও তার নাম শোনা যাচ্ছে।
নিউইয়র্ক স্টেট বিএনপির প্রায় ৮ জন নেতা বর্তমানে দেশে রয়েছেন। তারা হলেন- স্টেট বিএনপির সভাপতি মাওলানা অলিউল্লাহ আতিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান সাঈদ, সিনিয়র সহ-সভাপতি জসিমউদ্দীন ভূঁইয়া ভিপি, স্টেট বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির, শাহিন আব্দুল্লাহ, রানা চৌধুরী ও কাওসার আহমেদ। কার্যত দেখা যাচ্ছে নিউইয়র্ক স্টেট বিএনপির পুরো কমিটিই বাংলাদেশে।
নিউইয়র্ক সিটি (দক্ষিণ) বিএনপির সভাপতি সেলিম রেজা। তিনি ঝালকাঠি-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে মরিয়া। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে গিয়ে দুই মাস এলাকায় সভা সমাবেশ ও কর্মিসভা করেছেন।
একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আকাক্সক্ষায় যেসব বিএনপি নেতা বাংলাদেশে ছুটে গেছেন তাদের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। বাংলাদেশের আইনে অন্য দেশের নাগরিকত্ব আছে এমন কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না। তবে এসব নেতারা বলছেন, মনোনয়ন পেলে নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে রাজি আছেন।