Thikana News
১৩ জানুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫

পৃথিবীর সকল স্বৈরশাসক একে অপরের প্রতিচ্ছবি

পৃথিবীর সকল স্বৈরশাসক একে অপরের প্রতিচ্ছবি
স্বৈরাচার, স্বৈরশাসক, ফ্যাসিবাদী শাসন শব্দগুলো প্রায় কাছাকাছি, শাসনব্যবস্থাও প্রায় একই ধরনের। অর্থাৎ এক ব্যক্তিই সর্বেসর্বা, তার কথায়ই চলবে সবকিছু। গত বছর মাত্র চার মাসের ব্যবধানে পৃথিবীর দুটি দেশের স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে প্রায় একইভাবে। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে মুক্তির স্বাদ পেয়ে মানুষ উৎসবে মেতে উঠল। মানবিক, গণতান্ত্রিক এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির আধুনিক বিশ্বে স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথরের নিচে মানুষ নিষ্পেষিত হবে, তা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা নয়। তাই সিরিয়ার জনগণ বাপ-বেটার ৫৪ বছরের শোষণ-নির্যাতন থেকে গত ৮ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছে। ১৯৭০ সালের এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাফিজ আল আসাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সেই সময় দেশে ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনীতি ও আরব জাতীয়তা সংকটে জর্জরিত। ক্ষমতায় বসেই তিনি বাথ পার্টিকে কেন্দ্র করে সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে একদলীয় শাসনে মনোযোগী হন। তিনি ভালোভাবেই জানতেন, ৮৭% সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক পন্থায় কখনো ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী থাকতে পারবেন না। কারণ তিনি ছিলেন মাত্র ১০% আলাবি শিয়া বিশ্বাসী লোক। তাই তিনি সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিজের আত্মীয়স্বজনসহ দলের বিশ্বস্ত লোকদের নিয়োগ দিয়ে জনগণের ওপর শাসন চালাতে থাকেন। ১৯৮২ সালে একটি এলাকায় আন্দোলন দমাতে তার ভাই রিফাতের নেতৃত্বে আর্মি অভিযান চালিয়ে মাত্র ২৬ দিনে প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করেন। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পরিষ্কার জানান দেন, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন বা কথা বললে কারও পরিণতি ভালো হবে না। কিন্তু তার এই কঠিন বার্তা কি মানুষের মনের আগুন দমাতে পারে? স্বাভাবিক নিয়মেই হাফিজ আল আসাদকে সিরিয়ার স্বজনহারাদের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো।
২০০০ সালে পিতার মৃত্যুর পর বাশার আল আসাদ নাটকীয়ভাবে ক্ষমতায় বসেন। তখন সিরিয়ার সংবিধানে প্রেসিডেন্ট হওয়ার বয়সের নিয়ম ছিল ন্যূনতম ৪০ বছর। কিন্তু বাশার আল আসাদের বয়স ছিল ৩৪। পার্লামেন্টে মাত্র ২২ মিনিটের আলোচনায় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসার পথ পরিষ্কার করে সিংহাসনে বসেন। ক্ষমতায় এসে তিনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুদিন পরই দেখা গেল বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। বরং তিনি বিরোধী মত দমনে বাবার চাইতে কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন।
বাশার সরকারের গোপন বন্দিশালায় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যুগের পর যুগ লোমহর্ষক অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হতো। দামেস্কের ‘সেদনায়া কারাগারে’ মাটির নিচে চারতলা বিল্ডিংয়ে টর্চার সেলে হাত ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হতো। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া দেওয়া হতো না। মানবাধিকার সংগঠন ‘সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের’ তথ্য অনুযায়ী, সেই বন্দিশালায় অন্তত ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৪ জন নারী-পুরুষ বন্দী ছিলেন। সেখান থেকে খুব কম লোকজনই মুক্তি পায়। শত শত লোকের মরদেহ একসঙ্গে কেমিক্যাল ব্যবহার করে ধ্বংস করা হতো। আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত বন্দীদের জবানবন্দিতে জানা যায় জীবনের তথ্যচিত্র। সেই বন্দিশালায় নাম ধরে ডাকা হতো না। কারণ একই নামে একাধিক ব্যক্তি ছিল। সে জন্য নম্বর দেওয়া ছিল, সেভাবে কল করা হতো। তারা কোনো দিন ভাবতেই পারেননি লৌহমানব বাশারের পতন হবে। আর তারা মুক্ত হয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখবেন।
আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায় প্রভাবিত করে। দক্ষিণাঞ্চলের একটা ছোট্ট শহর দারাহ, সেখানে নবম শ্রেণির ছাত্র মুয়াবিয়া সায়সানেহ দেয়ালে গ্রাফিতি লেখেন, ‘ডাক্তার, এখন তোমার পালা।’ বাশার ছিলেন একজন চক্ষু চিকিৎসক। এই গ্রাফিতি গোয়েন্দাদের চোখ এড়াতে পারেনি। তারা হন্যে হয়ে খোঁজে সেই বালককে। কিন্তু তাকে না পেয়ে ছয় ডজন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে এবং সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। কিন্তু সরকারের দমন-নিপীড়ন চূড়ান্ত পর্যায়ের ছিল। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এই আন্দোলন বর্তমান শতকের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এই গ্রাফিতি স্মারক হয়ে ওঠে জাতীয় বিদ্রোহের। গত ১৩ বছরের যুদ্ধে প্রাণ হারায় প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক লোক। ধ্বংস করা হয়েছে অনেক শহর, বন্দর, লোকালয়। আর এই গণবিরোধী সরকারকে টিকে রাখার জন্য পাশে এসে দাঁড়ায় রাশিয়া, ইরান। মিত্রশক্তির ওপর সিরিয়ার সেনাবাহিনী নির্ভরশীল হওয়ায় তাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। বর্তমানে রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত এবং ইরান, হিজবুল্লাহ, ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিনিয়ত হামলা পাল্টা হামলা চলছে। স্বৈরশাসকের দোসরদের এই দুর্বল সময়েরই সুযোগ নেয় বাশার-বিরোধী বিদ্রোহীরা। আর নেতৃত্বে আসেন ৪২ বছর বয়সী চৌকস যোদ্ধা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি এবং তার সংগঠন হায়াত তাহরীর আল শাম। ২৭ নভেম্বর স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের বাহিনীর ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ করে। ৮ ডিসেম্বর, মাত্র ১২ দিনের মাথায় বাপ-বেটার ৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের মসনদ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। বাশার আল আসাদ এই বিপদের সময় পরিবার নিয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু পুতিনের রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচান।বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা লক্ষ করা যায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। যে নেতাকে মানুষ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসত, তিনি জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে ধরে রাখার জন্য পদক্ষেপ নেন। তার শাসনামলে স্বাধীন বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হওয়ার মধ্য দিয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়। এরপর জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন ছিল বিতর্কিত। পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের আদর্শের বিশ্বাসীদের নিয়ে রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিরোধী দলকে দমন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের পথ বেছে নেন। কথিত আছে, শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে জাসদসহ বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। বামপন্থী নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যা করে সংসদে দাঁড়িয়ে দাম্ভিকতার সঙ্গে মুজিব বলেছিলেন, কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ছিল মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মাত্র কয়েক মিনিটের আলোচনায় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠন করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তার প্রতিবাদস্বরূপ মন্ত্রিসভার সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন পদত্যাগ করেন। চারদিকে ছিল হাহাকার। পাহাড়সমান জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তায় ধস নামে এবং ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী একদল সেনার অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন।
১৯৭৫ সালের পর ভঙ্গুর আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার জন্য সিনিয়র নেতারা কাজ শুরু করেন। দলের ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে বিদেশে বেঁচে থাকা মুজিব-তনয়া শেখ হাসিনাকে সভাপতির আসন দিয়ে ১৯৮১ সালে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। ’৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পালাবদলে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরই তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করেন। খবরে প্রকাশ, দেশি ও বিদেশি শক্তির সহায়তায় প্রথমেই বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারকে হত্যা করে নিজের ভবিষ্যৎ পথ পরিষ্কার করেন। বিডিআর বিদ্রোহে বিচারের নামে প্রহসন স্বজনহারাদের পরিবার মেনে নেয়নি। তারা এই হত্যাকাণ্ডের পুনঃ তদন্ত ও প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করছে এবং জেলে নিরপরাধ বন্দীদের মুক্তি দাবি করছে। এই হত্যাকাণ্ডের পর আমাদের শক্তিশালী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দন্তহীন বাঘে পরিণত করেন। এর পর থেকে শুরু হয় বিরোধী দলের ওপর দমন, নিপীড়ন, হত্যা, গুম। মানুষের কথা বলার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের জন্য সাইবার সিকিউরিটি আইনসহ বিভিন্ন কালাকানুন সংসদে পাস করে কণ্ঠ রোধ করা হয়। নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে আন্তর্জাতিক মতামতকে উপেক্ষা করে বিরোধী দলকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচনের নামে দেশে তামাশা হয়। কখনো বিনা ভোটে নিজস্ব প্রার্থীদের অটো পাস করেন। আবার দিনের ভোট রাতে সমাপ্ত করে অথবা ডামি নির্বাচনের নামে মানুষের গণতন্ত্র হরণ করে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর শাসন করেন।
ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে রাখার জন্য সিরিয়ার বাশার সরকারের ন্যায় বিচার বিভাগ, আইন, শাসন বিভাগে নিজস্ব লোক বসিয়ে দেন শেখ হাসিনা। পুলিশ বাহিনী ও র‌্যাবকে নিজের লাঠিয়াল বাহিনীতে রূপান্তরিত করে বিরোধী মত দমনে ব্যবহার করেন। আয়নাঘর সৃষ্টি করে যে অত্যাচার-নির্যাতন করার ইতিহাস বেরিয়ে আসে, তা বাশার আল আসাদের সেদনায়া কারাগারকেও হার মানায়। সম্প্রতি সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের গুম-খুনের তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে লোমহর্ষক প্রতিবেদন বেরিয়ে আসে। যে রিপোর্ট জাতিসংঘ, নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই রিপোর্টে শেখ হাসিনার সরাসরি সংযুক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। তা ছাড়া বাশার সরকারের ন্যায় দলের লোক, পরিবারের সদস্য দ্বারা মাফিয়াতন্ত্র সৃষ্টি করে দেশকে শোষণ করা হয়েছে। অর্থনীতি লোপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাশার আল আসাদ যেভাবে তার বাবা হাফিজ আল আসাদের নামে রাষ্ট্রীয় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মূর্তি, ভাস্কর্য ইত্যাদি দেশের সর্বত্র করেছিলেন; ঠিক একইভাবে শেখ হাসিনা দেশের সর্বত্র শেখ মুজিবের মূর্তি, ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরি করেন। শুধু তা-ই নয়, দেশের হাসপাতাল, ব্রিজ, টানেল, স্টেডিয়াম, মসজিদ, রাস্তাঘাটসহ দেশে যত স্থাপনা হয়েছে, সবকিছু বাবা অথবা পরিবারের সদস্যদের নামে নামকরণ করেন। যা নিয়ে দেশের মানুষ ছিল বিরক্ত। সেই বিরক্তির কারণেই পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায় সিরিয়ার বিক্ষুব্ধ জনতা সবকিছু ভেঙে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। এই প্রতিকৃতি, ম্যুরাল, ভাস্কর্য ভাঙার উৎসবে দুই দেশের মধ্যে হুবহু মিল ছিল।
দুই স্বৈরশাসকের পতনের সূত্রও ছিল প্রায় এক। সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের ছোট শহরের নবম শ্রেণির ছাত্রের গ্রাফিতি থেকে যে নির্যাতন নেমে আসে, সেখান থেকে গৃহযুদ্ধের শুরু। দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে শেষ আঘাতের মাত্র ১২ দিনের মাথায় পরিবার নিয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য রাশিয়ায় পালিয়ে যান। সেই দাম্ভিকতা ভরা সাহসী বুলি কিছুই ধোপে টেকেনি। সিরিয়ার মাটি তার জীবদ্দশায় স্পর্শ করতে পারবে কি না তা বলা কঠিন।
ঠিক তদ্রƒপ দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর দমন-নিপীড়ন করে ক্ষমতা চালিয়ে গেলেও শেষ মুহূর্তে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শেষ পরিণতি এক দফার আন্দোলন। অর্থাৎ শেখ হাসিনার পতন। শেখ হাসিনার অবিশ্বাস্য পতন হলো। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রাণরক্ষার জন্য সপরিবারে পালিয়ে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে অন্য দেশে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও কেউ তাকে গ্রহণ করেনি। তিনিও দাম্ভিকতার সঙ্গে প্রায়ই বলতেন, আমার বাবা দেশ স্বাধীন করেছেন। এটা আমাদের দেশ। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে পালায় না ইত্যাদি। কিন্তু সব মিথ্যে হয়ে গেল। তবে রাশিয়ায় পলাতক বাশার আল আসাদ নীরব আছেন। রাজনৈতিক ব্যাপারে কোনো কথা বলছেন না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শেখ হাসিনা ভারতে বসেও সরব। একটার পর একটা দাবিদাওয়া আদায়ের নামে আন্দোলন ও সংগ্রাম করে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের পাঁয়তারা করছেন। লন্ডন, আমেরিকার বিভিন্ন সভায় জুমের মাধ্যমে বক্তৃতা দিয়ে কর্মী বাহিনীকে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করছেন। ভারতীয় কিছু মিডিয়াকে লেলিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর খবর দেওয়া হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা কী অর্জন করছেন? পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে, যা কোনো দেশপ্রেমিক জনগণের কাম্য নয়। বর্তমান সরকার শেখ হাসিনাকে চুপ থাকতে বলেছে। সম্প্রতি ভারতীয় সরকারের কাছে তাকে দেশে ফেরত চাওয়া হয়েছে। তাকে নিয়ে এসে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
রাজনীতি করতে হলে জনগণের ভালোবাসা অর্জন করতে হয়। এই ভালোবাসা ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতি, অর্থনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে যাওয়া যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পার হয়েছে। সমসাময়িককালে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশ উন্নয়নের শিখরে। কিন্তু আমরা যেন একই বৃত্তে ঘুরছি। এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ভিশনারি, দেশপ্রেমিক, নেতা ও দলের একান্ত প্রয়োজন। যারা বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের পতনসহ সিরিয়া, শ্রীলঙ্কা, তিউনিসিয়াসহ পৃথিবীর বহু স্বৈরশাসকের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক
 

কমেন্ট বক্স