গত দুই মাসে সীমান্তবর্তী জেলা মৌলভীবাজারের একটি উপজেলায় হঠাৎ করেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এবং খুন-খারাবি বেড়ে গেছে। আগে কখনও এমনটা ঘটেনি দাবি করে স্থানীয়রা বলছেন, চুরি-ডাকাতির ভয়ে রাতে ঘুমানোও মুশকিল হয়ে গেছে, সাধারণ মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন মহল। তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে নিয়মিতই অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। শিগগির দোষীদের গ্রেফতার করা যাবে বলেও আশা প্রকাশ করছেন তারা।
স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশ প্রকৃত চোর-ডাকাতদের আটক করতে না পারায় তারা বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। চুরি-ডাকাতির অধিকাংশই রাতের বেলা বিভিন্ন বাসা-বাড়ি এবং দোকানে সংঘটিত হচ্ছে। লুট হচ্ছে ব্যবসায়ীদের টাকা-পয়সাসহ বিভিন্ন মালামাল। জুন-জুলাই দুই মাসের ব্যবধানে উপজেলায় বেশ কয়েকটি চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য জানা যায়, গত ১ জুন কুলাউড়ায় ‘মিলিপ্লাজা শপিংমল’ থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকার মোবাইল ফোন চুরির করে নিয়ে যায় চোর চক্র। এর সপ্তাহ দুয়েক পরে গত ১৫ জুন রাতে পৌরসভা শহরের সাদেকপুর মতিউর রহমান জুনেলের বাসার আলমারি ভেঙে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে গেছে চোরচক্ররা। এ ঘটনায় থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী।
আবার ১০ জুলাই ভোরে কুলাউড়া শহরের মাগুরা শহরের বাসার সামনে থেকে ঢাকাস্থ জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন আহমদের প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো-গ ২৫-০১৮৪) চুরি হয়েছে। গাড়িটির বাজার মূল্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা। অ্যাডভোকেট মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমার প্রাইভেট কার বাসার সামনে থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে কে বা কারা। চুরির প্রায় ২০ দিন অতিবাহিত হলেও কিন্তু পুলিশ এখনও পর্যন্ত সন্ধান দিতে পারেনি।‘
শুধু চুরিই নয়, এই দুই মাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যার ঘটনাও ঘটেছে এই উপজেলায়। গত ৩ জুলাই বিকালে উপজেলার ঘাগটিয়া গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে মুহাম্মাদ জিলান (২২) মোটরসাইকেলযোগে তার ছোটভাইকে বাসে তুলে দিতে কুলাউড়া শহরে যান। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শহরের দক্ষিণ বাজারস্থ বাস স্ট্যান্ডে জিলান তার ছোটভাইকে নামিয়ে দিয়ে ফেরার পথে বাস স্ট্যান্ডেই আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা ছয় থেকে সাত জন দুর্বৃত্ত কুপিয়ে হত্যা করে।
২৯ জুন ঈদের দিন সন্ধ্যায় কুলাউড়া জয়চন্ডী ইউনিয়নের পুষাইনগর বাজারে একটি দোকানের বকেয়া টাকা চাওয়ায় ও বাকিতে পণ্য না দেওয়ায় মারধরের শিকার হয়ে মোহাম্মদ নজাক আলী (৫৫) নামে এক বৃদ্ধ মৃত্যু হয়েছে।
গত ২৩ জুলাই কুলাউড়ায় কথা-কাটাকাটির জেরে চাচা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হামলায় রুবেল আহমদকে (৩২) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২৫ জুলাই কুলাউড়া পৌর শহরে দক্ষিণ বাজারের একটি পুরাতন ভবনের পরিত্যক্ত শৌচাগারের ভেতর থেকে অজ্ঞাত যুবতীর (২৫) অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
চুরি-হত্যা ছাড়াও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২৯ জুন ঈদের দিন রাতে কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নে পাইকপাড়া বাজার এলাকায় একটি ঘরে ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য ছালিক বক্সের নেতৃত্বে এক নারীকে (৩২) দল বেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পরে ওই নারী বাদী হয়ে ছালিক বক্সকে প্রধান আসামি করে তিন জনের বিরুদ্ধে কুলাউড়া থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন।
কুলাউড়া ব্যবসায়ীদের প্রতীকী অনশন
এদিকে চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই রোধে গত ১৬ জুলাই দুপুর ১২টায় কুলাউড়া পৌর শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রতীকী অনশন পালন করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এই প্রতীকী অনশন পালন করা হয়। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ অনশনে অংশ নেয়।
অনশনে বক্তারা বলেন, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির সাথে জড়িত অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবি জানান। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের চুরি হওয়া মালামাল উদ্ধারে ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের অপসারণের দাবি জানান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে যে কোন মুহূর্তে কুলাউড়া শহরের সর্বস্তরের দোকান পাঠ বন্ধ রাখার আল্টিমেটাম দিয়েছেন বক্তারা।
প্রতীকী অনশনে কুলাউড়া ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বদরুজ্জামান সজল সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এম আতিকুর রহমান আখই পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি হাজী রফিক মিয়া ফাতু, মৌলানা আব্দুল ওয়াহিদ, সিনিয়র সহ-সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জায়েদ, কোষাধ্যক্ষ হাফিজ বদরুল ইসলাম, দফতর সম্পাদক ডাক্তার কুতুব উদ্দিন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এইচ ডি রুবেল, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক খন্দকার আফজাল হোসেন, নারী উদ্যোক্তা বিষয় সম্পাদিকা সুফিয়া রহমান ইতি, হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকমান মিয়া, প্রমুখ। পরে ব্যবসায়ীদের জুস খাইয়ে অনশন ভাঙান প্রবীণ ব্যবসায়ী সৌম্য প্রদীপ ভট্টাচার্য।
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের জান-মাল রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ উল্টো, কেউ কোনও দায়িত্ব নিচ্ছেন না। কুলাউড়ায় আগে এই ধরনের কোনও চুরি ডাকাতির কোনও ঘটনা সংঘঠিত হয়নি। আমরা হতাশ, চোর ডাকাতের ভয়ে রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না।’
এ ব্যাপারে কুলাউড়া থানার ওসি মো. আব্দুছ ছালেক বলেন, ‘এই চোরচক্র অনেক সক্রিয়। তাদের গ্রেফতার করতে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের অভিযান রয়েছে। আশাকরি শিগগিরই চোর ডাকাত গ্রেফতার করা সম্ভব।’
মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. মনজুর রহমান বলেন, ‘কী কারণে খুন-খারাবি এবং চুরি-ডাকাতি সংঘটিত হচ্ছে বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। জেলায় আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করবো।’
ঠিকানা/এসআর