বাংলাদেশে ছাত্রলীগ হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠন।
সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালের চার জানুয়ারি। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সংগঠনটির নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। আসলে তৎকালীন মুসলিম লীগের কিছু বাঙালি নেতা সংগঠনটির জন্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু সংগঠনটির জন্মের মুহূর্তে মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতারা বিষয়টাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি বলেই অল্প দিনের ভেতরে দুই দলের মধ্যে একটা অলিখিত বিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল। শুরুতে আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন নাঈম উদ্দিন আহমদ এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দবিরুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন খালেক নেওয়জি খান। শুরুতে প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে থেকে আল আহাদ সংগঠনটির নামের সঙ্গে যুক্ত মুসলিম শব্দটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসলেও জন্মের প্রায় পাঁচ বছর পরেÑ অর্থাৎ ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে ১৯৫৩ সালে ছাত্রলীগের নামের আগে থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দেয়া হয়। ওই সংগঠনের মূল নীতি ছিল ‘শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি’ সাদা জমিনের পতাকায় চিহ্নিত নিচের প্রান্তে তিনটি লাল অগ্নিশিখাকে আন্দোলনের এবং সংগ্রামের স্মারক হিসেবে ধরে নিয়ে অগ্নি শিখার উপরে তিনটি সবুজ তারকা দিয়ে মূল নীতি শিক্ষা শান্তি ও প্রগতির প্রতি আনুগত্য জানানো হয়েছে।
এক সময়ে ওই ছাত্র সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাম করা সব ছাত্র নেতারা। এর ভেতরে অন্যতম ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও শাহ মোয়াজ্জম হোসেন, রফিকুল্লাহ চৌধুরী, কামরুজ্জামান কে এম ওবায়দুর রহমান নূরে আলম সিদ্দিকী শাহজাহান সিরাজ আবদুল কদ্দুস মাখন আ স ম আব্দুর রব, শেখ ফজলুল হক মনি শেখ সহিদুল ইসলাম, ফেরদৌস আহমদ কোরেশি, সিরাজুল আলম খান, খালেক নওয়াজ খান, ওবায়দুল কাদের, সুলতান মনসুরসহ আরও অনেকে যাদের ভেতরের প্রায় সবাই পরবর্তী সময়ে জাতীয় নেতা হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ৪৭-পরবর্তী সময়ে ওই ছাত্র সংগঠনটি জাতীয় প্রতিটি আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিল বিশেষ করে বায়ান্নের ডাক। আন্দোলন ছিল সংগঠনটির জন্মের পরপরই সংগঠিত সবচেয়ে বড় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলনের পথ ধরেই একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তাত্ত্ব ইতিহাসের অভ্যুদ্বয়। তাই ৫২-এর প্রেক্ষাপট ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ৪৮ সালের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যখন ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তার সেই ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করে দেশবাসী যে বিস্ফোরণ ঘটে ছিল তার প্রথম সূচনা ঘটায় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্ররা। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তার বেশ কয়েক বছর পরে। মাঝখানে কয়েকটা বছর ধরে পাকিস্তানি শাসকেরা ওই একই কথার পুনরাবৃত্তি করা যখন অব্যাহত রাখলেন তার সমাপ্ত ঘটল ৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের গুলিত তখন নিহত হলেন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত ছাড়াও- রিকশাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক আরও এক কিশোর। শেষ পর্যন্ত শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৫৪ সালের সাত মে পাকিস্তানি গণপরিষদে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে মেনে নিলে আন্দোলনের এক সফল সমাপ্তি ঘুটেছিল। ওই ভাষা আন্দোলনেও সেই সময়ে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়েছিল। তার পরের ঘটনা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী নেজামে ইসলামী পার্টির মৌলানা আতাহার আলী, বামপন্থি নেতা গণতন্ত্রী দলের হাজী দানেশ ও সিলেটের মাহমুদ আলী, মোট পাঁচটি দল মিলে যুুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। তারা একুশ দফার একটি নির্বাচনি ইশতেহারও প্রকাশ করেছিল যার মধ্যে প্রধান দাবি ছিল ‘লাহোর প্রস্তাব’ এর ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসন দেয়া। ওই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা, মুসলিম লীগকে পরাজিত করেÑ ৫৪ সালের ২৫ মার্চ এ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় লাভ করেছিল। মুসলিম লীগ, পেয়েছিল মাত্র ৯টি আসন অন্য দিকে যুক্তফ্রন্ট পায় ১২৩টি আসন যার ফলে ১৯৫৪ সালের চার এপ্রিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে মুখ্য মন্ত্রী করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলে ওই মন্ত্রিসভার সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য। ওই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তৎকালীন ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করেÑ ওই সময়ে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধু ভ্যানগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। একইভাবে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনেও ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় ছিল বিপুল ভোটে তৎকালীন মুসলিম লীগকে হারিয়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করলেও সেই মন্ত্রিসভার মেয়াদ ছিল মাত্র ৫৫ দিনের মতো। অর্থাৎ ৫৪ সালের তিন এপ্রিল থেকে ৩১ শে মে। ওই ৩১ শে মে তারিখে দেশদ্রোহে অভিযোগে তৎকালীন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ৬২ সালের শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন ৬৭ সালের স্বাধীকার আন্দোলন এবং শেষ পর্যায়ের ৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামে তৎকালীন ছাত্রলীগের ভূমিকা এক কথায় অসাধারণ ছিল। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ছাত্রলীগ মুজিব বাহিনী নাম ধারণ করে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল, মূলত তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বেও জেনারেল ওসমানীর তত্ত্বাবধানে যুদ্ধের যে ৯ মাস মুক্তিবাহিনী বীরবিক্রমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল সেই মুক্তিযুদ্ধে- ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। শেখ মনিসহ ছাত্রলীগের অন্য সদস্যরা নিজেদেরকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েÑ যুদ্ধের ইতিহাসটা অন্য মাত্রায় টেনে নিয়ে যেতে ছেয়ে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগের প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাসের অংশ। বলা হয়ে থাকে ১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যখন কোনো বিরোধী দল ছিল না তখন ছাত্রলীগ ছিল অর্থাৎ ষাটের দশকের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলন সবখানে ছাত্র লীগের জোরালো ভূমিকা ইতিহাসের এক অনবদ্য অধ্যায়। সেখানে ছয় দফাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের বিজয়েদ্বিধ। বিভক্তি স্পর্ষ্ট হয়ে উঠেছিল সেই অবস্থাতে ছাত্রলীগ ছয় দফাকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এমনকি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠা ছাত্রলীগ গণতন্ত্রকামী জনতার আশার আর ভরসার স্থল হয়ে উঠেছিল, তাই দেখা যায় দোসরা মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ প্রথম স্বাধীনতার পতাকা তুলার সাহসটাও দেখাতে পেরেছিল সংগঠনটি। কিন্তু বাহাত্তর-পরবর্তী সময়কালে ছাত্রলীগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট অন্য মাত্রায় রূপ ধারণ করে যখন শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের একুশ ফেব্রুয়ারি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কথা বলে জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামে একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করলেন। শুরুতে মুজিব বাহিনী অর্থাৎ ছাত্রলীগের কর্মীদের দ্বারা গঠিত হলেও পরে ওই রক্ষীবাহিনীতে কাদেরীয়া বাহিনীও যোগ দেয়। গঠনের অল্প দিনের ভেতরে ওই রক্ষীবাহিনীর দু’রাচার ও তাণ্ডবে দেশের ভেতরে চরম এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে ছিল। ক্রমে ক্রমে দানব শক্তি রূপে আবির্ভূত হওয়া ওই রক্ষীবাহিনীর হাতে দেশজুড়ে প্রায় ৩০ হাজারের মতো মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়ে পড়েছিলেন বলে প্রচলিত ইতিহাস সাক্ষী দেয়। যদিও প্রাথমিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখাসহ অন্যান্য কাজের অজুহাতে এই বাহিনী জাতীয় সরকার কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত উল্লেখিত ছিল। কিন্তু অল্প দিনের ভেতরে রাজনৈতিক হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো কাজে জড়িয়ে পড়ে স্বৈরাচারকে অনেকটা বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ এমন কোনো বিষয় ছিল না যা করতে তারা দ্বিধাবোধ করত। অনেকের মতে ওই রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে কেবলমাত্র ‘গেস্টাপো’ বাহিনীকে তুলনা করা যায়। তাদের ওইসব কাজ কারবার যখন জাতীয় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া শুরু হলো সেই বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার তখন স্বতপ্রণোদিত হয়ে ৭৪ সালের সাত ফেব্রুয়ারি জাতীয় রক্ষীবাহিনী অধ্যাদেশ ৭২-এর একটি সংশোধনী জারির মাধ্যমে ১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হলো সরল বিশ্বাসে কৃত বা ইচ্ছাকৃত কোনো কাজের জন্য রক্ষীবাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো মামলা প্রসিকিউশন বা কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। মূলত এই সংশোধনীটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম একটা দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মতো। যার কারণে ছাত্রলীগ এর সহায়তায় জন্ম নেয়া রক্ষীবাহিনীর আরও দুর্বিনীত হয়ে উঠার কথা। কিন্তু পচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতীয় ইতিহাসে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সেই ঘটনার পরে রক্ষীবাহিনীকে যখন জাতীয় সেনা বাহিনীর সঙ্গে আত্মীকরণ করা হলো তারপর থেকে বহু বছর ছাত্রলীগের প্রায় বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার কাহিনী ইতিহাসের অন্য আর এক অধ্যায়। কথায় বলে সাপ যতই আক্রান্ত হোক সুযোগ পেলে সে ছোবল মারবেই। ছাত্রলীগের দশা তাই সাপের মতো, ছোবল সে মারবেই, আর সুযোগ পেলে সে হাল ছেড়ে দেবে না। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় পর্যায়ে শেখ হাসিনা কর্তৃক শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর ছাত্রলীগকে তাই সর্প দর্শনের ভূমিকায় দেখা গেছে। বাপ ছাত্রলীগকে ইনডেসিনিটি দিয়ে রক্ষী বাহিনীর ভূমিকায় একটা দানব শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। তারই দেখানো পথ ধরে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগকে মূলত সরকারি পেটুয়া বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন। নব্বই দশক থেকে যার উত্থানের পর্ব শুরু। দুর্নীতি চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণসহ সব অন্যায় কাজের দোসর হিসেবে ছাত্রলীগের নতুন ভূমিকার সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম ঘটলেও হাসিনা সরকার তাকে তোড়াই তোয়াক্কা করে গেছেন, তাই একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে গেছে ছাত্রলীগধারী নামের সরকারের পেটোয়া বাহিনীটি তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে অন্যতম হলো- ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশ্বজিৎ দাশ নামক এক যুবককে ছাত্রদল করার অভিযোগে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করার কাহিনী। প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিৎকে তারা আক্রমণ করেছিল কারণ তারা নিশ্চিত ছিল ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ এর জেরে পার পেয়ে যাবে তারা এবং এই আত্মবিশ্বাসটাই লীগপন্থি ছাত্রদের দুর্নীতি করে তুলেছিল। বেপরোয়া হয়ে ওঠার পথ পরিক্রমায় বিগত পনেরো বছরেÑ প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে শুধুমাত্র ছাত্রলীগের হাতে ৮৬ জনের মতো ছাত্র খুনের ঘটনা ঘটেছিল। তার ভিতরে অন্যতম কয়েকটি ঘটনা হলোÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র আবু বকর হত্যাকাণ্ড। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের হাতে নিহত হয়েছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের নিহত হয়েছিলেন ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি। এই ধরনের আরও বহু খুনের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে রয়েছে নাহিদ হোসেন হত্যা, সাদ ইবনে মমতাজ হত্যাকাণ্ড, তোফাজ্জল হোসেন হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য। মারাত্মক আঘাতে শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দিয়ে আরও কিছু ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল ছাত্রলীগের কর্মীরা। তার মধ্যে এহসান রফিককে ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি একটা পরিকল্পিত চুরির অজুহাত খাড়া করে এতটাই মারধর করা হয়েছিল যে একটা চোখ হারিয়ে অন্ধ জীবনে প্রবেশ করতে হয় তাকে। একইভাবে ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মাহাদি আকিবকে এতটাই শারীরিক নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছিল, যে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে বহুদিন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়েছে। এরকম আরও নির্যাতনের শিকার হয়েছন (খুলনা) কুয়েটের শিক্ষার্থী জাহিদুর রহমান ২০১১ সালে ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র এসএম আলী ইমাম। সবগুলোই ঘটেছে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে, তবে সব থেকে আলোড়িত ঘটনা ছিল বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি- জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেয়ার অপরাধে আবরারকে শিবিরের ক্যাডার এই অভিযোগ খাড়া করে ছাত্রলীগের দলবদ্ধ কয়েকজন মিলে পিটিয়ে হত্যা করেছিল ২০১৯ সালের সাত অক্টোবর। এই হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম হলে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি বন্দের নির্দেশ দেয়া ছাড়াও ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৬ জন ছাত্রকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছিলেন। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব ছাত্রলীগ কর্তৃক এই ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিয়ে একটা প্রেসনোট প্রকাশ করছেন সেখানে বলা হয়েছে বিগত ১৫ বছরে- ছাত্রলীগের হাতে ৮৬ জন শিক্ষার্থী মারা যাওয়া ছাড়াও ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ১৪ জন ছাত্রী, যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছেÑ ৬৯ জনের সঙ্গে। সবমিলিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন এক হাজার ৩২ জন। এ ছাড়া এই সন্ত্রাসীদের দ্বারা ৫৩টি চাঁদাবাজি, ৩৯টি টেন্ডারবাজি ও ত্রিশটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়াও এই সময়ের মধ্যে ছাত্রলীগ, নিজেদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০০ বার সংঘর্ষে জড়িয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারির কারণে ছাত্রলীগের ৫৫ জন কর্মী নিহত হয়েছিলেন। এ ছাড়া পরীক্ষায় নকল জালিয়াতি ও ভুয়া বাণিজ্যে জড়িয়ে গত ১৫ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘটিত ৩৭টি ঘটনার মধ্যে সব ক’টিতে ছাত্রলীগ জড়িত ছিল। মূলত সব দেশের সব ক’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে একটা অনিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল সরকারি ছাত্রচ্ছায়ায় থাকা ওই ছাত্র সংগঠনটি।
এই সব কারণে ২০১৮ সালে ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে ছাত্রলীগকে ‘লজ্জার ব্র্যান্ড’ হিসেবে অবহিত করে, নিউজ করেছিল। এই লজ্জাহিনতার চরম প্রদর্শনের নমুনা দেখিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন। ১৯৯৮ সালে নারী ধর্ষণের শততম বার্ষিকী পালনের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে মূলত দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুনি দেখানোর সাহস দেখিয়ে ছিল ছাত্রলীগের ওই দুর্নীতি দুর্বৃত্ত। রাষ্ট্র তারই প্রতি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি যদিও কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত ছাত্রীদের দীর্ঘ দুই বছরের লাগাতার প্রতিবাদ এর কারণে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছিল। তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শুনা গিয়ে ছিল যে, ‘ছাত্রদল কত কুকর্ম করে গেল, সেই নিয়ে কোনো কথা বার্তা শুনা যায় না। কিন্তু ছাত্রলীগ কিছু করলে পত্র-পত্রিকায় ব্যানার হেডিং করে। এইসব কুকর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে শুধু ছাত্রলীগের যুবক সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করা সমীচীন ছিল না, সমান তালে ছাত্রলীগের ছাত্রীগের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য, তার ভেতরে ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রীদের নাম ইতিহাস এর বিষয়বস্তু হয়ে আছে।
সিট বাণিজ্য দলীয় সন্ত্রাস এবং ধর্ষণের কাজে সহযোগিতার অভিযোগ এইসব কাজে ছাত্রীদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠলেও কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতো নীরবই ছিলেন। ছাত্রলীগ কর্তৃক সিলেটের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিলেট এমসি কলেজকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন এক সময়ে ওই ছাত্র সংগঠনটি। শত বছরের পুরনো ওই কলেজটি নিয়ে অনেক গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাসের জন্ম দেশের সকল নামী-দামি শিক্ষকদের- তত্ত্বাবধানে পাঠদান হতো বলে শিক্ষার্থী মাত্রই স্বপ্ন দেখতেন এমনকি কলেজে পড়াশোনা করার এবং একজন মেধাবী তরুণের স্বপ্নের সুতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত সিলেট মুরানী চাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) এর কৃতিমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে আটজন ব্যক্তিত্ব পরবর্তীকালে দেশের মন্ত্রী পদে আসীন হয়েছিলেন। যেমন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, শাহ এম এস কিবরিয়া, সাইফুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, নুরুল ইসলাম নাহিদ, এ কে আব্দুল মোমেন এবং এম এ মান্নান।
এই কলেজকে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। ১৯২৪ সালে সুনামগঞ্জ শহরে সুরমা উপত্যাকায় এক রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন ভারতের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সরোজিনী নাইডু। তিনি এমসি কলেজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন Every Student of the Collage should be poet.
সেই এমসি কলেজে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কলঙ্কিত ইতিহাসের জন্ম হয়েছে একবার নয়, দুই দুইবারের মতো। ২০১২ সালের ৮ জুলাই ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রবাসে বসবাসরত ছাত্রশিবিরের কর্মীদেরকে হল থেকে বিতাড়নের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরাও এমসি কলেজের শতবর্ষী ছাত্রাবাসের দু’টি ব্লকে আগুন ধরিয়ে দিলে চোখের সামনে পুড়ে ছাঁই হয়ে গিয়েছিল শত বছরের ঐতিহ্যের অহমিকা। তৎকালীন শিক্ষার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত দুইজন সেই পুড়ে ছাঁই হয়ে যাওয়া ছাত্রাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে ক্রন্দনরত চোখ মুছতে দেখা গেল। অবশ্য আবেগ তাড়িত হয়ে শিক্ষামন্ত্রী ওইদিন মন্তব্য করেছিলেন, যে বা যারাই এই কাজ করে থাকুক সরকার তার সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করবে। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই জানতেন, এ কেবল আবেগের কথা ছিল তারপরেও কথা গুলি বলেছিলেন। চরম এক কষ্ট বুকে পুষে রেখে কেবল পুড়ে যাওয়া একটি ছাত্রাবাসে একসময়ে ছাত্রাবস্থায় দিন কাটিয়ে ছিলেন যে তিনিও। এক সময়ে পুড়ে যাওয়া ছাত্রবাসের তত্ত্বাবধায়কের দায়েরকৃত মামলায় সন্দেহভাজন ১১ জন ছাত্রলীগ নেতার নাম উঠল। ভিডিও ফুটেজে তাদের অনেকেরই অবয়বের ছবিও দেখা গেল কিন্তু সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালত মামলার রায় ডিসমিস করে দিয়ে এক ঐতিহাসিক ঘোষণা জারি করলেন। রায়ে বলা হলো, প্রত্যক্ষ্যদর্শী প্রমানের অভাবে মামলাটি আমলে নেয়া সম্ভব হলো না। অর্থাৎ এই খানেও সেই দায়মুক্তি অধ্যাদেশের জয় হলো। আর দ্বিতীয় ঘটনাটা ছিল আরও কলঙ্কজনক এক বিষয়। ২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রাবাসে বসবাসরত ছাত্রলীগের কতিপয় তোর সম্মিলিত ধর্ষণের শিকার হয়ে এক নবপরিনীতা স্ত্রী একেবারে স্বামীর চোখের সামনে সম্ভ্রম হারালেন। এমসি কলেজের শতবর্ষের ইতিহাসে এই দুই ঘটনা চিরদিনের মতো কলঙ্কের টিপ হয়ে জ্বল জ্বল করে জ্বলবে- আমৃত্যু। সর্বশেষ ঘটনা ২০২৪ এর কোটা বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ওই আন্দোলনে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের মুখ্য সহায়কের ভূমিকা পালন করেছিল। পুলিশ যদিও সরকারি লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকায় আন্দোলনের মাঠে তৎপর ছিল অতি মাত্রায় কিন্তু ছাত্রলীগ ছিল পুলিশের ডান হাত হয়ে। আন্দোলনরত ছাত্রদের দমনপীড়ন এবং হত্যাকাণ্ডে তখন র্যাব, সেনাবাহিনী, আনসার ও পুলিশের সঙ্গে সমান তালে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিল ছাত্রলীগের কয়েক হাজার সন্ত্রাসী এবং আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের উপকমিটির সদস্য সচিব তারেকুল ইসলামের ভাষ্যমতে, আওয়ামী লীগ সবকারের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের হাতে আহত ছাত্র সহসাধারণ নাগরিকের হতাহতের সংখ্যা হলো আহত ২২ হাজারেরও বেশি এবং নিহতের সংখ্যা ১৪২৩ জনের মতো এবং অঙ্গহানির সংখ্যা ৫৮৭ জনের মতো গুলি লেগে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন ৬৮৫ জন এর মধ্যে ৯২ জনের দু’চোখ হারানোর হিসাব রয়েছে। এই বিরাট ক্ষয়ক্ষতির পরে আওয়ামী সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে নূতন এক সূর্যোদয়ের সূচনা ঘটেছে বাংলাদেশে। সরকারের রাঘব বোয়ালেরা, সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশজন দেশছেড়ে পালিয়েছেন। যদিও আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী দলের সাঙ্গ পাঙ্গকে অন্ধকারে রেখে আগেই দেশ ছেড়ে ছিলেন এবং ছাত্রলীগকে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ভেতর দিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যায়িত করে ছাত্রীলীগকে বিলুপ্তি ঘোষণা করা হলো।