Thikana News
৩০ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৫

বরিশাল বিভাগ : ঐতিহ্য যার পরতে পরতে

বরিশাল বিভাগ : ঐতিহ্য যার পরতে পরতে
একটি জনপদের ঐতিহ্য যেসব সূচকের ওপর নির্ভরশীল, তার মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা অন্যতম। সে বিবেচনায় বলা যায়, ঐতিহ্যের ধারক-বাহক উল্লিখিত সব সূচকই বরিশাল বিভাগে বিদ্যমান। আধুনিক চাষাবাদ-পদ্ধতির আবির্ভাবের পূর্বে সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদকালেও বরিশালকে নিয়ে প্রবাদ ছিল : ‘ধান নদী খাল-এই তিনে বরিশাল।’ বরিশাল ছিল বাংলার শস্যভান্ডার। চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত শস্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। এখানকার বালাম চাল ছিল ভারতবর্ষজুড়ে স্বনামখ্যাত।
বরিশাল বিভাগ
১৯৯৩ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছয়টি জেলা, যথাক্রমে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠির সমন্বয়ে ৪২টি উপজেলা নিয়ে এই বিভাগের যাত্রা শুরু হয়।
বরিশাল বিভাগের উপজেলাসমূহ
বরিশাল জেলার ১০টি উপজেলা হলো : আগৈলঝাড়া, বাকেরগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, বানারীপাড়া, গৌরনদী, হিজলা, বরিশাল সদর, মেহেন্দিগঞ্জ, মুলাদী ও উজিরপুর।
পটুয়াখালী জেলার ৮টি উপজেলা হলো : পটুয়াখালী সদর, বাউফল, দশমিনা, গলাচিপা, কলাপাড়া, মির্জাগঞ্জ, দুমকি ও রাঙ্গাবালী।
ভোলা জেলার ৭টি উপজেলা হলো : ভোলা সদর, তজমুদ্দিন, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, মনপুরা, লালমোহন ও চরফ্যাশন।
পিরোজপুর জেলার ৭টি উপজেলা হলো : কাউখালী, নাজিরপুর, নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী), পিরোজপুর সদর, ভান্ডারিয়া, মঠবাড়িয়া ও ইন্দুরকানী।
বরগুনা জেলার ৬টি উপজেলা হলো : বরগুনা সদর, আমতলী, পাথরঘাটা, বেতাগী, বামনা ও তালতলী।
ঝালকাঠি জেলার ৪টি উপজেলা হলো : ঝালকাঠি সদর, নলছিটি, রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া।
আয়তন : ১৩,২২৫.২০ বর্গকিমি (৫,১০৬.২৮ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা : (২০২৩ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী) ৮১ লাখ ১২ হাজার
জনঘনত্ব : ৬৩০/বর্গকিমি (১,৬০০/বর্গমাইল)
শিক্ষার হার : ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বরিশালের সাক্ষরতার হার ৬১.২%।
খ্যাতিমান ব্যক্তি ও নিদর্শনসমূহ : বরিশাল বিভাগের খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ যথাক্রমে : শের-ই বাংলা এ কে ফজলুল হক, আব্দুর রহমান বিশ্বাস (সাবেক প্রেসিডেন্ট), অশ্বিনী কুমার দত্ত (সমাজসেবক), শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল, শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, মেজর (অব.) আ. জলিল ৯ম সেক্টর কমান্ডার। আরও রয়েছেন স্বনামধন্য বহু কবি-সাহিত্যিক, প্রথিতযশা অনেক রাজনীতিবিদ। এ ছাড়া স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য জানা-অজানা বহু গুণীজন, যাদের জন্ম বরিশালকে মহিমান্বিত করেছে।
বরিশাল বিভাগের উল্লেখ করার মতো সব ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা হলে অনেক বড় আকারের একটি গ্রন্থ রচিত হবে কিন্তু ক্ষুদ্র পরিসরে তা সম্ভব নয়। তাই উল্লেখ না করলেই নয়, এমন কিছু বিখ্যাত বিষয় উল্লখ করা হলো। এ পর্যায়ে প্রথমেই বলতে হয় বরিশাল শহর তথা সৌন্দর্যমণ্ডিত বরিশাল বিভাগের প্রাচ্যের ভেনিস উপাধির কথা, যা বরিশালকে আলাদা মর্যাদায় উন্নীত করেছে। এ ছাড়া এককভাবে স্বনামে প্রসিদ্ধি লাভ করা প্রতিষ্ঠানসমূহ যথাক্রমে শিক্ষা প্রসারে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখা শতাব্দীপ্রাচীন স্বনামধন্য বিখ্যাত বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ভোলার চরফ্যাশনের ওয়াস টাওয়ার (যার উচ্চতা ২২৩ ফুট), পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, পায়রা সমুদ্রবন্দর, স্বরূপকাঠির ভাসমান পেয়ারাবাজার, উজিরপুরের শাতলা গ্রামের লাল শাপলার বিল অন্যতম।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ যার প্রকৃত চিত্র বরিশাল বিভাগে বিদ্যমান। নদী-খালের কারণে এখানে মূল যাতায়াত-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে জলযাননির্ভর। প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলার সঙ্গেই রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের ক্ষেত্র লঞ্চ-স্টিমারনির্ভর, যদিও বিলাসবহুল বাস সার্ভিসও রয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার ফলে বাসে ঢাকায় পৌঁছাতে পূর্বের চেয়ে সময় অনেক কম লাগার কারণে বর্তমানে বাসযোগেও ঢাকা যেতে অনেকে উৎসাহিত হচ্ছেন। তবে বেশির ভাগ মানুষই জলযানে যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ কারণেই পরিবহন ব্যবসায়ীরা মানুষের রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক ও বহুতলবিশিষ্ট চোখ-ধাঁধানো লঞ্চ সার্ভিস চালুর মাধ্যমে নিজেদের ব্যবসা ও জনসেবার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। জনগণও সাশ্রয়ী ও স্বাচ্ছন্দ্যময় যাতায়াতের সুবিধা নির্দ্বিধায় লুফে নিচ্ছে। ফলে উভয় পক্ষই এর সর্বোচ্চ সুবিধা লাভে সমর্থ হচ্ছে।
বরিশালের শস্যভান্ডার খ্যাতি শুধু ধান উৎপাদনের জন্যই নয়, বরং এখানে জনসংখ্যার অনুপাতে অন্যান্য ফসলও পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হয়। বিশেষ করে, মাছে-ভাতে বাঙালি প্রবাদটিও বরিশালবাসীর জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। উন্মুক্ত জলাশয়ে যেসব মাছের সমারোহ, তার মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, কই, শিং, মাগুর, শোল, গজার, চিতল, বোয়াল, টেংরা, পাবদা, পুঁটি, মলা, বাতাসি, ভেইদা, রিটা, চিংড়ি, বাইলা, বাইম এবং আরও হাজার রকমের মাছ। পক্ষান্তরে পুকুর, দিঘি ও বদ্ধ জলাশয়ে রয়েছে বিচিত্র ধরনের পোষা মাছ, যা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাণিজ্যিক সুবিধাও প্রদান করে। কলকাতার পুজোর ইলিশের প্রায় পুরোটাই রপ্তানি হয় বরিশাল থেকে। চাহিদা অনুযায়ী এখানে ফলফলাদিরও কোনো কমতি নেই। এখানকার দেশি সুস্বাদু পেয়ারা ও আমড়ার সুনাম শুধু দেশেই নয়, এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলের মধ্যে আরও রয়েছে আম, জাম, নারিকেল, সুপারি, কাঁঠাল, ডালিম, আতা, লেবু, কামরাঙা, তাল।
বরিশালের বৈশিষ্ট্য দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেকটা ভিন্ন। এখানে পারিবারিক বন্ধন অতি প্রাচীনকাল থেকেই অত্যন্ত নিবিড়। এর ফলে এখানে যৌথ পরিবারে বসবাস একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। এমনও সব পরিবার রয়েছে, যেখানে একই পরিবাওে তিন পুরুষের বসবাস। পারিবারিক ঐতিহ্যের মতো বাড়িঘরের অবস্থানও তদ্রূপ। একাধিক শরিক মিলে একই বাড়িতে বসবাস দীর্ঘকালীন চলমান ঐতিহ্য। প্রতিটি বাড়ির আকার অনেক বড় এবং প্রতিটি বাড়িতে পাকা ঘাটলাসমৃদ্ধ কমপক্ষে দুটি পুকুর বিদ্যমান। সদরেরটি পুরুষদের ব্যবহারের জন্য এবং অন্দরেরটি নারীদের গোসল ও থালা-বাটি পরিষ্কারের জন্য। অন্যদিকে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সদরে ছিল বাংলা বা কাছারি ঘরের প্রচলন। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং যৌথ পরিবার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ার ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একক পরিবার বৃদ্ধির ফলে বাড়তি ঘরবাড়ির প্রয়োজনে কৃষিজমির ওপর চাপ বাড়ায় ইদানীং পুকুরের সংস্কৃতি ত্যাগ করে অল্প জমির ওপর একক পরিবারের বাসগৃহ নির্মাণ ও টিউবওয়েল-নির্ভর পানি সরবরাহ-ব্যবস্থার দিকে অনেকে ঝুঁকছে, যা প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টির আশঙ্কার কারণ। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পানিপ্রবাহের স্বল্পতা ও অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণের ফলে নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট হয়ে পানির সহজপ্রাপ্যতা বিঘ্নিত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান পানিস্বল্পতার কারণে ‘ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল’ প্রবাদটি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বরিশালের আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ, গবেষক, নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ দৃষ্টি দেওয়া আশু প্রয়োজন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক। কুইন্স ভিলেজ, নিউইয়র্ক।

কমেন্ট বক্স