শাহীন ভাই তখন বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। তিনি জানালেন, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তিনি আমার সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করবেন। কিছুদিন পরে ওনার কাছ থেকে একটা ফোন পেলাম। তিনি আমাকে সাদরে আমন্ত্রণ করলেন ঠিকানার পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। আমি সাদরে গ্রহণ করলাম সেই আমন্ত্রণটি। ঠিকানা পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হবে- এই আনন্দেই হলাম বিভোর।
তার কিছুদিন পরে এল আরও একটি বিস্ময় করা খবর। আমাকে ই-মেইল করে জানানো হলো, ঠিকানা সম্মাননা গুণীজন বাছাই কমিটির রায়ে সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য আমাকে নির্বাচন করা হয়েছে ঞযরশধহধ ইবংঃ খরঃবৎধৎু অধিৎফ-২০২২ এর জন্য। আমি প্রচণ্ডভাবে বিস্মিত ও আনন্দিত হলাম। এত বড় সম্মাননা পাওয়ার যোগ্যতা রাখি ভেবে বোধ করলাম গভীর কৃতজ্ঞতা।

ঠিকানার সঙ্গে সম্পর্ক বহুদিনের। নব্বই দশকের শুরুর দিকে আমি বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে আসি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি করতে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে আমার জন্মভূমিকে ছেড়ে এলেও তার মায়া ত্যাগ করতে পারিনি। দেশের জন্য সব সময় মন কাঁদত। দেশে কী ঘটছে না ঘটছে তা জানতে মন চাইত। সেই সময় কোনো স্মার্ট ফোন ছিল না, ছিল না কোনো ফেসটাইম, ভাইবার বা ওয়াটসঅ্যাপ। কার্ড ব্যবহার করে দেশে ফোন করতে হতো, যা ছিল কলেজপড়ুয়াদের জন্য খুবই ব্যয়বহুল। পাঁচ মিনিটের জন্য ফোন করে পরিবারের সবার খোঁজখবর নিতেই সময় শেষ হয়ে যেত। দেশের কথা আলাপ করার সময় হতো না। সেই একাকিত্বের প্রহরে, সেই মন খারাপ করা বিকেলে, আমার বাংলাভাষী সঙ্গী হয়েছিল ‘ঠিকানা’।
সেই সময় বাঙালি গ্রোসারি দোকানে বা নিউজস্ট্যান্ডে ঠিকানা পত্রিকা বিক্রি হতো। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে সাবওয়ে ট্রেন থেকে নেমে দোকান থেকে প্রতি সপ্তাহে আমি সংগ্রহ করতাম ঠিকানা। প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত খুঁটে খুঁটে আমার সবগুলো পছন্দের খবর পড়তাম, তবেই আমার শান্তি হতো। এক নিমেষে ফিরে পেতাম আমার বাংলাদেশকে। বাংলার মাটি থেকে দূরে থেকেও যেন মাটির গন্ধ পেতাম। দূরে থেকেও কাছে পেতাম বাংলার জীবনবৃত্তান্ত। কাছে পেতাম আমার শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি। স্বদেশে, প্রবাসে এবং বিশ্বচরাচরে কী কী ঘটছে তা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে ও বিশ্বস্ত মানের খবর প্রদান করত ঠিকানা। যত দিন নিউইয়র্কে ছিলাম, তত দিন ঠিকানা ছিল হাতের নাগালের মধ্যেই। নিউইয়র্ক ছেড়ে টেক্সাসে চলে আসার পর ঠিকানাকে পেয়েছি অনলাইনে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে সেটা পাঠক হিসেবে।
২০২০ সালে নতুন করে আবার ঠিকানার সঙ্গে যোগাযোগ-এবার লেখক হিসেবে। লেখালেখির জগতে ফেরত আসার পর অনেকটা কৌতূহলের বশে একদিন আমার একটি লেখা পাঠাই ঠিকানায় ছাপানোর জন্যে। ঠিকানার ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ সংখ্যায় ছাপা হয় আমার লেখা, ‘বলুন তো আমি কী?’, যা ছিল আমাদের অতিপরিচিত ফেসবুক সম্পর্কে। এই লেখাটি আমেরিকাবাসী পাঠকের মনে দারুণ সাড়া জাগায় এবং ভীষণভাবে সমাদৃত হয়। শাহীন ভাই আমাকে ফোন করে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ‘আপনি আরও লিখতে থাকুন, পাঠাতে থাকুন।’ এরপর আরেকটি লেখা, যা প্রবাসের বাঙালি নারীদের মাঝে ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়, সেটি ছিল ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’। তার পর থেকে ঠিকানা পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় সমকালীন ও সমাজসচেতনতামূলক বিষয় নিয়ে আমি নিয়মিত কলাম লিখে চলেছি।
দিনটি ছিল ১৬ জুলাই রোববার। ৩৪ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল বিশ্বে সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র ঠিকানার পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। সেই সঙ্গে পত্রিকাটির বিশিষ্ট লেখকদের সম্মাননা প্রদান। খুব দারুণ ও প্রাণবন্ত একটি আয়োজন করেছিল ঠিকানা। নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনা রেস্টুরেন্টের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বর্ণিল সাজসজ্জার মাঝে মিলিত হয়েছিলেন মূলধারার রাজনীতিবিদ, কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কবি-সাহিত্যিক, লেখক-প্রকাশক, সাংবাদিকসহ প্রবাসের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সেদিন দুপুরে আমার একান্ত পরিবার ও ‘ঠিকানা’ পরিবারের সঙ্গে এক স্মরণীয় সময় কাটিয়েছি। শাহীন ভাইয়ের অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও অশেষ আতিথেয়তায় বারবার মনে হয়েছে, ‘আমি নতুন কেউ নই, বহুদিন ধরেই এই পরিবারের সদস্য।’
অনুভূতিটা ছিল খুব অসাধারণ। পাওয়াটা ছিল খুব আনন্দজনক। নিউইয়র্ক সিটি মেয়র অফিসের ডেপুটি কমিশনার ফর ট্রেড ইনভেস্ট অ্যান্ড ইনোভেশন, দিলীপ চৌহানের হাত থেকে আমি সম্মাননা পদকটি গ্রহণ করি। মনেপ্রাণে অনুভব করি আমার লেখালেখির সার্থকতা। পুরো সময়টা উপভোগ করি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সম্মাননা প্রদান, সমাজের বিশিষ্ট মানুষদের বক্তব্য, অনেকগুলো গুণী ও বরেণ্য মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কথা বলা, ছবি তোলা এবং চমৎকার মধ্যাহ্নভোজের মাধ্যমে।
আমেরিকা জীবনের খুব বড় একটা সময় কেটেছে নিউইয়র্ক শহরে। এখন থাকি টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে। টেক্সাস থেকে নিউইয়র্কে বেড়াতে গিয়ে ঠিকানা পরিবারের কাছ থেকে এমন অসামান্য একটি সাফল্য-উপহার পেয়ে মনে হয়েছে, এই বন্ধন কখনো ভাঙার নয়... হাজার মাইলের দূরত্ব কোনো ব্যবধান নয়।
লেখক : ব্লগার ও কলামিস্ট, টেক্সাস।
 
  
 


 রোমিনা লোদী জয়িতা
 রোমিনা লোদী জয়িতা  
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
