দেশ ছেড়ে পালালেও শেখ হাসিনাই আওয়ামী লীগের প্রধান। কারো ওপর দায়িত্ব দেননি এতো দিনেও। ভারপ্রাপ্তও করেননি কাউকে। সেই নমুনাও নেই। তা হলে কী হবে দলটির? শেখ হাসিনারই বা কী পরিণতি হবে? ঢাকা সফরের সময় যুক্তরাজ্যের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর-বিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্ট পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায়। জিজ্ঞাসা ঘুরছে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই বা কেমন হবে?
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক আপদ নতুন নয়। এর আগেও দূরাবস্থায় পড়েছে দলটি। তবে, এবারের মতো নয়। এবারের পরস্থিতি একেবারেই আলাদা। বাস্তবতাও ভিন্ন। ৫ আগস্ট পট-পরিবর্তনের পর দলটির নেতৃস্থানীয়রা হয় জেলে, নইলে আত্মগোপনে। শেখ হাসিনা কি দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন? পরিবারের কাউকে বেছে নেবেন? নাকি নিজেই অন্য শক্তির সাহায্যে ফের দৃশ্যপটে হাজির হবেন? ভারতের ওপর নির্ভর করে কতোদিন বসে থাকবেন তিনি?
এসব সব প্রশ্ন কূলকিনারাহীন। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো হত্যা মামলা দেশে। তাকে ফিরিয়ে আনার চাপ বাড়ছে। চাওয়া হয়েছে সহযোগিতা ইন্টারপোলের কাছেও। এর মাঝেই ঢাকা সফরকালে যুক্তরাজ্যের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর-বিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্ট পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনকে বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব দলের সমান অংশগ্রহণ আশা করে যুক্তরাজ্য। ‘সব দল’ বলতে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের জন্যও সমান সুযোগ সৃষ্টির উদ্যাগও চায়?
এমন প্রশ্নের অবশ্য তিনি সরাসরি জবাব দেননি। বলেছেন, ‘আমরা চাই, সবকিছু কীভাবে এগিয়ে যাবে, সেটার রূপরেখা অধ্যাপক ইউনূস সরকার দেবে।’ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি উত্তর দিন বা না দিন, আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের আলোচনা জমেছে বেশ। ওদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় আলোচনায় নতুন হাওয়া। অঙ্ক কষছেন কেউ কেউ। কী সুবিধা পেতে পারে দলটি?
এসব নিয়েও চলছে নানা কানাঘুষা। রাজনীতির প্রধান দল বিএনপির এ বিষয়ক কী ভাবনা? তাও প্রশ্ন। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর আওয়ামী লীগও নিষিদ্ধের দাবি উঠলে বিএনপির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সায় মেলেনি। জানিয়েছে তারা রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। আবার ভারত শুধু আশ্রয় দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারেও দেশটির সরকার ও মিডিয়ার সায় রয়েছে। এটিই বা কোন সমীকরণ?
দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা শুধু নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মুছে ফেলেননি, বরং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করেছেন। লাগামহীন দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের দায় কাঁধে চাপিয়ে আওয়ামী লীগের আপামর নেতাকর্মীরাও বিপর্যয়ের গহ্বরে। এর মধ্য দিয়ে মুসলিম লীগের মতো আওয়ামী লীগও চিরতরে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবে? নাকি কোনো না কোনো পথে পুনর্জীবন পাবে বা পুনর্বাসন হবে?
এখনও সারাদেশে আওয়ামী লীগের কয়েক কোটি নিষ্ঠাবান নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছেন। কিন্তু আবারও শেখ হাসিনা ও তাঁর বশংবদরা নেতৃত্বে থাকলে নিষ্ঠাবান নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অতি ক্ষুদ্র অংশই পতনের বিপর্যয়কর গহ্বর থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পাবে, সেই নমুনা নেই। তাই বলে তৃণমূলও শুদ্ধ থাকেনি। দলটির অনেক নেতাকর্মীই গত সাড়ে ১৫ বছরে কোনো না কোনোভাবে অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোটিপতি হওয়ার মিশনে মত্ত ছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা আত্মগোপনে বা পালিয়ে গেলেও তাদের পরিবার-স্বজন হয়তো বিদেশে পাচার করা অর্থে আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করতে পারবে। বাকিরা কী করবে? এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের দায়িত্বই বা কারা নেবেন? এ কাজের জন্য জেলের বাইরে থাকা দুর্নীতিমুক্ত ও লুটপাটের মামলার বাইরে কে বা ক’জন আছেন?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন, ঢাকা।