গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হাজারো শহীদের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে এবং জীবন রক্ষার্থে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বোনসহ ভারতে চলে যান। আন্দোলনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই ছাত্র-জনতা রাষ্ট্র সংস্কারের ডাক দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর সংস্কারের জন্য ১০টি কমিটি গঠন করে দেয়। সংস্কার কমিটি রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন সময় দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংস্কার ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনাগুলোকে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। সেই সব রাজনৈতিক সংস্কার ভাবনা থেকে আমি আমার রাষ্ট্র সংস্কার ও আগামীর সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠনের জন্য একটি সংস্কার পরিকল্পনা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি।
১. জাতীয় সংসদ গঠন পদ্ধতি : একটি সমন্বিত পদ্ধতি অনুসরণ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। একটি নির্বাচনের মাধ্যমে দুভাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংসদ গঠিত হবে।
সমন্বিত পদ্ধতির নির্বাচনের এই দুটি অংশ হলো :
১. সরাসরি নির্বাচনী পদ্ধতি
২. সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি
ক. সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতি : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি সংসদীয় আসনে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়ন দেবে এবং যেসব সংসদীয় আসনে কোনো প্রার্থী প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে যাবেন, তাহলে সেই সব প্রার্থী সরাসরি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবেন। কারণ এটা ওই সংসদীয় আসনের জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের নির্বাচনী আকাক্সক্ষার চূড়ান্ত মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
খ. সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক : অনেক রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্পন্ন করার সুপারিশ করছে। তারা তাদের সংস্কার ভাবনায় বলেছে, প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে দল তাদের সংসদ সদস্যদের মনোনীত করবে। এই বিজয়ী দলের সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য মনোনয়ন-বাণিজ্য ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটবে। এতে প্রার্থী কোনো সরকারি নিয়মনীতি ও আইনি বিধিবিধান লঙ্ঘন করছেন কি না, তার যাচাই-বাছাই করার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্যই আমার বিকল্প প্রস্তাব হলো, যেসব আসনে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে ব্যর্থ হবেন, ওই সব সংসদীয় আসনের প্রাপ্ত ভোটের সমন্বিত শতাংশ অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুসারে আসন বণ্টন করা হবে এবং সারা দেশে দলগুলোর মনোনীত যেসব প্রার্থী বেশি ভোট পাবেন, তাদেরকে ক্রমানুসারে সংসদীয় আসনভিত্তিক সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করে ৩০০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। তবে প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী বিজয়ী প্রার্থী পাওয়া না গেলে অবশিষ্ট সাধারণ বিজয়ী প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করা যেতে পারে। আমার ধারণা, সংসদ সদস্যগণ ৫০ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে সরাসরি জয়ী হওয়ার জন্য আরও বেশি জনকল্যাণমূলক রাজনীতির চর্চা করবেন। কেননা তখন একজন প্রার্থী শুধু তার নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের হিসাব কষে পাস- ফেল নির্ভর করবে না বরং সারা দেশের ভোটের হিসাব অনুযায়ী তাদের পাস-ফেল নির্ভর করবে। সকল প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে সরাসরি বিজয়ী হতে সচেষ্ট থাকবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে স্থানীয় জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের মনোনয়ন দিতে উদ্বুদ্ধ করবে। এভাবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে জনপ্রিয়, জনবান্ধব ও জনকল্যাণমূলক নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে, যা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভবিষ্যতে মনোনয়ন-বাণিজ্যের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে। আর যারা যোগ্যতার ভিত্তিতে মনোনয়ন পাবেন, তারা তখন নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে লুটপাট ও দুর্নীতিতে জড়ানো থেকে নিজেকে বিরত থাকবেন। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি অনেকাংশেই কমবে।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন-ব্যবস্থায় প্রচলিত নির্দলীয় পদ্ধতিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থাকে কার্যকর ও শক্তিশালী করতে আইন প্রণয়ন করতে হবে। যে পদ্ধতিতে এরশাদের সরকার যে আইনে উপজেলা পরিষদ গঠন করেছিল, সে আইন অবশ্যই জনগণের কল্যাণের জন্য পুনর্বহাল করতে হবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান হবে দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে বলে মনে করি। রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থাপিত সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে সংসদ গঠনের অস্পষ্টতা দূর হবে। কেননা রাজনৈতিক দলগুলো শতাংশভিত্তিক সংসদ গঠন করতে চাইছে কিন্তু প্রার্থী সম্পর্কে কোনো ধারণাই তারা জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি। এভাবে নির্বাচন করা হলে মনোনয়ন-বাণিজ্যের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
গ. সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করতে হবে, সংবিধান সংশোধন এবং অনাস্থা প্রস্তাব ছাড়া অন্য যেকোনো সাধারণ আইন বা আলোচনায় সংসদ সদস্যগণ নিজস্ব স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারবেন। এ জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে না, যা পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে প্রচলিত রয়েছে। সংবিধানের এই পরিবর্তনের ফলে সংসদ সদস্যগণের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
ঘ. সংরক্ষিত মহিলা আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জেলাভিত্তিক একজন সংসদ সদস্য সরাসরি প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। এই ভোট সংখ্যানুপাতিক ভোটের হিসাবে সংযুক্ত থাকবে না।
২. সরকার গঠন : বিগত সময়ের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হবে না। তখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে পারবে। যে দলগুলো কোয়ালিশন সরকারে যোগদান করবে, তারা ওই চুক্তির মাধ্যমে কমপক্ষে ৩ বছরের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে সমর্থন করতে পারবে না। এতে করে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলেও স্থায়িত্ব অর্জন করতে পারবে।
৩. প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যদি কোনো প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারী চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ করে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন, তবে তিনি তার অবসর গ্রহণের ৩ বছর পরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। আর কোনো কর্মকর্তা যদি স্বাভাবিক অবসর গ্রহণ করেন, তাহলে তার অবসর গ্রহণের ৩ বছর পরে রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু তারা কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তবে সরকার মনে করলে অবসরপ্রাপ্ত কোনো দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকতাকে মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদান করতে পারবে। এরূপ কঠোর আইনের কারণে প্রজাতন্ত্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ না থাকার কারণে তারা চাকরিকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ‘দলদাস’ এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বিমুখ হবেন এবং তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে নিরপেক্ষ ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত হবেন।
৪. যেসব ব্যবসায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইবেন, তারা বিগত পাঁচ বছরে কখনোই ঋণখেলাপি হতে পারবেন না। যারা রাষ্ট্রের সেবা করতে ইচ্ছুক, তারা যেন কোনো ব্যর্থ ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি না হন। যেসব ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি নিজেদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানই চালাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারাই ঋণখেলাপি হয়েছেন। তাই তাদের হাতে দেশও নিরাপদ থাকতেই পারে না। ঋণখেলাপিদের রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ কমানোর মাধ্যমে দেশের অর্থিক খাতে খেলাপিঋণের সংস্কৃতি কমবে এবং শৃঙ্খলাও ফিরে আসবে। সৎ ও সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি দেশের শিল্প-কলকারখানার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন বলে দেশও দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।
৫. নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এবং জাতীয় সংসদের অনুমোদন ও সংসদ সচিবালয়ের সুপারিশ সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি এসব পদে নিয়োগ প্রদান করবেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার কোনো অনুমোদন প্রয়োজন হবে না।
৬. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হবেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে অবশ্যই মন্ত্রী হিসেবে কমপক্ষে এক বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা তার থাকতেই হবে। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস। যদি এর একটি অংশও গ্রহণ করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার মেধা ও শ্রম সার্থক হবে।
-আটলান্টিক সিটি