অন্তর্বর্তী সরকারে প্রথম অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল দুটি বিষয়ে। এর একটি সংবিধান সংশোধন, অন্যটি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে অপসারণ। আবারও নতুন অন্তর্দ্বন্দ্ব দুজন নবনিযুক্ত উপদেষ্টাকে ঘিরে। চিত্রনির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও সেখ বশিরকে নিয়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই দুজনের নিয়োগ মানছে না। তাদের মতামত ছাড়া উপদেষ্টা নিয়োগে তারা মর্মাহত। প্রতিবাদ হিসেবে ফেসবুক আবার ‘লাল’ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সেনা-ছাত্র-উপদেষ্টার সমন্বয়ে গড়া ‘তেভাগা সরকার’তটস্থ। পদ বাঁচাতে বঙ্গভবন থেকে ‘মহামুজিবে’র ছবি নামিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
অন্যদিকে ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস ছিল বিশেষ আলোচনায়। সদ্য বিজয়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি-প্ল্যাকার্ডঅলা মিছিল ব্যর্থ হয়েছে। ভারতে বসে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন ট্রাম্পের ছবি নিয়ে মিছিল করতে। পাল্টা কর্মসূচি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিএনপি, জামায়াত ও আওয়ামী বিরোধীরাও মাঠে ছিলেন। ফলে ঢাকার জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগের জমায়েত হয়নি। বরং শেখ হাসিনার বিচারের উদ্দেশ্যে জারি হয়েছে রেড অ্যালার্ট। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফেরানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আদালত এ বিষয়ে সক্রিয়। ভারতের সঙ্গে আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে চাপ। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরও নানামুখী চাপ বাড়ছে। তবে অভ্যন্তরীণ চাপের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও নতুন দাবি-দাওয়া দিচ্ছে। সর্বশেষ দাবি ‘উত্তরবঙ্গে উপদেষ্টা’ চাই। কোটা আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ উত্তরবঙ্গের। অথচ রংপুর বা রাজশাহী বিভাগ ‘উপদেষ্টা’ পায়নি। এক চট্টগ্রাম বিভাগেই ১৭ উপদেষ্টা। অথচ ১৬ জেলার উত্তরবঙ্গ একজনও পেল না। ফলে ফুঁসে উঠছে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ আন্দোলন। মানববন্ধন, পথসভা করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রশক্তি। কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, উত্তরবঙ্গকে অবহেলা করা সরকারের বৈষম্যচিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
জাতীয় পার্টিও ছাত্রদের ব্যর্থ বলার চেষ্টা চালাচ্ছে। শুধু শেখ হাসিনাই ‘রেড নোটিশ’ পাচ্ছেন না, ভারতের ‘রিপাবলিক টিভি’ও আইনি নোটিশের মুখোমুখি। ইউনূস সরকারকে নিয়ে গুজব রটানোর প্রামাণ্য অভিযোগ। এর সঞ্চালক ইতিমধ্যে ‘মলম বিক্রেতা’ আখ্যা পেয়েছে। বাংলাদেশে নিউজ কন্টেন্ট নিষিদ্ধ ও ব্লক করার দাবি উঠেছে। আইনি নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে এই নোটিশ। সরকারের কয়েকজন সচিব নোটিশ পেয়েছেন। তথ্য-সম্প্রচার, স্বরাষ্ট্র, আইসিটি সচিব ও বিটিআরসি চেয়ারম্যান। নোটিশে বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাওয়া হয়েছে। অনেকের ধারণা, টিভিটিতে হাসিনাপন্থীরা টাকা ঢেলেছেন। আইনি নোটিশ জারি হলো নবনিযুক্ত দুই উপদেষ্টাকে ঘিরেও। তিন দিনের মধ্যে পদত্যাগের লিগ্যাল নোটিশ জারি হয়েছে। নোটিশ দিয়েছেন জজকোর্টের আইনজীবী সফিকুল ইসলাম। অনেকের ধারণা, এর নেপথ্যে আছেন ছাত্রনেতারা। এতে প্রথম টার্গেট চিত্রনির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ওনাকে ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারে’র সুবিধাভোগী বলা হচ্ছে। ‘ব্যাচেলর’-খ্যাত পরিচালক ফারুকীর স্ত্রী বিখ্যাত অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার কিছু আলোকচিত্র এখন ভাইরাল। ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রের প্রধান অভিনেত্রী। শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠতা। যদিও কোটা আন্দোলনকালে ফারুকী ছাত্রদের সমর্থন করেন।
তবে সমালোচকদের অভিযোগ ভিন্ন খাতে। প্রশাসনিক কোনো প্রামাণ্য অভিজ্ঞতাও নেই। তাহলে মন্ত্রীসম উপদেষ্টা পদ সামলাবেন কী করে? নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের রানিংমেট হিসেবে কি তাকে মানায়? এমন তির্যক মন্তব্যে ভরপুর সামাজিক মাধ্যম। উল্লেখ্য, ড. আসিফ নজরুলের অধীনে ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক প্রচারণা বন্ধ নিয়ে বিতর্ক চলছিল। সেই ‘হাইপোথেটিক্যাল গোলযোগে’র মাঝেই উপদেষ্টা বদল। সরকার-সমর্থকদের ‘আসিফ নজরুল পক্ষ’ এ জন্য মর্মাহত।
‘আকিজ বিড়ি’-খ্যাত সেখ আকিজউদ্দিনের পুত্র সেখ বশিরউদ্দিন। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, আদ-দ্বীন হাসপাতালের কর্ণধার। বাণিজ্য উপদেষ্টা পদে নবনিযুক্ত, তবে বিতর্ক উঠেছে। সহোদর সেখ আফিলউদ্দিন আওয়ামী এমপি ছিলেন। । জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ছাত্রহত্যার আসামি। দেশে আকিজ গ্রুপের কর ফাঁকির রেকর্ড রয়েছে। তবে অনেকের মতে, সেখ বশির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চালাতে সক্ষম। হত্যাকাণ্ডের আসামি হয়েছেন নামের ভুলের কারণে। সরকারে নবাগত তরুণসহ অভিজ্ঞদের সমাগমও রয়েছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরোধিতাই বেশি। বলা হচ্ছে, ‘খেলো হয়ে উঠছে তেভাগা সরকার’। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো হুমকির মুখে। উপদেষ্টা, ছাত্রশক্তি ও সামরিক শক্তির ঐক্য কামনা করা হচ্ছে। সচেতন মহলের মতে, অন্তর্নিহিত কোন্দল সামান্যই। দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ না হলে জনগণ হতাশ হবে।