আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল চলাকালে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে স্বামী নিহত হয়েছেন উল্লেখ করে এক নারী মামলা করেন। এর তিন মাস পর তার স্বামী থানায় এসে হাজির হয়ে জানান, তার অজান্তে স্ত্রী তাকে ‘মৃত’ দেখিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে মামলা করেছেন। ঘটনা ঘটেছে ঢাকার আশুলিয়ায়।
পুলিশ জানিয়েছে, গত ২৪ অক্টোবর কুলসুম বেগম (২১) নামের এক নারী তার স্বামীকে হত্যার অভিযোগ এনে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন।
এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। পরে এটি ৮ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়া থানায় এজাহারভুক্ত হয়।
মামলার বাদী কুলসুম বেগম স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়েছেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার স্বল্প সিংজুরী বাংগালা গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা দেখিয়েছেন আশুলিয়ার জামগড়া।
এজাহারে উল্লেখ করেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট সকালে তার স্বামী মো. আল আমিন মিয়া (৩৪) মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকেল ৪টার দিকে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বিজয় মিছিলে তিনিও ছিলেন। তবে পরাজয় মেনে না নিতে পেরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তার স্বামী নিহত হন।
বাদী কুলসুম বেগম আরো বলেন, অনেক খোঁজাখুঁজি করে তিনি স্বামীর সন্ধান পাননি। পরে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালের ৬ আগস্টের এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পারেন, এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন করেছে। এসব কাগজপত্র হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আছে। পরে তিনি হাসপাতালে থাকা কাগজপত্র, ছবি ও ভিডিও দেখে তাঁর স্বামীর লাশ শনাক্ত করেন।
মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুছ ছালাম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানসহ ১৩০ জনের নাম উল্লেখ আছে।
আল আমিন মিয়ার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আল আমিন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পিরিজপুরের বাসিন্দা। মামলা দায়েরের প্রায় দুই সপ্তাহ পর তিনি জানতে পারেন, তাকে ‘মৃত’ দেখিয়ে স্ত্রী মামলা করেছেন। মামলা থেকে আসামির নাম প্রত্যাহার করার কথা বলে নাকি তার স্ত্রী লোকজনের কাছ থেকে টাকা-পয়সাও নিচ্ছেন। আল আমিন তখন মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলায় ছিলেন। বিষয়টির সত্যতা পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি জুড়ী থানায় যোগাযোগ করেন। সেখানকার পুলিশ তাকে নিজের এলাকা দক্ষিণ সুরমা থানায় বিষয়টি জানাতে পরামর্শ দেয়।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, আল আমিন গত সোমবার সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমা থানায় এসে পুলিশকে বিস্তারিত জানান। পুলিশ বিষয়টি আশুলিয়া থানাকে অবহিত করে। পরে সেখানকার পুলিশ এসে মঙ্গলবার আল আমিনকে আশুলিয়া থানায় নিয়ে যায়।
আল আমিনের ভাই জাহাঙ্গীর আলম মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গণমাধ্যমকে বলেন, তার ভাইকে ‘মৃত’ দেখিয়ে কুলসুম মামলা করেছেন। বিষয়টি তারা পুলিশকে জানিয়েছেন। পরে আশুলিয়া থানা-পুলিশ তার ভাইকে আশুলিয়া থানায় নিয়ে এসেছেন। তিনিও ভাইয়ের সঙ্গে আছেন।
সিলেট মহানগর ও দক্ষিণ সুরমা থানার পুলিশের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আল আমিন পুলিশকে জানিয়েছেন, ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে মেকানিকের কাজের সুবাদে তিনি স্ত্রীসহ জুড়িতে অবস্থান করছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটে। তবে দীর্ঘদিন ধরে তারা সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পিরিজপুরে বসবাস করছেন। এখানেই তিনি স্ত্রী-পরিবার নিয়ে থাকেন।
আশুলিয়া থানায় মঙ্গলবার রাতে আল আমিন বলেন, ‘৫ আগস্ট সে (স্ত্রী) আমার সঙ্গে সিলেটেই ছিল। এর তিন-চার দিন পর ঝগড়া করে মানিকগঞ্জে চলে যায়। এরপর আর তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি। তিন-চার দিন আগে একজনের কাছ থেকে জানতে পারি, আমি ৫ তারিখের (৫ আগস্ট) আন্দোলনে মারা গেছি উল্লেখ করে সে একটা মামলা করছে। ওই মামলার একজন আসামি আমাকে ফোন দিয়া ঘটনাটি বলছে। এটা জানার পর আমি দক্ষিণ সুরমা থানায় গেছি। একটা জিডি করছি, ওসির সঙ্গে পরামর্শ করছি। এরপর ওইখান থেকে আমাকে আশুলিয়া থানায় পাঠিয়ে দিছে।’
আল আমিন আরো বলেন, ‘আমি জীবিত আছি। আমার স্ত্রী মিথ্যা মামলা করেছে। আমি এখনো মারা যাইনি। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেছি। আমি মনে করছি, ওরে কেউ জোরজবরদস্তি করে মামলা দেওয়াইছে বা কোনো চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত।’
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন বলেন, বাদী কুলসুম মিথ্যা মামলা করেছেন। তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া আল আমিনকে সিলেট থেকে আশুলিয়া থানায় আনা হয়েছে। তাকে আদালতে নেওয়া হবে। সেখানে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেবেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে কুলসুমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন ধরেননি।
ঠিকানা/এএস