Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

অর্থনীতিতে স্বস্তি রাজনীতিতে অস্বস্তি

অর্থনীতিতে স্বস্তি রাজনীতিতে অস্বস্তি
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স ৩ মাস পূর্ণ হচ্ছে ৮ নভেম্বর। এই তিন মাসে দেশের ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে বেশ স্বস্তি ফিরেছে। তবে কাক্সিক্ষত সংস্কার এবং দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এখনো স্পষ্ট কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় রাজনীতিতে বিরাজ করছে একধরনের অস্বস্তি। বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৃতীয় মাসে আর্থিক খাত ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর তৎপরতা জনমনে অনেকটা স্বস্তি এনেছে। তবে এই সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্য নিয়ে মানুষের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে।
অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ব্যাংকে আস্থা ফিরতে শুরু করে। এর প্রতিফলন দেখা যায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর টানা তিন মাসেই ২০০ কোটি ডলার করে ছাড়িয়ে যায় রেমিট্যান্স-প্রবাহ। রিজার্ভও সুসংহত হয়। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়। আগের সরকারের সময়ে নেওয়া বিপুল অঙ্কের ঋণ থাকার পরও সংস্থাগুলো সরকারের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে সাড়া দিয়ে সংস্কারে পাশে থাকার আশ্বাস দেয়। আগের সরকারের সময় ক্রমেই পতনে থাকা রিজার্ভ বেড়ে এখন প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে এসে থেমেছে। রিজার্ভ সামনে আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা অনুসারে রাষ্ট্র সংস্কারই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ বলে বিবেচিত হলেও তৃতীয় মাসে এসে তা কিছুটা প্রশ্নের মুখে পড়ে। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ১১টি বিষয়ে দুই দফায় ১১টি সংস্কার কমিশনের ঘোষণা দেওয়া হলেও পাঁচটি কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন এখনো জারি করা হয়নি। নির্বাচন হতে যত দেরি হবে, ততই পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দিতে পারে-এই আশঙ্কায় বিএনপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের শরিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে তৎপরতা বাড়িয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্য এবং সে কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তার পদত্যাগ দাবি করলেও বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত প্রকাশের ঘটনা ঘটেছে। এতে দেশের রাজনীতিতে অনেকটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
গত ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের লক্ষ্যে ছয় সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই টাস্কফোর্স প্রধানত আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ এবং প্রধান প্রধান ঝুঁকি নিরূপণ, দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, প্রভিশন ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথক্্করণ-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সরকারের অর্থ বিভাগের তথ্যমতে, নবগঠিত এবং ব্যতিক্রমী এ সরকারকে কাজ শুরু করতে হয় আগের সরকারের রেখে যাওয়া ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে। এর মধ্যে পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৭৯০ কোটি ডলার। এই বিপুল ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের চাপ এখন বর্তমান সরকারের ঘাড়ে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তা অর্থনীতিকে সচল করার জন্য ইতিবাচক, তবে পর্যাপ্ত নয়। শিল্প-কারখানায় কিছুটা শৃঙ্খলা এসেছে, রেমিট্যান্স বেড়েছে, এটা ভালো দিক। তবে মূল্যস্ফীতি কমাতে শুধু নীতি সুদহার বাড়ালেই হবে না, বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও গভীর নজর দিতে হবে। অর্থনীতিকে আরও সচল করতে হলে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ যাতে বাড়ে, সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোকে সচলের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে হবে। তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে, অর্থনীতি গতিশীল হবে।
এদিকে দ্রুত নির্বাচন দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মধ্যে গত ৩১ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন পুুনর্গঠনে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। তার আগে এই কমিটি গঠনের আগাম খবর জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের সরকারের নির্বাচনমুখী প্রক্রিয়া গ্রহণ করার যে কাজ, সেটা শুরু হয়ে গেছে। আপনারা বলতে পারেন নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।’ যদিও নির্বাচন আয়োজনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পথ চলতে চায় দলটি। এ জন্য জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে যাতে কোনো দূরত্ব তৈরি না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকছে। তবে যৌক্তিক সময়ে ভোটের ব্যবস্থা না করলে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে থেকে সরকারের ওপর চাপও তৈরি করবে বিএনপি- এমনটাই জানা গেছে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের অবস্থানও বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর সমর্থন পায়নি। বিএনপির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তারা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের পাশাপাশি সমালোচনাও সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচিত সরকারই শ্রেষ্ঠ সরকার। আশা করি, এই সরকার অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দেবে। নির্বাচন একটি দরজা, সে গেট পার হয়েই গণতন্ত্রের পথে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আবারও বলছি, অতি দ্রুত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করুন। জঞ্জাল যা আছে, সাফ করে ফেলুন। পরিষ্কার কথা- আবারও চক্রান্ত করে বিএনপিকে বাদ দিয়ে কিছু করার চেষ্টা করতে যাবেন না। এটা বাংলাদেশের মানুষ কখনোই মেনে নেবে না। একবার বিরাজনীতিকরণ মাইনাস টু করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আবারও ওই রাস্তায় যাওয়ার কথা কেউ চিন্তা করবেন না।’ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ থেকে ফ্যাসিস্ট বিদায় নিয়েছে। বিপ্লবের এই স্পিরিট ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে বলে আশা করি। তবে সরকার দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার প্রস্তুতি এখনো সম্পন্ন করতে পারেনি। আশা করি, দ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দেবে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সাইফুল হক বলেন, জনগণের বিশাল প্রত্যাশার চাপ নিয়ে সরকার পরিচালনায় নানা ঘাটতি ও দুর্বলতা থাকলেও গত তিন মাসে দেশের ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। অর্থনীতি কিছুটা সচল হতে শুরু করেছে। তবে সরকারের কিছু কাজে জনমনে বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাদের কিছু পদক্ষেপ ও ঘোষণাও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে জরুরি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে মর্যাদার সঙ্গে বিদায় নেওয়া।

কমেন্ট বক্স