Thikana News
২২ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

বিয়ের লাইসেন্স

বিয়ের লাইসেন্স
এই মৌ, ওইদিকে যাচ্ছিস কেন? হোটেলে ঢোকার দরজা তো অন্যদিকেÑআপাদের ডাকে মৌটুসির বোধোদয় হলো। কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার তা ঘটেই গেছে। মৌটুসি তাড়াহুড়ো করে বাগানের অন্য প্রান্ত দিয়ে যেতে গিয়ে একেবারে কুকুরের ইয়ের ওপর পাড়া দিয়ে ফেলেছে। কী বিশ্রী অবস্থা। ডান পায়ের স্যান্ডেলের তলায় একেবারে মাখামাখি। মৌটুসির নিজের ওপর অনেক রাগ হলো। এ রকম একটা বোকার মতো কাজ সে করল কী করে।
মৌটুসির খালাতো ভাই রাসেল দৌড়ে এসে হাসতে হাসতে বলল, কুকুরের ইয়েতে পাড়া দেওয়ার মানে জানিস তো? একেবারে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী দর্শন, সাইন অব গুড লাক। একটা শুভ কাজ করে তুই তোর শুভ দিনটা শুরু করলি। আসলেই তো আজ মৌটুসির জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজ তার বিয়ে, মানে বিয়ের লাইসেন্স করার দিন। দুনিয়ার সবচাইতে ব্যস্ততম নগরী নিউইয়র্কের সিটি হলে গিয়ে এই রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। কারণ মৌ থাকে নিউইয়র্কে।
ঠিক এগারো বছর আগে আগস্ট মাসের এক পাতাঝরা দিনে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশ থেকে মৌয়ের আগমন। সেই দিনটা ছিল উত্তেজনা ও আশঙ্কায় ভরা। বহু প্রতীক্ষিত আমেরিকার মাটিতে পদার্পণ করে ঠিক যেমনটা ভেবেছিল সে রকম কিছুই মনে হয়নি মৌয়ের। ওর চাচা-চাচি এসেছিল ওকে নিতে জেএফকে এয়ারপোর্টে।
নব্বই দশকের জেএফকে এয়ারপোর্ট ছিল একেবারেই আলাদা। অনেক ছোট ও মলিন, কোনো জৌলুশ বা চাকচিক্যবিহীন। এয়ারপোর্টের কর্মীরাও ছিল সাংঘাতিক নিঃস্পৃহ ও চাঁচাছোলা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের প্রতি তাদের আচরণ একদম বন্ধুসুলভ ছিল না। বরং তাদের হাবভাব ছিল ঠিক উল্টো। যেন তারা আমেরিকার মাটিতে বিদেশিদের দেখতে চায় না। ওদিকে বাইরে প্রকৃতিও ছিল দারুণ নারাজ। আকাশ ছিল মেঘলা, থমথমে। টিপটিপ করে একটু পরপর বৃষ্টি হচ্ছিল। চারদিক ছিল বিষণ্নতায় ঢাকা।
মৌয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্লেন থেকে নেমে শুট দিয়ে এসে মৌ যখন এয়ারপোর্টের ভেতরে প্রবেশ করল, চারদিকে তাকিয়ে দম ফেটে তার কান্না এসেছিল। বুকের মধ্যে হু হু করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, এক দৌড়ে আবার প্লেনে গিয়ে বসে, যাতে প্লেন তাকে আবার ফেরত নিয়ে যায় ফেলে আসা দেশের মাটিতে। ফেলে আসা নিজের বাড়িতে, বাবা-মা ও স্বজনদের মাঝে। এরপর বহুদিন গড়িয়ে গেছে। আস্তে আস্তে আমেরিকার জীবনযাত্রায় মৌ অভ্যস্ত হয়েছে। জীবনের পথপরিক্রমায় বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে। কিন্তু আমেরিকায় আসা প্রথম দিনটার কথা সে এখনো ভোলেনি।
আবার সেই আগস্ট মাসেই মৌয়ের জীবনে আরেকটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। ঘুরেফিরে কেন আগস্ট মাসেই বিশেষ দিনগুলো আসে, মৌ ভেবে পায় না। আগস্ট মাসের ১ তারিখ, মৌয়ের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন অর্থাৎ লাইসেন্স পাওয়ার দিন। যার সঙ্গে মৌয়ের শুভ কাজটি সম্পন্ন হবে, তার নাম সিয়াম। সিয়াম থাকে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের বে-এরিয়ায় অবস্থিত ওকল্যান্ড শহরে। সে ওখানে একটি হাইটেক ফার্মে কর্মরত।
বিয়ের কারণে এখন এসেছে নিউইয়র্কে। উঠেছে কুইন্সের একটি পাঁচতারা হোটেলে। এই উইকেন্ডে সেও ভীষণ ব্যস্ত। অনবরত এয়ারপোর্টে যাওয়া-আসা করছে, কাউকে না কাউকে রিসিভ করতে। বাবা-মা, বোনেরা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই আসছে নিউইয়র্কে বিয়ে উপলক্ষে। শুক্রবারে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন, শনিবারে মৌদের বাড়িতে কাজির উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো এবং রোববারে মৌদের পরিবার থেকে রিসেপশন। সিয়ামের পরিবারের রিসেপশন হবে দুই সপ্তাহ পরে ওকল্যান্ডে।
সিয়াম অনুরোধ করেছিল, মৌ যেন লাইসেন্সের দিন সকালে ওরা যে হোটেলে উঠেছে সেখানে আসে, ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। ওনারা সিয়ামের মুখে মৌয়ের কথা অনেক শুনেছেন কিন্তু সামনাসামনি দেখা হবে এই প্রথম।
একই স্টেটে না থাকার কারণে এক বছর ধরে মৌ আর সিয়ামের ফোনালাপ চলেছে। হয়েছে একে অপর সম্পর্কে জানাশোনা। বিয়ের বেশির ভাগ প্ল্যানিংই হয়েছে ফোনে ফোনে। বিয়েতে মৌ কী রঙের শাড়ি পরতে চায়, কোন ব্র্যান্ডের প্রসাধনী তার পছন্দ, বিয়ের আংটিতে হীরার সঙ্গে হোয়াইট গোল্ড না ইয়েলো গোল্ড, হানিমুনে কোথায় যেতে চায় তারা, সংসারটা কী করে সাজাতে চায়Ñএমন কত কিছু। এক বছর ধরে নিজের মতো করে সময় নিয়ে ওরা একে অপরকে চিনেছে, বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে।
প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল, সেদিন এক মজার কাণ্ড ঘটল। মৌ চাকরি করে জাতিসংঘের হেড কোয়ার্টারে। ওর অফিস ম্যানহাটনের ইস্ট সাইডের ৪৬ স্ট্রিটে। মৌয়ের অফিসের ছুটির পরে তাদের প্রথম দেখা করার কথা একটা কফিশপে। সেখানে কফি খেয়ে কিছুটা আলাপচারিতা সেরে তাদের একটা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা ডিনারের জন্য।
ক্যাফেতে মুখোমুখি বসে প্রথম যখন দুজন কথা বলতে শুরু করল, তখন দুজনেই ছিল ভীষণভাবে নার্ভাস। কীভাবে শুরু করবে, কী জিজ্ঞেস করবেÑএসব ভাবতে ভাবতে মৌ একসময় কফির কাপ উল্টে ফেলল। সেই কফি গড়িয়ে গিয়ে পাশে রাখা ব্যাগ, কাগজপত্র সব ভিজিয়ে দিল। অনেক মোছামুছি করে ওগুলো শুকালো ঠিকই কিন্তু কফির গন্ধ গেল না। কী বিশ্রী সেই গন্ধ। সেই কথা মনে হলেই মৌয়ের হাসি পায়। আর সিয়াম তো সব সময়ই মৌয়ের সঙ্গে ঠাট্টা করে যে তাকে প্রথম দেখে মৌ এতই প্রেমে দিওয়ানা হয়েছিল যে তার আশপাশের দুনিয়াদারির কোনো খেয়ালই ছিল না।
এরপর সিয়াম বেশ কয়েকবার নিউইয়র্কে এসেছে মৌয়ের সঙ্গে দেখা করতে। মৌ সিয়ামকে নিয়ে নিউইয়র্কের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে। টাইমস স্কয়ার, রকফেলার সেন্টার, এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন, সেন্ট্রাল পার্ক, চায়না টাউন-এমন আরও অনেক আকর্ষণীয় স্থানে। ওরা দুজন একসঙ্গে যতই সময় কাটিয়েছে, ততই একে অপরকে বোঝার, জানার সুযোগ পেয়েছে এবং অবশেষে একে অপরকে জীবনসাথি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তাই তো এক বছর ধরে জানাশোনার পর পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই সিয়াম ওর বাবা-মাকে মৌয়ের কথা বলেছে। ওর বাবা-মা দেশ থেকে এসে সিয়ামের বাড়িতেই আছেন। সব কথা শুনে বিয়েতে ওনারা মত দিয়েছেন, তবে মৌয়ের সঙ্গে পরিচয়পর্বটা রাখা ছিল একেবারে বিয়ের সময় নিউইয়র্কে যাওয়ার পরে। তাই ১ আগস্ট সকালে সিয়াম দাওয়াত করেছে মৌ ও তার পরিবারকে হোটেলে এসে ওদের সঙ্গে নাশতা করার জন্য।
মৌ ওর হবু শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তার বড় দুই আপু, এক দুলাভাই ও খালাতো ভাই রাসেলের সঙ্গে। রাসেল ও সিয়াম আবার পূর্বপরিচিত। ওরা দুজনই ওকল্যান্ডের বাসিন্দা, পূর্ব চেনা বন্ধু। মৌ ও সিয়ামের কথোপকথন স্টেজে রাসেলই দারুণ ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করেছে। আজ যখন ওদের দুজনের দীর্ঘ জানাশোনা একটি স্থায়ী, পরিপূর্ণ সম্পর্কে রূপ নিতে যাচ্ছে, তখন এই মহাশুভ লগ্নে রাসেল উপস্থিত থাকবে না, তা তো হতেই পারে না।
সিয়ামের বাবা-মায়ের সঙ্গে মৌ ও তার পরিবারের আলাপ-পরিচয় খুব সুন্দর গতিতেই এগোল। হাসি হাসি মুখ করে হবু শাশুড়ি তার হবু বউমার গলায় সোনার লকেট ও কানের দুল পরিয়ে দিলেন। এটা করে তিনি যেন তাদের পরিবারে মৌয়ের আগমনের আরও একটি ধাপ সম্পন্ন করলেন। মৌয়ের দুলাভাই সিয়ামের বাবার সঙ্গে দারুণ আড্ডায় মেতে উঠলেন। সিয়াম মহা উৎসাহে মৌয়ের বড় দুই আপুর সঙ্গে শালির মতো ফাজলামি শুরু করে দিল। আর সুযোগ পেলেই সে আড় চোখে মৌয়ের দিকে তাকাচ্ছিল আর দেখছিল যে মৌ লাজুক ভঙ্গিতে হাসছে।
বারবার ঘুরেফিরে একটা কথাই মৌয়ের মনে হতে লাগল। কিছুক্ষণ পরই তাদের দুজনের জীবনের আলাদা আলাদা দুটি পথ এক হয়ে মিলিত হয়ে যাবে। এক অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে সে বিভোর হতে লাগল। তবে একটি বারের জন্য সে জানল না যে সামনে অনেকগুলো বাধা তাদের এই শুভকাজে বিঘ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
ঠিক করা হলো, মৌ, সিয়াম ও সিয়ামের বন্ধু তানভীর, যে কিনা বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের সাক্ষী হবে, ওরা তিনজন মেট্রো ট্রেন ধরে ওদের হোটেল থেকে কুইন্স কোর্টের উদ্দেশে রওনা হবে। আর মৌয়ের পরিবারের বাকি সদস্যরা গাড়িতে করে আলাদা ওই একই জায়গায় আসবে। হোটেলের নিকটবর্তী ট্রেন স্টেশন থেকে কুইন্স কোর্টের স্টেশন পর্যন্ত ৭ নম্বর সাবওয়ে লাইনে পাঁচটি স্টপ।
এগারো বছর ধরে মৌ নিউইয়র্কের বাসিন্দা। মেট্রোরেলে চড়া তার নখদর্পণে। সে ভাবল, সে নিজেই সিয়াম ও তানভীরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। এর মতো সহজ কাজ আর হতেই পারে না। এক এক করে তাদের সেভেন ট্রেন যখন চার নম্বর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল, তখন কন্ডাক্টরের কাছ থেকে ঘোষণা এল, পরবর্তী স্টেশনে যাওয়ার রাস্তায় ট্রেনের ট্র্যাকে কোনো সার্কিট সংক্রান্ত জটিলতায় আগুন লেগেছে। তাই এই ট্রেনটা আর কোথাও এগোবে না। এই স্টেশন থেকে আবার পুরোনো স্টেশনে ফেরত যাবে।
তড়িঘড়ি করে ওরা তিনজন ট্রেন থেকে নেমে হাঁটা দিল। এই স্টেশনের পরের স্টেশনটি অর্থাৎ ওদের গন্তব্যস্থল মাত্র দুই ব্লক দূরে। কাজেই হেঁটে কুইন্স কোর্টে পৌঁছানো কোনো সমস্যা নয়। কাছাকাছি এসে একে, তাকে জিজ্ঞেস করে ওরা সহজেই কোর্ট ভবনে পৌঁছে গেল এবং যথারীতি একটি লাইনে দাঁড়াল। প্রায় তিরিশ মিনিট ধরে লাইনে দাঁড়ানোর সময় তারা লক্ষ করল, লাইনটি খুব ধীর গতিতে এগোচ্ছে। একটু পর একজন হোমরাচোমরা গোছের কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ভেতরের অফিসঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দিল, তাদের কম্পিউটার সিস্টেম এখন ডাউন। কখন আবার এটা চালু হবে, তা তাদের জানা নেই। তাই সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে কারও যদি কোনো অতি আবশ্যকীয় জরুরি কাজ থাকে, যেটা আজকেই সম্পন্ন করতে হবে, তাহলে যেন তারা অনুগ্রহ করে ম্যানহাটনের প্রধান সিটি হলে গিয়ে সম্পন্ন করে। মৌ ও সিয়ামের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আজকের মধ্যেই তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। তা করতে না পারলে পরের দিন তাদের ধর্মীয় বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে না। আর তা না হলে তার পরের দিন অর্থাৎ রোববার তাদের রিসেপশন অনুষ্ঠান ক্যান্সেল করতে হবে। বিয়েতে যোগ দিতে আমেরিকা ও আমেরিকার বাইরে থেকে দুই পক্ষের এত লোকজন এসেছে, তাদেরকে কী বলা হবে?
আবার ওদিকে রিসেপশনের পরের দিন ওদের হানিমুন ট্রিপও পাকা করা আছে। সোমবার দুপুরে মৌ ও সিয়ামের লাস ভেগাসের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা। সেখান থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় একদিন থেমে সোজা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। মৌয়ের বহুদিনের স্বপ্ন হাওয়াই যাবার। তাই সিয়াম যখন একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, মৌ হানিমুনে কোথায় যেতে চায়, মৌ একটুও দেরি করেনি বলতে তার স্বপ্নের কথা। দুজনের মনের মাধুরী মিশিয়ে প্ল্যান করা এই ট্রিপটাও তাহলে ক্যান্সেল করতে হবে।
মৌ আর সিয়াম দ্রুত ভাবতে থাকল কী করা যায়। তারা এখান থেকেই ট্রেনে করে ম্যানহাটনের উদ্দেশে রওনা হতে পারে। আর গাড়ির গ্রুপ তাদের নিজেদের মতো করে সিটিতে আসতে পারে। কুইন্স থেকে ম্যানহাটন যেতে গাড়িতে ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে অনেক বেশি সময় লাগে। ট্রেনে করে ওরা তিনজন অনেক আগেই পৌঁছে যেতে পারবে। প্ল্যান ঠিক হতেই তারা দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। এবার ট্রেন পেতে কোনো অসুবিধা হলো না। কুইন্স থেকে ৭ নম্বর ট্রেন ধরে টাইম স্কয়ার আর সেখান থেকে এফ ট্রেন নিয়ে সোজা ম্যানহাটনের সিটি হল স্টেশন।
সিটি হল স্টেশনে এসে রাস্তায় বেরিয়ে মৌ আর সিয়াম যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এবার দিন শেষ হওয়ার আগে বিয়ে করার লাইসেন্স পাওয়া গেলেই হলো। সিটি হলে ঢোকার মুখে আবার লাইনে দাঁড়াতে হলো। মৌ, সিয়াম আর তানভীর ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়াল আর একটু একটু করে লাইন এগোতে লাগল। খুব কড়াকড়ি নিয়মে সিকিউরিটি গেটে তাদের ব্যাগ, আইডি এবং শরীর তল্লাশি করা হলো। নাইন ইলেভেনের পর থেকে যেকোনো সরকারি ভবনে এখন এই কঠিন ব্যবস্থা চালু। এরপর এলিভেটরে চেপে পাঁচতলায় পৌঁছে ম্যারেজ ডিভিশনে এসে তারা আবার একটা ছোট লাইনে দাঁড়াল।
এবার দুরুদুরু বুকে মৌ আর সিয়াম অপেক্ষা করছে আর ভাবছে, আর যেন কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয়। লাইনে দাঁড়ানোর আগে তারা দুজন রেজিস্ট্রেশন ফর্ম পূরণ করে নিয়েছে। কাউন্টারে পৌঁছাতেই ওপারে বসা মহিলা হাসিমুখ করে ওদের হাত থেকে ফর্মটা নিয়ে বলল, ‘আর ইয়ু টু গেটিং ম্যারিড? মানি অর্ডার প্লিজ।’
সর্বনাশ, ওরা তো কোনো মানি অর্ডার বানায়নি। ভেবেছে নগদ টাকা প্রদান করবে। তাহলে কী হবে? ঘড়িতে এখন তিনটা বাজছে। চারটার সময় এই সার্ভিস কাউন্টার বন্ধ হয়ে যাবে। এখান থেকে বেরিয়ে বিল্ডিংয়ের বাইরে গিয়ে তিন ব্লক হেঁটে নিকটবর্তী পোস্ট অফিসে পৌঁছে মানি অর্ডার তৈরি করে ফেরত আসতে এবং নতুন করে আবার সিকিউরিটি লাইনে দাঁড়িয়ে বিল্ডিংয়ে ঢুকে এই কাউন্টারে পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে বা তার বেশিও লাগতে পারে। তাহলে কি আজ আর কাজটা হবে না?
কেন মৌয়ের জন্যই যত ঝামেলা আর গন্ডগোল অপেক্ষা করে? এখন পর্যন্ত একটা জিনিসও ঠিকমতো ঘটেনি আজকে। কী হবে যদি মৌ আর সিয়াম আজ রেজিস্ট্রেশন করতে না পারে। এত সব ভাবতেই মৌয়ের মাথা ঘুরতে লাগল। মনের মধ্যে অনেক চিন্তা এসে ভিড় করতে লাগল। তবে কি বিধাতা চাইছেন না যে মৌ আর সিয়ামের বিয়ে হোক? এতগুলো বাধা কি কোনো অশুভ ঘটনার আলামত?
এমন সময় তানভীর বীরদর্পে এগিয়ে এসে বলল, কোনো ভয় নেই। সে নিজে গিয়ে মানি অর্ডার বানিয়ে নিয়ে আসবে। মৌ আর সিয়াম যেন এখানেই অপেক্ষা করে। এই বলেই তানভীর দ্রুত বেরিয়ে গেল। মৌ আর সিয়াম একে অপরের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল। বিশ মিনিটের মাথায় আশ্চর্যজনকভাবে তানভীর এসে উপস্থিত। তার হাতে পঁয়ত্রিশ ডলারের মানি অর্ডার। ঠিক বিয়ে করতে যা লাগবে। চোয়াল বিস্তৃত বিশাল হাসি দিয়ে সে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নে এবার তোরা বিয়ে করে ফেল। আর কোনো ঝামেলা নেই।’ মৌয়ের মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল, এত তাড়াতাড়ি? আর কোনো রকম বিপত্তি ছাড়াই ওদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলো। ওরা পেল বিয়ে করার লাইসেন্স। ইতিমধ্যে গাড়ি গ্রুপও এসে পড়েছে। ওরা কুইন্স থেকে ম্যানহাটনে আসতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল। বহু কষ্টে ট্রাফিক পুলিশ ও রাস্তায় পথচারীদের সাহায্য নিয়ে ডাউন টাউনের সিটি হল খুঁজে বের করেছে। এসেই তারা মৌয়ের কাছ থেকে বাকি ঘটনা শুনল। সব কাজ সম্পন্ন করে সবাই সিটি হলের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল। এই স্মরণীয় দিনটির কথা তারা মনে রাখবে আজীবন। বিশেষ করে, মৌ আর সিয়াম। দুটি সন্তান নিয়ে মৌ আর সিয়াম আজ সুখে সংসার করছে। নিউইয়র্কের দিনগুলোর কথা মৌয়ের ভীষণ মনে পড়ে। আর যেদিন বিকেলে ওরা দুজন মগভর্তি চা নিয়ে সাগরপাড়ে আসে আর সমুদ্রের পানিতে সূর্যাস্ত দেখে মুগ্ধ হয়, সেদিনও মৌ তার মনের গভীরে চেপে রাখা এক প্রশ্নের অজানা উত্তর খোঁজে। ১ আগস্টের সেই দিনটিতে ঘটা ওগুলো কি ছিল নিছক কাকতালীয় ঘটনা, নাকি ওদের দুজনের মিলনের পথে ছিল প্রকৃতির কোনো গোপন বাধা, দুরভিসন্ধি! সে কথা কোনো দিন আর জানবে না মৌটুসি।

কমেন্ট বক্স