Thikana News
১৯ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪


 

ভয়ংকর আয়নাঘর নিয়ে এবার নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন

ভয়ংকর আয়নাঘর নিয়ে এবার নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন ছবি সংগৃহীত


ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বাংলার ১৭ কোটি মানুষের সামনে নতুন দুয়ার খুলেছে। এ সময় নতুন করে প্রকাশ্যে এসেছে শেখ হাসিনা সরকারের গোপন বন্দিশালা আয়নাঘরের কাহিনি। গোপন এ কারাগারে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতেন রাজবন্দিরা।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে ভয়ংকর সেই আয়নাঘরের বন্দিদের দুর্বিষহ জীবনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, আয়নাঘরের নির্যাতনের কারণে কোনো কোনো বন্দি উন্মাদ হয়ে গেছেন। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বন্দিশালার কয়েকজন বন্দি মুক্তি পেয়েছেন। তারা নিউইয়র্ক টাইমসকে তাদের নির্যাতনের ঘটনা জানিয়েছেন।

নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের শিকার শত শত মানুষের এখনো খোঁজ মেলেনি। সাধারণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, যেমন বিক্ষোভ বা সভা-সমাবেশ, সড়ক অবরোধ, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষুব্ধ মন্তব্য করার জন্য অনেককে গুম করা হয়েছে।

গুমের শিকার অনেকে গোপন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আবার অনেককে আয়নাঘরের গোপন বন্দিশালায় বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে। সেখানে অনেকে মারা গিয়েছেন। তবে সেখান থেকে আবার কেউ কেউ জীবন নিয়ে ফিরেছেনও।

আয়নাঘরের বন্দি মীর আহমেদ কাসেম আরমান গত আগস্টে মুক্তি পেয়েছেন। এ গোপন বন্দিশালায় তার মতো আইনজীবী ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কূটনীতিক, এমনকি মানবাধিকার কর্মীরাও ছিলেন।

গোপন এ বন্দিশালা থেকে মুক্ত হওয়া আরেকজন কয়েকবার স্ট্রোক করেছেন। তিনি মারা গেছেন ভেবে তার স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছেন। আরেকজন জানিয়েছেন, তার খোঁজে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ তার বাবার মৃত্যু হয়েছে।

আয়নাঘরে ঠিক কতজন মানুষ মারা গেছেন, তা এখনো অজানা। তবে গুমের শিকার ব্যক্তিদের বহু স্বজন এখনো তাদের ফেরার জন্য দিন গুনছেন। তাদের দাবি নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজ অথবা গুমের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হোক।

নিখোঁজ এক ব্যক্তির স্বজন তাসনিম শিপরা বলেন, কী ঘটেছে আমরা তার জবাব চাই। আমার চাচা বেলাল হোসেন ২০১৩ সালে নিখোঁজ হয়েছেন। সম্ভবত তিনি দুনিয়াতে নেই।

সাবেক বন্দিদের তিনজনকে আয়নাঘরের একটি ছবি আঁকার অনুরোধ জানিয়েছিল সংবাদমাদ্যমটি। সেখানে তারা বর্ণনা দিয়ে বলেন, একটি লম্বা করিডোরে আধা ডজন কক্ষ রয়েছে। একটি থেকে অপরটি দূরত্বে থাকলেও তা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। করিডোরের দুই প্রান্তে রয়েছে শৌচাগার। সেখানে একটি দাঁড়িয়ে ব্যবহারের জন্য, আরেকটি বসে ব্যবহারের জন্য। প্রতিটি ঘরে রয়েছে বড় এগজস্ট ফ্যান। নিরাপত্তারক্ষীদের আলাপ যাতে না শোনা যায় এবং বন্দিদের মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত করা যায়, সে জন্য এসব ফ্যান ব্যবহার করা হয়েছে।

আরমানের বর্ণনায় আয়নাঘর

মীর আরমান জানান, একদিন ভোর হওয়ার আগে কারারক্ষীরা তার কক্ষে ঢোকেন। এ সময় তার মনে হয়েছিল যে এই মনে হয় সব শেষ হয়ে আসছে।

জানালাবিহীন একটি ঘরে আট বছর বন্দি ছিলেন আরমান। কক্ষটির অবস্থা এমন ছিল, সেখানে একেকটা দিনও যেন অন্তহীন রাতের মতো ছিল। তবে ওই দিনটি ছিল ভিন্ন রকমের। ভোরের আলো ফোটার আগে নিরাপত্তারক্ষীরা তার ঘরে ঢুকে নামাজ শেষ করতে বলেন। এ সময় হাতকড়া খুলে চোখের পুরু বাঁধনও খুলে দেন।

আরমান ভেবেছিলেন, তাকে হয়তো মেরে ফেলে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হবে অথবা নর্দমায় ফেলে দেওয়া হবে। সেদিন তিনিসহ আরও কয়েকজনকে ছোট ভ্যানগাড়িতে তুলে শুয়ে বেঁধে দেন। দুজনের নিচে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়। তাদের নিয়ে এক ঘণ্টা গাড়ি ছুটতে থাকে।

অন্য অনেক রাজনৈতিক বন্দির মতো নির্মম ভাগ্য বরণ করতে হয়নি মীর আরমানকে। তাকে ঢাকার একটি নির্জন মাঠে ফেলে যাওয়া হয়। আরমান বলেন, দীর্ঘ অন্ধকার বন্দিজীবনে স্ত্রী ও দুই সন্তানের চিন্তা তাকে পাগল হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। আমি সব সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, আমাদের পৃথিবীতে দেখা না হলেও জান্নাতে যেন একসাথে হতে পারি।

৪১ হাজার বার চোখ বাঁধা ও হাতকড়া পরানো হয় আজমীকে

গোপন এ কারাগারের নির্মম যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়েছেন সাবেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আজমী। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের জন্য তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে গত ৫ আগস্টের পর তিনি গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।

আজমী আট বছর বন্দি ছিলেন। এ সময় অন্তত ৪১ হাজার বার তার চোখ বাঁধা ও হাতকড়া পরানো হয়েছে। তিনি বলেন, আমি বন্দিজীবনে আকাশ, সূর্য, ঘাস বা গাছপালা দেখিনি। বন্দি হওয়ার পর আমি প্রথম দিকে ভেন্টিলেটর দিয়ে আলো দেখার চেষ্টা করলে কর্তৃপক্ষ সিসিটিভিতে দেখে তা বন্ধ করে দেয়।

গোপন এ কারাগারে জীবনধারণের পরিবেশ ছিল না। এ ছাড়া সেখানে কঠোর নজরদারি করা হতো। চার থেকে ছয় মাসে একবার চুল কাটা হতো। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিকে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। তবে বেশি মানসিক নির্যাতনের শিকার হতেন বন্দিরা।

শুক্রবার বাচ্চাদের গানের সুর ভেসে আসত

কাতার ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মারুফ জামান ২০১৯ সালে আয়নাঘর থেকে মুক্তি পান। এক বছরের বেশি সময় তিনি আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন।

শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ভারতের স্বার্থরক্ষার সমালোচনা করতেন মারুফ জামান। তিনি জানান, আয়নাঘরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অনবরত মুখে ঘুষি মারা হতো। ফলে তার দুটি দাঁত পড়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা তার পোস্ট ও ব্লগের বিভিন্ন বিষয় প্রিন্ট করে আনত। পোস্টের নির্দিষ্ট কিছু প্যারা নিয়ে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করত।

তাদের মধ্যে একজন একদিন মারুফ জামানকে বলেন, আপনার পোস্ট প্রিন্ট করতে আমরা অনেক অর্থ খরচ করেছি। আপনার বাবা কি এসব অর্থ আমাদের ফেরত দিবেন?

পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম দিনের আলো দেখেন মাইকেল

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা আগস্টে মুক্তি পেয়েছেন। কয়েক ঘণ্টা গাড়িতে ঘুরিয়ে তাকে এক নির্জন বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তির পর তিনি জানান, পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম দিনের আলো দেখলাম। আমি যখন আলো দেখি, তখন দুবার পরীক্ষা করি, আমি স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তবে আছি।

২০১৯ সালে একটি ব্যাংকে ঢোকার সময় তিনি অপহৃত হন। কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কাছে জানতে চাইলে তাদের কাছ থেকে যে জবাব পেয়েছেন তা হলো- রাজনৈতিক প্রতিশোধ। আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। এ সময় মাইকেলের দলের ছাত্রসংগঠন সড়ক অবরোধ করে। সেদিন শেখ হাসিনা এ অবরোধের পেছনে কারা আছে তা দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এ অধিকারকর্মী বলেন, ওই ঘটনা শেখ হাসিনাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। আমি সব সময় তাদের কাছে আমার দোষের কথা জানতে চাইতাম। তারা বলত, আমি আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে রাজনীতি করছি।

ঠিকানা/এনআই

কমেন্ট বক্স