বেশ ধুমধাম করে ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর আল ফায়াদ চৌধুরীর (২৭) সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএর চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহনাজ কামরুন নাহারের। ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তিনি। মাত্র ১০ দিন পরই সন্তান জম্ম দেওয়ার কথা ছিল তার। সংসার আলো করে প্রথম সন্তান ভূমিষ্ট হবে, তাই খুশির জোয়ারে ভাসছিলেন শাহনাজ। আগত সন্তান মেয়ে হলে কী নাম রাখা হবে, আর ছেলে হলে কী নাম রাখা হবে সহপাঠী বান্ধবীদের সেটাও বলে রেখেছিলেন শাহনাজ। এদিকে বিয়ের পর মেয়ের কোলজুড়ে আসবে প্রথম ফুটফুটে সন্তান। তাই শাহনাজের বাবা-মা, ভাইবোনও ছিল আনন্দে মাতোয়ারা।
কিন্তু পরিবারের সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে সন্তানসম্ভবা শাহনাজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তবে তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। পরিবারের অভিযোগ, যৌতুকের দাবি না মেটানোয় স্বামী, শাশুড়িসহ শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের অব্যাহত শারীরিক নির্যাতন-নিপীড়ন সইতে না পেরে অবশেষে আত্মহননের পথ বেছে নেন মেধাবী শাহনাজ কামরুন নাহার।
গত মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) দিবাগত মধ্যরাতে নগরের কসমোপলিটন আবাসিক এলাকায় শ্বশুরের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে নিজের শয়নকক্ষে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে ‘আত্মহত্যা’ করেন শাহনাজ।
মঙ্গলবার দিবাগত গভীর মধ্যরাতে শাহনাজের নিথর দেহ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায় শ্বশুরপক্ষ। চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করলে হাসপাতালে তার লাশ রেখে পালিয়ে যায় শ্বশুরপক্ষের লোকজন।
শাহনাজের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও গ্রামে। বাবার নাম মো. মুনির আহমদ।
এদিকে তার মৃত্যুর ঘটনায় আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগ এনে স্বামী, শাশুড়ি, ননদসহ সাতজনকে আসামি করে বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) নগরের পাঁচলাইশ থানায় আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে একটি মামলা করেছেন শাহনাজের বড় ভাই শাহনেওয়াজ।
এ মামলায় বৃহস্পতিবার শাহনাজের স্বামীর বড় বোন তসলিমা আফরোজ (৪০), ননদ নাজিফা সালসাবিল (৩০) এবং তাদের ভগ্নিপতি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মীরেরহাট আলমপুর এলাকার দুলা মিয়া সওদাগর বাড়ির মো. ইউছুপের ছেলে মো. লোকমানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোলাইমান বলেন, ‘গৃহবধূ শাহনাজের মৃত্যুর ঘটনায় আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। মামলায় তিন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। শাহনাজের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
মামলার অন্য চার আসামি হলেন শাহনাজ কামরুন নাহারের (২৫) স্বামী মো. আল ফায়াদ চৌধুরী (২৭), শাশুড়ি চেমন আরা রফিক (৬৪), স্বামীর বড় বোন খাদিজা আফরোজ (৩৭) ও তাহমিনা আফরোজ (৩২)। ওই আসামিদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বেলখাইন এলাকার সামশুল আলম চৌধুরী বাড়িতে। শাহনাজের শ্বশুরের নাম মো. রফিকুল আলম চৌধুরী। তারা বর্তমানে বসবাস করেন নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন কসমোপলিটন আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর রোডের কাইয়ুম রেসিডেন্সের চতুর্থ তলায়।
এজাহারে অভিযোগ করা হয়, ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী মো. আল ফায়াদ চৌধুরীর সঙ্গে শাহনাজের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে যৌতুকের দাবিতে আসামিরা শাহনাজকে নির্যাতন করে আসছিল। শাহনাজ ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আগত সন্তানের কথা ভেবে দীর্ঘদিন ধরে আসামিদের অত্যাচার সহ্য করে আসছিলেন শাহনাজ। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে মোবাইল ফোনে কল করলে যৌতুকের দাবিতে আসামিরা নির্যাতন করছেন বলে শাহনাজ বাদীকে জানান। পরে বাদী তার স্ত্রীর মাধ্যমে জানতে পারেন, নির্যাতনের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তার বোন শাহনাজকে নগরের বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে যান আসামিরা। সেখানে ভর্তি না করায় মঙ্গলবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে শাহনাজকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানকার চিকিৎসকেরা শাহনাজকে মৃত ঘোষণা করলে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান আসামিরা।
বাদীর ধারণা, যৌতুকের কারণে আসামিদের অব্যাহত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং প্ররোচনার কারণে তার বোন শাহনাজ গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বাসার সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন।
ঠিকানা/এনআই