ঠিকানা রিপোর্ট 
করোনা মহামারীর সময় নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে সরাসরি কনস্যুলার সেবা বন্ধ ছিল। প্রবাসীরা দূর-দূরান্ত থেকে ডাকযোগে সেবা নিতেন। এই সেবা নেওয়ার জন্য তারা যে মানি অর্ডার সঙ্গে দিতেন, সেই মানি অর্ডার আত্মসাৎ হয়েছে। ঠিকানার অনুসন্ধানে প্রায় ৭০ হাজার ডলার আত্মসাতের খবর বেরিয়ে আসে। ঠিকানায় খবর প্রকাশের পর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এতকিছুর পরও দুর্নীতির গতি কমেনি। নানান অজুহাতে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে দুর্নীতি হচ্ছে, যা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।
৭০ হাজার ডলারের দুর্র্নীতির খবর প্রকাশ করায় এবং তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও তৎকালীন কনসাল জেনারেল (বর্তমানে ব্রাজিলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) সাদিয়া ফয়জুন্নেসা কনস্যুলেটের এক গোপন প্রতিবেদনে ঠিকানাকে সরকারবিরোধী পত্রিকা উল্লেখ করেছিলেন। অথচ ঠিকানা গত ৩৫ বছর ধরে বাংলাদেশি কমিউনিটি বিনির্মাণে কাজ করে চলেছে। সত্যি প্রকাশে কখনো পিছপা হয়নি।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের সেবার মান নিয়ে প্রবাসীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরকারি নিয়মে একেকজন কনসাল জেনারেল আসেন। দায়িত্ব পালন শেষে রাষ্ট্রদূত পদোন্নতি নিয়ে অন্য দেশে চলেও যান তারা। কিন্তু দায়িত্ব পালনকালে তাদের অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে হয় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন, অথবা যারা দুর্নীতি করেন তাদের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকেন। গত ১ অক্টোবর নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের স্থান পরিবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তন নিয়ে আর্থিক অসঙ্গতির অভিযোগ এসেছে। কাগজে-কলমে ১৯ হাজার ডলারের বিনিময়ে মুভিং কোম্পানি ঠিক করা হলেও অপেশাদার লোক ভাড়া করে নিজেরাই স্থানান্তর করেছে মালামাল। ফলে বিপুল পরিমাণ মালামাল নষ্ট হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নতুন মালামাল কেনার জন্য এমনটি করা হয়েছে।
এদিকে, গুদাম ঘর থেকে বাণিজ্যিক ভবনে যেতে নিউইয়র্ক কনস্যুলটকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় এক যুগ। এই এক যুগে গুদাম ঘর থেকে নিজস্ব ভবনের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বরং নিজস্ব ভবন খুঁজতে গিয়ে প্রায় এক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন নিউইয়র্ক সফরে আসা তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এর সঙ্গে কনস্যুলেটের কয়েকজন কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন। অনেকটা ‘কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে’ ভয়ে এখন আর নিজস্ব ভবন খোঁজা হচ্ছে না।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কর্মকর্তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। তাদের অনেকেই নানান হরিলুটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাদের মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন স্তরের অনেক কর্মকর্তা অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ নিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, কনস্যুলেটের বেশ কয়েকজন সিনিয়র ও অধস্তন কর্মকর্তা নানাভাবে কনস্যুলেটের অর্থ আত্মসাৎ করছেন। কনস্যুলেটের কর্মকর্তা হয়ে বেতন-ভাতা নেওয়ার পরও তাদের অনেকে নামে-বেনামে কনস্যুলেটের সঙ্গেই ব্যবসা করছেন। বিভিন্ন মাল্টিসার্ভিসের নামে ব্যবসা খুলে অনৈতিকভাবে লেনদেন করছেন কনস্যুলেটের কার্যক্রমে।
অভিযোগ রয়েছে- বাইরে কনস্যুলার সেবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন সেবা পাইয়ে দেওয়ার নামে অতিরিক্ত অর্থ নিচ্ছেন কতিপয় কর্মকর্তা। কাগজে কলমে সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা, যারা কনস্যুলেটে রাষ্ট্রীয় গোপনীয় শাখায় দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের কয়েকজন এখন মাল্টিসার্ভিসেস ব্যবসায় জড়িত। কয়েকজন কনস্যুলেটে সরকারি চাকরি ছেড়ে অধিক সুবিধার লোভে এসব ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেন।
এদিকে কনস্যুলেটের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তার নামে বাসা ভাড়া বেশী দেখিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ ঠিকানার হাতে এসেছে। জানা গেছে, প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তা প্রতিমাসে বাসা ভাড়া দেন ৩৬০০ ডলার। অথচ তিনি প্রতিমাসে সরকারি তহবিল থেকে নিচ্ছেন ৫৬০০ ডলার। আরো অভিযোগ রয়েছে- সরকারি কর্মকর্তাদের বাসায় ফার্নিচার লাগে সেগুলো ভাড়া দেখানো হলেও মুলত সেগুলো ভাড়া নেওয়া হয় না। প্রতিমাসে ভাড়া বাবদ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
এছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য বাসা ভাড়ায় অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরাসরি বাড়ি মালিককে ভাড়া পরিশোধ করার নিয়ম থাকলেও কনস্যুলেটের একজন কর্মকর্তা একটি ভূয়া কোম্পানর নামে চেক ইস্যু করছেন প্রতি মাসে। ফলে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাই কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হুদা ঠিকানাকে বলেন, প্রতিটি অভিযোগ মিথ্যা। নিউইয়র্ক কনস্যুলেটে অনিয়ম ও দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হয়। তবে সাবেক কর্মকর্তাদের কেউ বাইরে মাল্টিসার্ভিসেস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলে কনস্যুলেটের কিছু করার নেই। কনস্যুলার সেবার নামে কেউ অর্থ নিচ্ছে এমন খবরও তার জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কর্মকর্তাদের বাসা ভাড়ার অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। নিজেদের লোক দিয়ে নয়, মুভিং কোম্পানি ফার্নিচার স্থানান্তরের কাজ করেছেন। এসময় পুরনো কিছু ফার্নিচার নষ্ট হতে পারে। তবে এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি, জানান কনসাল জেনারেল।
