রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য বৈরিতা আমরা প্রত্যক্ষ করলেও শোষণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের তলে তলে মিলও রয়েছে, সেটি অনুমান করা যায়। যেমন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তারা শুল্কমুক্ত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করে থাকেন। এই তো গত নির্বাচনের পর যেসব গাড়ি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা হয়, তার ৩৩৪৬ সিসির একেকটি গাড়ির স্বাভাবিক শুল্ক হার ছিল ক্রয়মূল্যের ৮২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ১ কোটি টাকার গাড়ির কর ৮ কোটি ২৬ লাখ ৬ হাজার টাকা। কোনো কোনো সংসদ সদস্য গাড়ি নিজে না কিনে এই সুযোগটা ধনী পাবলিকের কাছে বিক্রি করেন। অর্থাৎ করসহ মোট ৯ কোটি ২৬ লাখ ৬ হাজার টাকার ১টি গাড়ি মাত্র ১ কোটি টাকায় আমদানি করেন ওই ধনী ব্যক্তি হয়তো ভালো একটা অ্যামাউন্ট সংসদ সদস্যকে দিয়ে রুজিতে বিসমিল্লাহ করান। তারপর শুরু...। এখানেই শেষ নয়, প্রতিবার নির্বাচিত হওয়ার পর এই সুযোগ আসে, তাতে সংসদের স্থায়ীকাল হোক ৫ বছরের কিংবা ৫ মাসের।
প্রশ্ন হলো, এত গরিব দেশে কেন এত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করতে হবে? সংসদ সদস্য হলেই এত টাকার কর মওকুফ করা হবে কেন? কেন রাষ্ট্রের টাকায় সংসদ সদস্যদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা হয় না? কেন সংসদ বাতিল হওয়ার পর সংসদের গাড়ি রাষ্ট্রের কাছে ফেরত দেওয়া হয় না? কেন পরবর্তী সংসদ সদস্য কিংবা সরকারের অন্যান্য সেক্টরের লোকজন তা ব্যবহার করতে পারেন না?
সংবিধানের কোন ধারায় সংসদ সদস্যদের এমন সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে? যদি তা আইনের আওতায় থেকেও থাকে, তবে এমন আইন কেন করা হলো? আইনপ্রণেতারা কি জানেন না, আমরা একটি গরিব রাষ্ট্রের নাগরিক?
সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে দেশের জন্য এমন কী অর্জন করে ফেলেন যে তাদের সাত-আট কোটি টাকার কর মওকুফ করতে হবে? তা ছাড়া সংসদ ভবনের সঙ্গেই তো রয়েছে তাদের জন্য বিলাসবহুল বাসস্থান। তাই এমনও নয় যে গাড়িতে করে গিয়ে তাদের সংসদে যোগ দিতে হয়। এই গাড়িতে করে তারা আসলে কোথায় যান যে তাদেরকে রাজা-বাদশাহর মতো করে যেতে হবে? ভারতের সংসদ সদস্যরা কি এমন সুযোগ পান? হয়তো না। পেলেই-বা আমাদের তা করতে হবে কেন? আমাদের রিজার্ভ তো তাদের মতো নয়। আরেকটু গভীরে ঢুকলে হয়তো দেখব, ওই গাড়ির জ্বালানি খরচ ও মেরামত খরচ বাবদ লাখ বা কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এরপর রয়েছে অতি অল্প মূল্যে জমির প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ। কয়েক কোটি টাকার প্লট নাকি দেওয়া হয় নামমাত্র মূল্যে। তাই নির্বাচনে বিশাল টাকা খরচের পেছনে থাকে এই গাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট পাওয়ার মতলব। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে গেলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না।
দ্বিতীয় বিষয় হলো কারাগারে ডিভিশন প্রাপ্তি। অন্যায় করে কারাগারে গেলে তারা পান উন্নত বা বিশেষ ব্যবস্থা! সাধারণ মানুষের চেয়ে তাদের শাস্তি হওয়ার কথা আরও কঠোর। কেননা তারা নির্বাচনের আগে বলেন তাদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। তাদের মিথ্যা বুলিতে বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ ভোট দিয়ে দেশের দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দেন। তাই তারা দোষ করলে তো শাস্তি কঠোর হওয়ার কথা। তা না করে কারাগারে তাদের দেওয়া হয় বিশেষ মর্যাদা। আরাম-আয়েশে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা! বলা হয়, তার সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে ডিভিশন দেওয়া হয়েছে। যে লোক দেশের অর্থ লুট করে, পাচার করে, অপচয় করে, বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, তার আবার সামাজিক মর্যাদা কিসের?
যাদের কারণে দেশের মানুষ চিকিৎসা পায় না, ভেজালমুক্ত খাবার ও ওষুধ পায় না, তাদের আবার মর্যাদা কিসের? দেশে বসবাসের অযোগ্য ভেবে যারা বিদেশে কোটি কোটি টাকার প্রাসাদ গড়ে, তাদেরকে তো দেশে এত সম্মান জানানোর প্রয়োজন নেই।
সংসদের ভেতরে একবার ঢুকে যেতে পারলে আশ্চর্যজনকভাবে তারা যে দলেরই হোক না কেন, তাদের মধ্যে অবৈধ প্রাপ্তির বিষয়ে তলে তলে একটা সুগভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, যা বাহির থেকে বোঝা খুব মুশকিল। দেশ সংস্কার করতে হলে এসব বিষয় বিবেচনায় আনতেই হবেÑআমাদের মতো সাধারণ জনগণের এটাই প্রত্যাশা।