এই তো সেদিনের কথা। টাঙ্গাইলের বেতকা গ্রামে পিতা সারোয়ার জাহান ও মাতা নাজমা বেগমের প্রথম কন্যাসন্তান তাসনুবার জন্মের কয়েক বছর পর ছেলে তানজিম সারোয়ার তার মা-বাবার কোল আলো করে জন্ম নেয়। যার পুরো নাম তানজিম সারোয়ার নির্জন। বোন তাসনুবা আর তার মা-বাবার মতো পরিবারের অন্যদেরও যেন খুশির সীমা নেই ছোট্ট নির্জনকে পেয়ে। কখনো মাটিতে পড়তে দেওয়া হয় না তাকে। একবার বোনের কোলে তো, একবার মায়ের আবার কখনো বাবা সারোয়ার জাহানের কোলে। কখনো-বা বাড়ির অন্যদের কোলে। এভাবেই হেসেখেলে, আনন্দে বাড়ির সবার চোখের মণি নির্জন সীমাহীন আদর-ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। নির্জনের বাবা-মা বলেন, আমাদের ছেলে লেখাপড়া শিখে একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে। অনেক বড় হবে আমাদের নির্জন। বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল করবে। আর্মির লেফটেন্যান্ট হবে। ছোট্ট নির্জন জিজ্ঞাসা করে, আব্বু, আর্মির লেফটেন্যান্ট কী? পিতা সারোয়ার জাহান ছোট্ট ছেলে নির্জনকে কীভাবে বোঝাবেন লেফটেন্যান্টের অর্থ? তিনি ছেলেকে আদর করে বুকে তুলে নিয়ে মুখে চুমু খেয়ে বলেন, বাবা নির্জন, আর্মির লেফটেন্যান্ট হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। যারা দেশ ও দশের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করেন। জনগণকে রক্ষা করার শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নির্জন বলে, ও তাই..? তাহলে বড় হয়ে আমিও আর্মির লেফটেন্যান্ট হব, আব্বু।
মা নাজমা বেগম বলেন, ও..লে..বাবা...তাই? এই তো আমার দেশপ্রেমিক সোনা ছেলে, বলে মুখে আদর করে চুম্বন দেন। বোন তাসনুবা বলে, সত্যি আমার লক্ষ্মী ভাইটি বড় হয়ে আর্মির লেফটেন্যান্ট হবে? নির্জন মিষ্টি হেসে মুখ নেড়ে বলল, হুম... হব। মা-বাবার মুখে ওইদিন এ কথা শোনার পর থেকে দু’চোখে স্বপ্ন দেখতে থাকে নির্জন। বড় হয়ে সে আর্মির লেফটেন্যান্ট হবে। দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে। বড় হয়ে মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে সে। এভাবে একবুক আশা আর দু’চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগল নির্জন।
সময়ের পরিক্রমায় একসময় নির্জন পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। তারপর ২০২২ সালের ৮ জুন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ৮২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে আর্মি সার্ভিস কোর শাখায় কমিশন লাভ করল। এভাবে সে তার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে চলতে থাকে। আজ সে আর্মির লেফটেন্যান্ট। মহা খুশি নির্জনের বাবা সারোয়ার জাহান ও মা নাজমা বেগম। ছোট ভাই আর্মির একজন লেফটেন্যান্টÑবোন হিসেবে সেই পরিচয় দিতে বেশ গর্ববোধ করে তাসনুবা। নির্জনের মা-বাবার অনেক আশা। তাদের একমাত্র ছেলের জন্য ধার্মিক, পর্দানশীল লাল টুকটুকে একটি বউ আনবেন ঘরে। মা-বাবা ও বোনের কথামতো নির্জনও বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। এবার ছুটিতে বাড়ি ফিরলেই ভালো পাত্রী দেখে নির্জনের বিয়ে দেবেন ওর মা-বাবা।
এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা চলে যান ভারতে। এরপর নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দেড় মাসের মাথায়ই দেশের পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যদিও এর আগে থেকেই তারা নানা রকম দেশদ্রোহী ও অসামাজিক কাজ করে চলেছে। নেশাদ্রব্য পাচার, সেবন, বিক্রি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করছে না তারা। প্রকাশ্য দিবালোকে তারা আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়াও দিচ্ছে। তারা বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলটাকে বলা যায় নিজেদের সন্ত্রাসী রাজ্যে পরিণত করেছে। এদেরকে ধরার জন্য এবং অস্ত্র জব্দ করতে পুলিশ ফোর্সের সঙ্গে সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট তানজিম সরোয়ার নির্জনেরও দায়িত্ব পড়েছে এ মিশনে। সে তার বড় বোন তাসনুবাকে ফোন করে জানাল, আপু, আমি আজ কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডোলাহাজারায় বড় ধরনের অপরাধ দমনের মিশনে যাচ্ছি। তুমি দোয়া করো। ফিরলে আবার কথা হবে, আপু। আর হ্যাঁ, এসে কিন্তু তোমার হাতের পিঠা খাব। তাসনুবা বলল, নির্জন, খুব সাবধানে অপারেশনের কাজ করিস, কেমন? মনে রাখিস, পাহাড়ি এলাকার উপজাতি গোষ্ঠী খুব নিষ্ঠুর, হিংস্র আর ভয়ংকর প্রকৃতির হয়। তা ছাড়া ওদের কাছেও আগ্নেয়াস্ত্র আছে। নির্জন বলল, হুম, তুমি ঠিক বলেছ, আপু। আমি তোমার কথা মনে রাখব।
তারপর সেদিন সেনাবাহিনী ও পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে নির্জনও সময়মতো পৌঁছাল কক্সবাজারে। সেখানে পৌঁছে সন্ত্রাসীদের গতিবিধি লক্ষ্য করে তারা সময়মতো অপারেশন চালাল। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে পালিয়ে যেতে লাগল। সাহসী নির্জন জীবনের পরোয়া না করে তাদের ধাওয়া করতে করতে পিছু নিল। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মধ্যে একজনকে জাপটে ধরে ফেলল নির্জন। সেই সন্ত্রাসীর হাত তখনো মুক্ত থাকায় সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য এলোপাতাড়ি চাকু স্টেপ করল নির্জনের দেহে। ক্রিমিনালের হাত অবরুদ্ধ করতে পারলে হয়তো এমন অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যেত লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জন। একসময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী নির্জনকে জখম করে পালিয়ে যায়। নির্জনের দেহে গভীর ক্ষত আর প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল সে। এ সংবাদ বাড়িতে পৌঁছালে শোকের ছায়া নেমে আসে নির্জনদের পরিবারে। কান্নায় ভেঙে পড়েন মা-বাবা-বোন সবাই।
কিছু দেশদ্রোহী অস্ত্রধারীর জন্য বাংলার বুক থেকে হারিয়ে গেল এক সাহসী দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জন। আর কখনো সে ফিরে আসবে না। খাওয়া হবে না আর বোনের হাতের পিঠা। মা-বাবার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে বউ আনা হবে না আর ঘরে। জীবন বাজি রেখে আর দেশের শত্রুদের বিপক্ষে লড়বে না নির্জন। কী করে লড়বে? আজ যে চিরদিনের জন্য সে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছে।